সাবধান! চারদিকে বিদ্বেষ…
এই লেখাটি লিখতে বসে উগ্র জাতীয়তাবাদ চর্চার প্রবর্তক অ্যাডলফ হিটরারের তথ্যমন্ত্রী গোয়েবলসের সূত্রটি খুব মনে পড়ছে। মিথ্যাকে সত্য বানানোর একটি সূত্র দিয়েছিলেন তিনি। এই সূত্র অনুসরণ করা সভ্যতা বিবর্জিত, সন্দেহ নেই। কিন্ত এটি যে খুব সত্য সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি বলেছিলেন একটি মিথ্যা বার বার বলতে থাকলে তা এক সময় বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে। একটি মিথ্যা বার বার বলে সত্য বানানোর একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ আমাদের সবার সামনে এই মুহূর্তেই আছে। কিন্তু সেটি আপাতত মনে করিয়ে দিচ্ছি না। শুধু বলছি, এখন আমাদের চারদিকে বিদ্বেষ। আমারা বিদ্বেষের সাগরে ডুবে যাচ্ছি।
বলছি বর্তমান সময়ের কথা। আজ থেকে ২০ বছর আগে হলে হয়তো কোন বিদ্বেষ সামনে আসলে বেশিরভাগ মানুষ সেটা বিচার বিবেচনা করে, ধরে ফেলতে পারতো। তিনি হাতে সময় পেতেন। কিন্ত এর এখন পরিমাণ এতি বেশি যে, মানুষ নিজস্ব বিবেচনা প্রয়োগ করার সময় পাচ্ছে না। একটা ঘটনা আসতে আসতে আরেকটা চলে আসে। তিনি কোনটা রেখে কোনটা বিবেচনায় আনবেন? তাই তিনি এখন ভাবেন, এত বিচার বিবেচনায় যাওয়ার চেয়ে ঘটনা শুনে ভুলে যাওয়াই ভাল। কিন্ত কোন ঘটনা শোনার পর পুরোপুরি ভুলে আসলে যাওয়া যায় না, মনে একটা ছাপ কিন্তু থেকেই যায়। আর এভাবেই তিনি হাজারটা বিদ্বেষের অন্ধকারে ডুবে যান।
এই বিদ্বেষ নিয়ে জাতিসংঘের একটি ওয়েব পেজে সবচেয়ে কার্যকর কথাটি বলেছেন, জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস। তিনি সেখানে বলেন, মানুষ ইন্টারনেটে অভ্যস্ত হওয়ার পর সমাজে বিদ্বেষ ছড়ানোর মাত্রা বেড়েছে। এটি এখন আমাদের রাষ্ট্রীয় এবং সমাজ জীবনের অন্যতম ঝুঁকি। কারণ প্রথাগত গণমাধ্যমের চেয়ে অনলাইলইনে বিদ্বেষ ছড়ানো অনেক সহজ। পদ্ধতির কারণে এখানে একটি বিদ্বেষ বার সামনে আসতে পারে এবং বার বার বহু মানুষকে এর সঙ্গে জড়াতে পারে। অনলাইনে বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্যে, তিনি বার বার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পদ্ধতিগত দুর্বলতা এবং মনিটরিং এর সীমাবদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দেন।
এই ওয়েব পেজেই বলা হয়, বিশ্বব্যাপী ইস্যুটি মোকাবেলা করার জন্য জাতিসংঘ বিদ্বেষ বার্তার একটি কাঠামো দিতে চায়। এরইমধ্যে তারা কোন ধরণের বার্তা বিদ্বেষ হিসাবে চিহ্নিত করবে, সেব্যাপারে একটি প্রাথমিক ধারণা দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে সেটাই হচ্ছে বিদ্বেষ বার্তা, যার মাধ্যমে সমাজে শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা থাকে। সেই বক্তব্য কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে যেমন হতে পারে, আবার হতে পারে কোন গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের নামেও। কোন আচরণ, বক্তব্য বা লেখায় আক্রমণ বা অবমাননাকর বা বৈষম্যমূলক ভাষা ব্যবহার করলেও সেটা বিদ্বেষ বার্তা হিসাবে বিবেচিত হবে।
আজ অবধি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অধীনে বিদ্বেষ বার্তার কোনো সর্বজনীন সংজ্ঞা তৈরি হয়নি। বিষয়টি নির্মাণের পর্যায়ে আছে। তাই আপাতত জাতিসংঘের আভাস ধরে আমরা বলতে পারি, যে বার্তায় সমাজের শান্তি নষ্ট হয় সেটাই বিদ্বেষ বার্তা। মূল বিষয় বিষয় হচ্ছে শান্তি ভঙ্গ। কিন্তু স্থান কাল পাত্র ভেদে একই রকম বার্তায় একটি সমাজে শান্তি ভঙ্গ হতে পারে আবার আরেকটি সমাজে নাও হতে পারে। মূল বিষয় হচ্ছে সমাজ বুঝে বার্তাটি ছড়ানো।
সমাজ বোঝার প্রসঙ্গ আসলেই পরিকল্পনার প্রসঙ্গটি চলে আসে। আর কোন একটি উদ্দেশ্য পূরণের জন্যেই কেবল মানুষ সময় দিয়ে, অর্থ দিয়ে সমাজ বোঝে। আর সেই উদ্দেশ্য যদি অসৎ হয় তাহলেই বলতে হবে ছড়ানো বার্তাটি বিদ্বেষ বার্তা। এখন আমরা মোটামুটি এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, অসৎ উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে কোন বার্তা ছড়ানো হলে সেটাকে আমরা বিদ্বেষ বার্তা বলবো।
যাই হোক, গুতেরেস এবং জাতিসংঘের প্রসঙ্গ এই লেখায় আনলাম কারণ, তারা কথা বলছিলেন, বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে। সেখানে বিদ্বেষ বার্তার অ্যাকাডেমিক আলোচনাই ছিল মুখ্য। আন্তর্জাতিক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রাধান হিসাবে তাঁর সেটাই করার কথা। তিনি কোন সমস্যা সমাধান করতে চাইলে আগে কাগজে কলমে করবেন। তার পর সমাজে নিয়ে যাবেন। কিন্তু তিনি যদি এই বিদ্বেষ বার্তার সামাজিক প্রভাব কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা দেখতে চাইতেন তাহলে তার বাংলাদেশের দিকে মনোযোগ দেয়া দরকার ছিল।
খুব মোটা দাগে বিদ্বেষ ছড়ানোর একটি উদ্যোগ সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে বাংলাদেশে। যে কারণে পরিকল্পনাকারীরা সেই বিদ্বেষের সবটা ছড়াতে পরেনি। কিন্তু বিদ্বেষ বার্তা ছড়ানোর দু’জন মানুষ চিহ্নিত হয়েছে। এখানে বলে রাখা ভাল যে আমার লেখার উদ্দেশ্য সমাজে বিদ্বেষ ছড়ানোর কুফল সম্পর্কে বলা। যে কারণে সেই চিহ্নিত দু’জন মানুষের নাম এবং নির্দিষ্ট কাজের কথা উল্লেখ করছি না। তার দরকারও নেই। কারণ এরই মধ্যে প্রচলিত গণমাধ্যমে এসব বিস্তারিত এসেছে।
এখন বলা যায় পরিকল্পিতভাবে তারা একটি চূড়ান্ত বিদ্বেষ প্রচার করতে চাচ্ছিলেন। যেটা একটি দেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে সত্য মনে হয়। যার ওপর ভর করে একটি রাষ্ট্রের সরকারের মত একটি প্রতিষ্ঠান উৎখাত হতে পারে। এরই মধ্যে প্রকাশ্য হয়েছে যে, তারা এই কাজটি করার জন্যে দির্ঘদিন প্রস্তুতি নিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের মন ও মনন বিশ্লেষণ করেছেন। অতঃপর বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্যে মাঠে নেমেছেন। এখানে তাদের বিদ্বেষ ছড়ানোর আরও উদাহরণ দেয়া যেতো। সেটা প্রাসঙ্গিকও হতো। কিন্তু সেই ছোট্ট গবেষণাটি আমার পাঠকের জন্যেই রেখে দিলাম। কারণ তার হাতের কাছেই ইন্টারনেট। আমি যা দেবো, এক ক্লিকেই তিনি তার ১০গুণ বেশি দেখে নিতে পারবেন।
যাই হোক। যে কেউ একটি সরকার বা মত, দর্শন কিম্বা ব্যক্তির বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারেন। লিখে, বলে, অবস্থান নিয়ে বা যে কোন উপায়ে এর প্রতিবাদ করতে পারেন। তিনি তার মতের পক্ষে জনমত গঠন করতে পারেন। খুব কড়া যুক্তি দিয়ে, তথ্য দিয়ে সমালোচনা করতে পারেন। ধরা যাক একটি রাজনৈতিক দল একটি দেশের সরকার পরিচালনা করছে। পরিচালনা করতে গিয়ে তারা কিছু অনিয়ম করছে। যার প্রভাবে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। কেউ যদি এর সালোচনা করতে চান, তাহলে তিনি সেই অনিয়ম নিয়ে কথা বলবেন। নিয়মটা কী হওয়া উচিত সেটাও বলবেন প্রকাশ্যে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নিজের মত প্রতিষ্ঠায় তারা আর যাই করুণ বিদ্বেষ ছড়াতে পারবেন কী? কারণ বিদ্বেষ ছড়ালেই তো প্রশ্ন উঠবে কাজটি তিনি কেন করছেন? উদ্দেশ্য কী? নানা আপত্তি উঠবে। গুতেরেসের এত কথা বলার পর সেই আপত্তি, আর কারও ব্যক্তিগত আপত্তি নেই। হয়ে গেছে সভ্যতা রক্ষার আপত্তি। পাঠক ভাবুন, বিদ্বেষের মত ভয়ঙ্কর বিষ ছড়ানোর দরকার হয় কখন? যখন একটি সত্যের ওপর মিথ্যার প্রলেপ দেয়ার দরকার। আর বিদ্বেষ ছড়িয়ে যদি দুর্বৃত্ত সফল হয়ে যায় সেই প্রলেপযুক্ত মিথ্যাটি বর্তায়, যাদের মধ্যে সেটি ছড়িয়েছে, তাদের ওপর। যেটা ওই মানব গোষ্ঠীর জন্যে বছরের পর বছর কাঁধে বয়ে বেড়ানোর শঙ্কা তৈরি হয়।
কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর তথ্য হচ্ছে, আমরা চাইলেই এখনই এই বিদ্বেষ ছড়ানো বন্ধ করতে পারবো না। অনলাইনে তো আরও না। জাতিসংঘের বার্তা অনুযায়ী কাজ চলছে প্রতিরোধের। কিন্তু কবে নাগাদ মানুষ এই বিদ্বেষ বার্তা থেকে সুরক্ষা পাবে তা এখনও নিশ্চিত নয়। তাহলে উপায় কী? এরকম চলতেই থাকবে? ততদিনে যে ক্ষতি হবে এর দায় কে নেবে? সুতরাং আমাদের বিদ্বেষ ছড়ানো বন্ধের তাৎক্ষণিক সমাধান চাই।
আমি প্রচলিত গণমাধ্যমে কাজ করছি ২৫ বছরের বেশি। আমার চিন্তা বলে, এই বিদ্বেষ নিয়ে প্রথম প্রতিরোধটা আসা উচিত প্রচলিত গণমাধ্যমের কাছ থেকে। কোন বার্তা ছড়ালেই সেটা সমাজের জন্যে বিদ্বেষ কী না তাদেরকেই প্রথম চিহ্নিত করতে হবে। কারণ তারা ওই সমাজের মানুষ নিয়েই কাজ করে। সামাজের আদি নাড়ি নক্ষত্র তাদের জানা। আমি যুদ্ধে নামতে বলি না। শুধু বলি বিদ্বেষটা কেন ছড়ানো হলো? কে ছড়ালো? কী ভাবে ছড়ালো? কিসের বিনিময়ে ছড়ালো ? সত্যটা কী? এরকম কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেই হবে। মাধ্যমটা যেহেতু “গণ” সেহেতু “গণ” এর প্রতি তাদের একটা দায় আছে বৈকী?
তবে ইচ্ছে থাকলেও গণমাধ্যমের পক্ষে অনেক সময় এই দায় নেয়া অসম্ভব হতে পারে। কারণ একটি গণমাধ্যমে কিছু প্রচার হতে হলে, প্রমাণ অপ্রমাণের বিষয় থাকে। তথ্য সূত্র লাগে। পক্ষ বিপক্ষ লাগে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মত সে চাইলেই কিছু একটা লিখে দিতে পারে না। যে কারণে অনেক বিষয় সত্য বুঝতে পারলেও, সে সত্য প্রকাশ করতে পারে না। এক্ষেত্রে শেষ ভরসা সমাজের মানুষ। আমি মানুষের বোধের ওপর সবচেয়ে বেশি ভরসা করি। তাই যেসব মানুষ দাবি করেন, তাদের বোধ শক্তি প্রখর তাদেরই বিদ্বেষ রোধে এগিয়ে আসতে হবে। আমি তাকেও যুদ্ধে নামতে বলি না। শুধু বলি, আগে নিজে বিষয়টি বুঝুন এবং যিনি বোঝেন না তার সঙ্গে আলোচনা করুন। জাতিসংঘও কিন্তু বিদ্বেষ ছড়ানো বন্ধের জন্যে মিডিয়া লিটারেসি বা গণমাধ্যম স্বাক্ষরতার কথা বলছে। এই মিডিয়া লিটারেসি আসলে বোধ সম্পন্ন মানুষের সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া আর কিছু নয়।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।