একটা অ্যাম্বুল্যান্স গুরুতর অসুস্থ একজন মানুষকে নিয়ে ছুটে চলছে। জীবন-মরণের ব্যারোমিটার উঠছে আর নামছে। তবু বেঁচে থাকার লড়াইটা নিজের মতো করেই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ঠিক নিজের জন্য এই বেঁচে থাকা নয়, সংসারের জন্য বেঁচে থাকার চেষ্টা, দায়িত্বের মতো কঠিন ভার বহন করার জন্য মরণপণ যুদ্ধ।
মানুষ কখনো কখনো নিজের জন্য বাঁচে না, সংসারের প্রিয় মুখগুলোর জন্য বাঁচে। সেই বাঁচার আকুতি কতটুকু আমাদের কানে পৌঁছে। সব যে এখন স্বার্থের প্রাচীরে বন্দি। সত্য বলতে গেলেই মিথ্যারা দাঁড়িয়ে যায়।
মানবিক চিন্তা হারিয়ে যায় কারো কারো স্বার্থপর চিন্তায়। সেই মানুষের কথাই ভাবছি, যে মানুষ একটা সংসারের বোঝা টানছে। টানাপড়েনের সংসার, তার পরও ছেলেমেয়ে, বউ-মা-বাবা, ভাই।
ভাবনাটা কাল্পনিক কিংবা বাস্তব দুই-ই হতে পারে। তবে ভাবনাটা তখনই থেমে যায়, যখন ক্ষমতার লোভ মানুষের জীবনের চেয়ে নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখে। দেশ ও মানুষের স্বার্থের চেয়ে যেখানে ক্ষমতার লড়াইটা বেশি প্রাধান্য পায়। অ্যাম্বুল্যান্সটা থেমে গেছে, রাস্তাজুড়ে মিটিং-মিছিল, রাজনীতির বড় বড় নেতার বড় বড় বুলি আওড়ানোর প্রতিযোগিতা চলছে। অথচ উত্তাল নগরীর নিষ্প্রাণ নেতারা মানুষের বড় বড় অধিকারের সত্য-মিথ্যা কথা বললেও অ্যাম্বুল্যান্সের মধ্যে একজন মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার লড়াইটা দেখতে পাচ্ছেন না।
রাজপথ বন্ধ করে রাজনীতি করলে রাজনীতিবিদদের হয়তো লাভ আছে, কিন্তু অ্যাম্বুল্যান্সের মধ্যে যে মানুষটা আছে, তার হারানোর আছে অনেক কিছুই। যদি মানুষটা মারা যায়, পুরো সংসারই তার তলিয়ে যাবে অনিশ্চয়তার অতলে। কিন্তু কে শুনবে কার কথা, কে বুঝবে সাধারণ মানুষের কথা? সাধারণ মানুষ সারা জীবন রাজনীতির গিনিপিগে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। কিন্তু মানুষকে ব্যবহার করার মাধ্যমে পুরনো দাস প্রথা ফিরিয়ে আনার এক ধরনের চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। রাজপথে মিটিং, মিছিল, অবরোধ, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করে রাজনীতিবিদরা নিজেদের রাজা ভাবেন, সাধারণ মানুষকে প্রজা ভাবেন। রাজনীতিবিদদের সমস্যা এখানেই, তাঁরা মানুষের মন বুঝতে পারছেন না। আধুনিক যুগে এমন রাজনীতি যে অচল তার শিক্ষাও তাঁরা নিচ্ছেন না। এর ফলে রাজনীতি ক্রমাগত অসুস্থ হচ্ছে, প্রকৃত স্বকীয়তা হারাচ্ছে।
ভাবছি দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের কথা। রাজপথে মিটিং-মিছিলের নাম করে রাজপথ দখলে রাজনীতিবিদদের নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়িত হলেও দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের জীবনের লড়াইটা থেমে যায়। তাদের অসহায় মুখগুলোর দিকে কারো কি তাকানোর সময় আছে? উত্তর একটাই, সময় নেই। রাজনীতি যে এখন মানুষের জন্য নয়, রাজনীতি এখন মানুষকে রাজপথে অবরোধ করে রেখে ক্ষমতায় যাওয়ার একটা কৌশল মাত্র। রাস্তাঘাট বন্ধ করে রাজনীতি করার মাধ্যমে নিজেদের সফল দেখানোর চেষ্টা কোনো রাজনীতি নয়, বরং মানুষকে জিম্মি করে মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাত্রা অচল করে দেওয়ার নেতিবাচক প্রয়াস। রাস্তাঘাট বন্ধ করে হয়তো নিজেদের মিথ্যা অহংকারের লোক-দেখানো প্রতিফলন ঘটানো যায়, কিন্তু মানুষের অন্তরে প্রবেশ করা যায় না। মানুষের অন্তরে প্রবেশ করতে গেলে মানুষের জন্য কাজ করতে হয়, মানুষের অনুভূতি বুঝতে হয়, ত্যাগের রাজনীতির মাধ্যমে মানুষের ভেতরে নিজেদের জায়গা করে নিতে হয়। কিন্তু সব যেন মরীচিকা, মিথ্যার বেসাতি।
সাধারণ মানুষ এখন স্থিতিশীল রাজনীতিতে বিশ্বাসী। স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু যে স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থার কথা ভেবেছিলেন এবং তা বাস্তবায়নে কাজ করেছিলেন, দুঃখের বিষয় হলো, সেই স্থিতিশীল রাজনীতির কথা স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও আমাদের বলতে হচ্ছে। সবাইকে মনে রাখতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন আমরা দেখছি, তখনই তা বাস্তবায়িত হবে, যখন রাষ্ট্র একটি স্থিতিশীল কাঠামোর ওপর শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারবে।
রাজপথে অস্থিরতা সৃষ্টি করে শিক্ষা, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ রাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কার্যক্রমগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করার কৌশলে সাধারণ মানুষ বিশ্বাসী নয়। আমরা মাঝেমধ্যে যেকোনো বিষয়ে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে উদাহরণ হিসেবে টেনে আনি। তাদের রাজনীতিবিদদের জনসম্পৃক্ত কাজগুলো দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করি। তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম কখনোই আমাদের দেশের মতো সাধারণ মানুষকে অবরোধ করে হয় না সেটাও আমরা উল্লেখ করি। কিন্তু তার কতটুকু প্রতিফলন আমাদের রাজনীতিবিদরা দেখাতে পারেন, সেটা হয়তো প্রশ্নবিদ্ধ। উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে সরকারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিরোধী দলগুলো ছায়া সরকার গঠন করে। সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমকে তারা প্রশংসিত করে, সরকার কোনো কাজে ভুল করলে সেটি কিভাবে করা গেলে ভালো হতো তার পথ বাতলে দেয়। অথচ আমাদের দেশে ঠিক এর উল্টোটি ঘটে। সরকার যতই ভালো কাজ করুক না কেন, সেগুলোকে কতটা ছোট করে দেখানো যায় তেমন এক ধরনের ভারসাম্যহীন প্রতিযোগিতা চলে। এর সঙ্গে গুজব, মিথ্যাচার, অপপ্রচারের মতো নেতিবাচক বিষয়গুলোও থাকে।
সরকারের ভালো কাজে সমর্থন এবং যে কাজগুলো সঠিকভাবে হচ্ছে না তার গঠনমূলক সমালোচনা করার মতো মানসিকতা রাজনীতিবিদদের মধ্যে থাকতে হবে। রাজনীতি হতে হবে কল্যাণমুখী ও জনবান্ধব। জ্বালাও-পোড়াও-সন্ত্রাস এ বিষয়গুলো সাধারণ মানুষ কখনো ভালো চোখে দেখে না—এ বিষয়গুলো রাজনীতিবিদদের বুঝতে হবে। রাজপথ বন্ধ করে নয়, বরং রাজপথ উন্মুক্ত রেখেই রাজনীতিবিদদের গঠনমূলক রাজনীতি করতে হবে। এ বিষয়ে রাজনীতিবিদদের সর্বোচ্চ সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকতে হবে, নিজেদের ভুলের কারণে রাজনীতি যাতে গণতান্ত্রিক ধারা থেকে বিচ্যুত হতে না পারে সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, কভিডের মতো মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিন-ইসরাইলের অস্থিরতা সারা পৃথিবীতে যে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা নিয়ে এসেছে তার প্রভাব আমাদের দেশেও এসে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকার সেটি কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। রাষ্ট্রের বহুমুখী উন্নয়নের কার্যক্রমও অব্যাহত রেখেছে। রাজনীতিবিদদের এ বিষয়গুলো ভেবে দেখতে হবে। দেশের স্বার্থে জনগণের দুর্ভোগ হয় এমন কার্যক্রম থেকে নিজেদের বিরত রেখে গঠনমূলক ও বাস্তবমুখী রাজনীতির ধারণা দ্বারা নিজেদের প্রভাবিত করতে হবে। অন্যদিকে দুর্নীতি, অর্থপাচার রোধ ও সামাজিক সুরক্ষার মতো বিষয়গুলো সরকারকে বিবেচনায় আনতে হবে। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রের স্বার্থের চেয়ে আর কোনো কিছুই বড় নয়।
কেউ কেউ রাজনীতির নামে অপরাজনীতির চর্চা করে যাচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণ নয়, বরং গণতান্ত্রিক ধারাকে ব্যাহত করা | নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব, কিন্তু সেটি তাদের কর্মকান্ডে ফুটে উঠছেনা, তারা সংবিধান অনুসরণ করে নির্বাচনে যেতে ভয় পান, সংলাপে বসার আগেই শর্ত জুড়ে দেন, একটার পর একটা আল্টিমেটাম দিয়ে গণতান্ত্রিক ধারার বিপরীতে অবস্থান নেন |
এসব দেখে মনে হচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্য নির্বাচন নয়, বরং উন্নয়নের যে ধারা বজায় রয়েছে তাকে রুদ্ধ করে দেওয়া | দেশের জনগণ এখন এগুলো খুব ভালো করেই বুঝে, এতে করে সভা-সমাবেশ করেও সেখানে তারা সাধারণ মানুষদের সম্পৃক্ত করতে পারছেনা | বরং তাদের এ ধরণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যবিহীন আন্দোলনে সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে | না আছে তাদের যোগ্য নেতৃত্ব, না আছে দেশের প্রতি তাদের মায়া, ক্ষমতায় যেন তাদের কাছে মুখ্য বিষয় | এদের সাথে যারা রাজনীতিতে একসময় যুক্ত ছিলেন, তারাও ভুল বুঝতে পেরে বেরিয়ে আসছেন, কর্মীরাও বুঝতে পারছেন, এতদিন যাদের পিছনে তারা ছিলেন, তারা দেশের চেয়ে নিজেদের স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে |
স্থিতিশীলতার মাধ্যমে উন্নয়নের দর্শন মানুষকে এখন আরও বাস্তবমুখী ও জীবননির্ভর করে তুলেছে, এতে করে এদের লোভ, ঈর্ষা, ধ্বংস ও ক্ষমতার রাজনীতি ক্রমশ: জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে | মানুষ তাদের অতীত দেখেছে, অতীতে তারা নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটালেও জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাননি | বরং সাধারণ মানুষ তাদের অত্যাচার, শোষণ ও নিপীড়ণের সম্মুখীন হয়েছে | দেশের প্রতি তাদের মায়া-মমতার প্রতিফলন তারা ঘটাননি, বরং দেশকে কিভাবে পরনির্ভরশীল রেখে স্বাধীনতার চেতনাকে নির্মূল করা যায়, সেটি তারা করেছে | তাদের কাছে জনগণের চাওয়া-পাওয়ার আর কিছু নেই, বরং তারা জনগণের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে | এসবের জন্য তারাই দায়ী, তাদের রাজনীতির আদর্শ নেই, দর্শন নেই, বরং রাজনীতির মুখোশ পরে মানুষকে খেয়ে ফেলায় যেন তাদের মূল লক্ষ্য | জনগণ এসব চায়না, তারা এদের থেকে সব সময় দূরেই থাকতে চায়, আদর্শ ও দর্শনের রাজনীতিকে শক্তি করে দেশের ক্রমাগত উন্নয়নের ধারায় নিজেদের অংশীদার হিসাবে দেখতে চায় | কারণ দেশ স্থিতিশীল থাকলে, মানুষ এগিয়ে যাবে, অর্থনীতি এগিয়ে যাবে, উৎপাদনের চাকা ঘুরবে |
লেখক: শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট ও লেখক। অধ্যাপক ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।