চট্টগ্রামে বহুল প্রত্যাশিত মাল্টিলেন আন্ডারওয়াটার এক্সপ্রেসওয়ে বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। আজ শনিবার সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীর পশ্চিম তীরে একটি ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। রোববার সকাল ৬টা থেকে থেকে যানবাহনের চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে।
এদিন তিনি আনোয়ারা নদীর দক্ষিণ তীরে আরেকটি ফলক উন্মোচন করবেন। বঙ্গবন্ধু টানেলে যা যা রয়েছে এই প্রকল্পের অধীনে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে ৪ লেনের সড়ক টানেল নির্মান করা হয়েছে।মূল টানেলে রয়েছে দুটি টিউব। যার দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার। এছাড়া টানেলের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দুটি সংযোগ সড়ক রয়েছে। সাথে রয়েছে ৭শ ২৭ মিটার দীর্ঘ একটি ওভার ব্রীজ। বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ কেন প্রয়োজনীয় ছিল কর্ণফুলী নদীতে তিনটি ব্রিজ নির্মিত হলেও অতি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য যথেষ্ট না। তিনটি
সেতু নির্মাণের ফলে ইতিমধ্যে পলি জমে কর্ণফুলী নদীতে নাব্যতা সংকট দেখা যাচ্ছে। যা চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য হুমকি। এ কারণেই সেতুর পরিবর্তে টানেল নির্মাণের উদ্যেগ বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা শহরের সঙ্গে ডাউন টাউনকে যুক্ত করে উন্নয়নকাজ ত্বরান্বিত করবে। স্বপ্নের এই টানেল চালু হলে কর্ণফুলী নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে সাংহাইয়ের মতো ওয়ান সিটি টুটাউন।
সাংহাইয়ের মতো ভৌগোলিক অবস্থা বন্দরনগরী চট্টগ্রাম এবং কর্ণফুলী নদীর ওপারের আনোয়ারা উপজেলার। এই টানেল মূলত দক্ষিণ চট্টগ্রামকে সারা দেশের সাথে সংযোগ করবে। কক্সবাজারের সাথে ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব কমাবে এই টানেল। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামগামী গাড়িগুলোকে আর বন্দরনগরীতে ঢুকতে হবে না। চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড হয়ে টানেলের মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। ফলে চট্টগ্রাম নগরে যানবাহনের চাপ কমে যাবে। টানেলকে ঘিরে চট্টগ্রাম-
কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পের আরও বিকাশ ঘটবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এই টানেল দক্ষিণ চট্টগ্রামে শিল্পকারখানা স্থাপনে উৎসাহিত করবে। ইতোমধ্যে আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেড আছে, চীনা অর্থনৈতিক জোনও শুরু হওয়ার পথে। সরকার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আনোয়ারায় বিশেষ অর্থনৈতিক জোন তৈরি করে দিচ্ছে। যার ফলে স্থানীয়দের ব্যাপক হারে কর্মসংস্থান হবে। বঙ্গবন্ধু টানেলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব এটি শুধু দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলবে না, এটির মাধ্যমে দক্ষিণ চট্টগ্রামের শিল্পকারখানাসহ অর্থনৈতিক বিপ্লব সাধিত হবে। টানেল চালু হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম-
কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হবে। কর্ণফুলী নদীর পূর্ব প্রান্তের প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং পশ্চিম প্রান্তের চট্টগ্রাম শহর, সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরের সঙ্গে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ স্থাপিত হবে৷ ফলে ভ্রমণ সময় ও খরচ হ্রাস পাবে৷ পূর্ব প্রান্তের শিল্প-কারখানার কাঁচামাল ও প্রস্তুতকৃত মালামাল চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর ও দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পরিবহন করা সহজ হবে।
মহেশখালী-মাতারবাড়ি এলাকায় দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর, কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি স্টেশনসহ জ্বালানিভিত্তিক বিপুলসংখ্যক দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে শিল্প-কারখানা নির্মাণের কাজ চলছে, এ টানেল সেগুলোর সঙ্গে পুরো বাংলাদেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করবে। গভীর সমুদ্র বন্দরের নির্মাণ কাজও এগিয়ে যাবে। আনোয়ারা এলাকার নির্মাণাধীন চায়না অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং গড়ে ওঠা কোরিয়ান ইপিজেডসহ অন্যান্য শিল্প-কারখানার সঙ্গে সুবিধাজনক যোগাযোগে এই টানেল ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
পর্যটন এলাকাগুলোর মধ্যে কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, বান্দরবানসহ পাহাড়, সমুদ্র ও নদীর এ ত্রিমাত্রিক নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সহজতর যোগাযোগ ব্যবস্থায় এ টানেল মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণের ফলে বেকারত্ব দূরীকরণ ও দারিদ্র্যদূরীকরণসহ দেশের ব্যাপক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। ট্রানজিট সুবিধা থাকায় বাংলাদেশ সরকার রাজস্ব আয় করবে এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে বাণিজ্যিক সর্ম্পক বৃদ্ধি পাবে।
জিডিপিতে ইতিবাচক প্রভাব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণের ফলে ফিন্যান্সিয়াল ও ইকোনোমিক আইআরআর-এর পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ৬ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং ১২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এছাড়া বেনিফিট কস্ট রেশিওর পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ১ দশমিক ০৫ এবং ১ দশমিক ৫। ফলে জিডিপিতে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, অর্থাৎ জিডিপি ১৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। শূন্য দশমিক ১৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। বঙ্গবন্ধু টানেল: মাতারবাড়ি সেভেন সিস্টার্স বিজনেস হাব
ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে শিলিগুড়ি করিডোর দিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় এই সাতটি রাজ্য সংযুক্ত। আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে সড়ক এবং আকাশপথ একমাত্র ভরসা। কিন্তু ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে সড়ক এবং আকাশপথে মালামাল পরিবহন ব্যয়বহুল। এই জন্য ভারত সরকার বাংলাদেশের সাথে ট্রানজিট চুক্তি করেছে মাতারবাড়ি ও
চট্টগ্রাম ব্যবহার করে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করার জন্য। ভারতের যে পরিমান পেট্রোলিয়াম এবং গ্যাসের মজুদ আছে তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ এই সাত রাজ্যে পাওয়া যায়। ভারতের অন্যান্য রাজ্যে গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম বঙ্গবন্ধু টানেল ব্যবহার করে মাতারবাড়ি ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে পরিবহন করা যাবে।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল আর বাংলাদেশের মধ্যে কানেক্টিভিটি তথা সংযোগ প্রসারের একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা নিয়েছে টোকিও– যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো একটি ‘সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল’ গড়ে তোলা। জাপানের অর্থায়নে বাংলাদেশের মাতারবাড়িতে যে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা হচ্ছে, সেখান থেকে ত্রিপুরার সাবরুম পর্যন্ত একটি মাল্টিমোডাল করিডর গড়ে তোলারও প্রস্তাব করেছে টোকিও। মাতারবাড়ি থেকে সাবরুম মাত্র ১৮০ কিলোমিটার দূরে। ফলে ওই পথে যদি ফোরলেন হাইওয়ে ও রেল সংযোগ গড়ে তোলা যায় তা গোটা অঞ্চলের জন্য ‘গেম চেঞ্জার’হিসেবে কাজ করবে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে।
জাপানের সহযোগিতায় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশের মধ্যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভ্যালু চেইন গড়ে তোলা হবে। এই মুহূর্তে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা দূর করতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ থেকে পাট আমদানির ওপর ভারত যে অ্যান্টি-ডাম্পিং ডিউটি বসিয়েছে তা তুলে নেওয়ার সুপারিশ করেছে তারা। কারণ, বাংলাদেশের পাট গুণ-মানে ভালো এবং পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরিতেও সহায়ক। ফলে এতে আখেরে ভারতেরও লাভ হবে। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বড় একটি ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে কানেক্টিভিটি। বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়ার পর থেকেই দুই দেশের কানেক্টিভিটি প্রকল্পগুলোয় গতি এসেছে। ভারতে আসামের নয়া ধুবড়ি থেকে মেঘালয়ের ফুলবাড়ি পর্যন্ত নির্মাণ হচ্ছে ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু। এ সেতু নির্মাণ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে জাপানি উন্নয়ন সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। এটি নির্মাণ হলে বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে ভারত হয়ে সড়ক চলাচল সহজ হয়ে আসবে।
প্রক্ষেপণ রয়েছে, সেতুটির নির্মাণকাজ শেষে সংশ্লিষ্ট সড়কটির ওপর দিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে চলাচলকারীর সংখ্যা গড়ে প্রায় ৩০ লাখে পৌঁছাবে। একই সঙ্গে বার্ষিক পণ্য পরিবহনের পরিমাণ দাঁড়াবে ১ কোটি ১৮ লাখটনেরও বেশিতে। এছাড়া ধুবড়ি থেকে ফুলবাড়ি পর্যন্ত যাতায়াতের পথ ৮ ঘণ্টা থেকে মাত্র ২৩ মিনিটে নামিয়ে আনবে সেতুটি। ধুবড়ি-ফুলবাড়ি সেতু নির্মাণ শেষ হলে এর দুই পাশে বাজার ও সেবা খাতের ব্যাপক প্রসার হবে বলে আশাবাদী খাতসংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে গ্রামীণ কৃষিপণ্যের বাজার, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান খাতেরও ব্যাপক উন্নয়নের প্রত্যাশা করা হচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে হলে বাংলাদেশকে শুধু উত্তর-পূর্ব নয়, গোটা ভারতের কথাই মাথায় রাখতে হবে। কানেক্টিভিটি তৈরি হলে ব্যবসার সুযোগ বাড়বে। এই কানেক্টিভিটি তৈরিতে বঙ্গবন্ধু টানেল ঈর্ষনীয় ভূমিকা পালন করবে। অর্থনৈতিক উন্নতিতে এর পরের ধাপগুলো নিশ্চিত করতে বেশ কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রস্তাবও দিয়েছে বাংলাদেশ। যেমন: ক) ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সব ধরনের শুল্ক ও অশুল্ক বাধা (ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার) নির্মূল করা। খ) মাতারবাড়ি বন্দর ২০২৭ সালে চালু হলে ভারতের ল্যান্ড-লকড (স্থলবেষ্টিত) উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য তা বঙ্গোপসাগরের দরজা উন্মুক্ত করে দেবে। ফলে সেই বন্দরের সঙ্গে উপযুক্ত সংযোগ গড়ে তোলার দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে।
২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। সুড়ঙ্গ নির্মাণে ব্যয় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং এর ঢাকা সফরে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তি অনুযায়ী চীনের এক্সিম ব্যাংক ২০ বছর মেয়াদি ঋণ হিসাবে দুই শতাংশ সুদে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিয়েছে। বাকি অর্থায়ন বাংলাদেশ সরকার করেছে। নদী সুড়ঙ্গটির নির্মাণ কাজ করছে চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। ২০২২ সালের মধ্যে সুড়ঙ্গটির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আগস্ট ২০২৩ পর্যন্ত নির্মাণ কাজ অব্যাহত ছিল৷ টানেলের প্রতি টিউবের প্রস্থ ৩৫ ফুট এবং উচ্চতা ১৬ ফুট। এছাড়া, দুটি টিউবের মধ্যবর্তী ব্যবধান ১১ মিটার। সুড়ঙ্গটির মূল দৈর্ঘ্য ৩.৪৩ কিলোমিটার। তবে এর সঙ্গে ৫.৩৫ কিলোমিটারের সংযোগ সড়ক যুক্ত হবে।