টাকা পাচারকারীদের জন্য অশনিসংকেত: প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারকে (পি কে) ২২ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। রবিবার এই রায়ের মধ্য দিয়ে টাকা পাচারকারীদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স অবস্থান আরেকবার ব্যক্ত হলো। এর আগে বিএনপি মহাসচিব (পলাতক) তারেক রহমান ও গিয়াস আল মামুম, জি কে শামীমসহ আরও বেশকিছু টাকাপাচারের মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। রবিবারের রায় পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় আইনজীবীরা বলছেন, একের পর এক পাচারকারীদের বিচারের মুখোমুখি করার মধ্য দিয়ে একটা বার্তা দেওয়া গেছে- অর্থ পাচারের মামলায় সরকার শক্ত অবস্থান নিতে সক্ষম হয়েছে এবং পাচারকারীদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
বাংলাদেশে ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে অর্থের অবৈধ ব্যবহারের বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি নেন প্রধানমন্ত্রী। ২০০০সালের পর থেকে অর্থের অবৈধ ব্যবহার নিয়ে প্রথম আইনটির নাম ছিল মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০০২ (২০০২ সালের ৭ নম্বর আইন)। এ আইনের বিধানাবলি অপর্যাপ্ত থাকায় ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ লক্ষ্যে একটি অধ্যাদেশ জারি করে (অধ্যাদেশ নম্বর ১২, ২০০৮) কিছু বিষয় যুক্ত করে। পরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার অধ্যাদেশটি সংবিধানের অনুশাসন অনুযায়ী পরীক্ষা করে ২০০৯ সালে আইনে রূপান্তরিত করে। ২০০৯ সালের আইনটিও পরে বাতিল করে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ অধ্যাদেশ ২০১২ জারি করা হয়, যা পরবর্তী সময়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ নামেই পরিচিত। এই আইনের মাধ্যমে এখন মামলা পরিচালনা করা হচ্ছে।
এই আইনে সাজা হয়েছে তারেকেরও
এর আগে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে দুদকের মামলায় তারেক রহমান ও তাঁর স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানকে সাজা দেয় ঢাকার সিনিয়র বিশেষ জজ আদালত ও মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান। রায়ে তারেককে ৯ বছর ও জোবাইদাকে ৩ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১ / ১১ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের ও ব্যবসায়ীদের আটক অভিযান চালানো হয়। এর অংশ হিসেবে তারেক রহমানকে ২০০৭ সালের ৭ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয়।
২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচারের একটি মামলায় ঢাকার একটি বিশেষ জজ আদালত তারেক রহমানকে খালাস দেন। ওই মামলায় তারেকের বন্ধু ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তারেক রহমানকে খালাস দেওয়ার রায়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) হাইকোর্টে আপিল করেন। ওই আপিল শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১৬ সালের ২১ জুলাই বিচারিক আদালতের খালাসের রায় বাতিল করে তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন। পাশাপাশি ২০ কোটি টাকা জরিমানা করেন।
বিচার করা গেছে জি কে শামীমের
গত জুলাই মাসে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় ১৯৫ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগের মামলায় ঢাকার একটি আদালত বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা জি কে শামীমকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়- অস্ত্রবাজ, টেন্ডারবাজ ও অর্থপাচারকারীদের কোনো আদর্শ নেই। তারা কোনো আদর্শকে লালন করে না। তবে আদর্শকে ব্যবহার করে রাতারাতিভাবে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে এবংদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়। তারা দেশ ও জাতির শত্রু। দেশের চলমান উন্নয়ন ও জাতীয় স্বার্থে তাদেরকে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করতে হবে।
২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দুপুরে নিকেতনের নিজ বাসা থেকে শামীমকে আটক করা হয়। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় নগদ ১ কোটি ৮১ লাখ ২৮ হাজার টাকা, আরও ৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকার বিদেশি মুদ্রা, শামীম ও তাঁর মা আয়েশা আক্তারের নামে ১৬৫ কোটি ২৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকার এফডিআর, মায়ের নামে আরও ৪৩ কোটি ৫৭ লাখ ৪০ হাজার টাকার ব্যবসার অংশীদার এবং জি কে বি অ্যান্ড কোম্পানির শেয়ার, গাড়ি ও এফডিআর বাবদ ৩৬ কোটি ৩৫ লাখ ১৮ হাজার ৭১৯ টাকার অস্থাবর সম্পদের বৈধ উৎস পায়নি দুদক। অনুসন্ধানে শামীমের মায়ের বৈধ আয়ের উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ, মোট ২৯৭ কোটি ৮ লাখ ৯৯ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের সন্ধান পাওয়া যায়।
টাকা ফেরত আনতে প্রধানমন্ত্রী আত্মবিশ্বাস
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকার বিভিন্ন দেশে বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) নেতাদের পাচার করা অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, “বিএনপির অনেক নেতার টাকা (বিদেশি ব্যাংকে) জমে আছে। আমরা ধীরে ধীরে এগুলো ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। গত জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের বৈঠকে বক্তব্য প্রদানকালে এসব কথা বলেন। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার পরিবারের দুর্নীতির সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, সড়ক খাতে দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক বিএনপির শাসনামলে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। খালেদা জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার আগেই বিদেশিরা এবং একজন এফবিআই এজেন্ট তারেকের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলায় সাক্ষ্য দেন। শেখ হাসিনা বলেন, তাদের (তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো) বিদেশে পাচার করা অর্থ থেকে সরকার ৪০ কোটি টাকা ফেরত নিতে পেরেছে। কিন্তু সমস্যা হলো তারা টাকা যে দেশে জমা করেছে, সেখান থেকে টাকা ফেরত আনা একটি কঠিন বিষয়। দেশগুলো টাকা ছাড়তে চায় না।
অর্থপাচারের হাব সিঙ্গাপুরও নড়েচড়ে বসেছে এবার। বিভিন্ন দেশ থেকে অবৈধ অর্থের প্রবাহ রোধ করতে অভিবাসনবিষয়ক নিয়মনীতি আরও কঠোর করা হতে পারে বলে জানানো হয়েছে। সম্প্রতি দেশটির পার্লামেন্টে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেকেন্ড মিনিস্টার জোসেফিন টেও বলেছেন, অভিবাসনবিষয়ক যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া কীভাবে আরও কঠোর করা যায়, তা মূল্যায়ন করা হবে। সিঙ্গাপুরের সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর অনুসারে গত মঙ্গলবার পার্লামেন্টে মিনিস্টার জোসেফিন টেও বলেন, সিঙ্গাপুর অর্থ পাচারের ঘটনা গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। অর্থ পাচারের বিষয়ে এবারই আমরা প্রথম কোনো আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছি তা নয়। আর এটা শেষ ঘটনাও হবে না।