গণমাধ্যমে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা- চালুনি চোখ রাঙায় সুঁইরে
বাংলার ঘরে চালুনি আর সুঁই কে না চেনেন। কথায় আছে শতছিদ্রওয়ালা চালুনি ঠাট্টা করে সুঁইয়ের একটা ছিদ্র নিয়ে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ওপর ভিসানীতি আরোপ নিয়ে রাস্ট্রদূত পিটার হাসের যে কড়া আলাপ, তা সেই প্রবাদ বাক্য মনে করিয়ে দেয়।
সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যমও যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে। এরপর বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিক নেতা, সংগঠন, গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্বেগ লক্ষ্য করা যায়। সম্পাদকদের সংগঠন এডিটর্স গিল্ড বাংলাদেশ পিটার হাসকে এক চিঠি পাঠিয়ে গভীর উদ্বেগও জানায় ।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর ‘এডিটর্স গিল্ড বাংলাদেশ’ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে তার বক্তব্যের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে চিঠি পাঠায়। ৩ অক্টোবর পিটার হাস সেই চিঠির উত্তর দেন। তার চিঠির বাংলা অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায় তাহলো, এডিটর্স গিল্ড থেকে চিঠি দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। সম্প্রতি চ্যানেল ২৪-এ এক সাক্ষাৎকারে আমার দেওয়া বক্তব্যকে আরও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরার সুযোগের প্রশংসা করছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের অধিকার এবং বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের বাকস্বাধীনতা রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ যেকোনও সরকারের সমালোচনামূলক মতামত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
সেক্রেটারি ব্লিঙ্কেন ২৪ মে ভিসা নিষেধাজ্ঞা নীতি নিয়ে বলেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে সবার দায়িত্ব রয়েছে—ভোটার, রাজনৈতিক দলগুলো, সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যমসহ সবার। সমানভাবে এটি গুরুত্বপূর্ণ যে এসব প্রতিষ্ঠান যেন গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে।
সেক্রেটারি ব্লিঙ্কেন নীতিটি সম্পর্কে যোগ করে বলেছেন, এটি যেকোনও বাংলাদেশি ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যাকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা হবে।
এর মধ্যে যে কেউ অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, যারা গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখার পদক্ষেপ নেয় এবং যদি সেই পদক্ষেপগুলো গণতান্ত্রিক নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সরকার যখন তাদের রিসোর্স এবং সংস্থাকে ব্যবহার করে সেন্সরশিপ, ইন্টারনেট সংযোগকে সীমাবদ্ধ ও সাংবাদিকদের হয়রানি করবে, তখন আমরা আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে থাকবো।
‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে। যারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করতে চায় তাদের বিরুদ্ধেও আমরা কথা বলবো এবং আমাদের ভিসানীতি প্রয়োগ করবো।’
পিটার হাসের চিঠির কথা জানিয়ে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এডিটর্স গিল্ড জানায়, ‘বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এবং তাদের রাষ্ট্রদূতের অবস্থানের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে চায়। কারণ, তারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হিসেবে সুপরিচিত।’
মিডিয়ায় যারা কাজ করেন তাদের উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক। গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। প্রশ্ন করা জরুরি, গণমাধ্যম কী কী ভাবে ভোটকে প্রভাবিত করবে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে। এর মাপকাঠি তারা কিসের ভিত্তিতে তৈরী করেছে? সেই জায়গা থেকে গণমাধ্যমকর্মীদের ব্যাখ্যা চাওয়ার অধিকার আছে।
যে আমেরিকা বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে চোখ রাঙায় তার নিজের দেশে সে কীভাবে মিডিয়াকে ব্যবহার করে- তার বহু নজির তারা সারা বিশ্ব রাজনীতিতে ছড়িয়ে রয়েছে।
মনে নেই কি কারো, সাবেক স্টেট সেক্রেটারি ও ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে ২০১৬ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার নির্বাচনে মার্কিন গণমাধ্যম বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করেছিল। অনেকেরই ধারনা ছিল ট্রাম্প জয়লাভ করবেন না, জনপ্রিয়তার দিক থেকে হিলারি ছিলেন এগিয়ে। বলা হয়, ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া বিতর্কিত ভুমিকা পালন করেছে।
বলা হয়ে থাকে ‘ঐতিহ্যগত’ ভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে গণমাধ্যম প্রভাব বিস্তার করে। ১৯৬০ সালের নির্বাচন থেকে এই প্রথা প্রচলিত। কারণ প্রার্থীর খবর যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ গণমাধ্যম থেকেই বেশি পেয়ে থাকে। একজন প্রার্থীর বিষয়ে কীভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, কতটুকু করা হচ্ছে তার প্রতি নাগরিকদের আলাদা দৃষ্টি থাকে। আর সেই দৃষ্টি থেকেই মার্কিন গণমাধ্যমের এই খোলামেলা অবস্থান সবার নজরে আসে।
কিংবা ধরুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বুশের প্রথম পর্বের সামরিক মন্ত্রী কলিন পাওয়েল যখন জাতিসংঘের মতো একটি সংস্থায় সবিস্তারে বর্ণনা করেন যে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের জিম্মায় এমন সব মারাত্মক অস্ত্র আছে যা দিয়ে পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেয়া সম্ভব, সাদ্দাম হোসেনের পতন না ঘটালে সারা দুনিয়া এক ভয়াবহ পরিনতি ভোগ করবে। সমগ্র বিশ্ব এই প্রচারনায় মেতে উঠলো যে ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের কাছে “ওয়েপন অফ ম্যাস ডেসট্রাকশন” নামের এক মারাত্মক অস্ত্র আছে এবং এই অস্ত্রের একমাত্র টারগেট পশ্চিমা বিশ্ব। জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শক দল ইরাকে এমন কোনো অস্ত্রের সন্ধান পাননি, কিন্তু তাঁর পরেও আমেরিকা ও ইংল্যান্ড মিলে ইরাক আক্রমন করলো যার ভয়াবহ পরিনতির কথা আজ আমরা সকলেই জানি। সম্পূর্ণ ভুল ও বানোয়াট তথ্যের উপরে ভিত্তি করে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম আধুনিক জনপদ ইরাককে ধ্বংস করে দেয়া হয়। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু ও কয়েক কোটি মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার কথা আমরা সকলেই জানি।
নোম চমস্কি তাঁর লেখায় তথ্য উপাত্ত সহ ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের নিজেদের বানানো বয়ান কে বাস্তবতা বলে প্রচার করে এবং এই সকল বয়ানের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সমগ্র পৃথিবীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দখল নেয়া। সমগ্র পৃথিবীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দখল নেয়াটা কখনও ঘটেছে সরাসরি যুদ্ধের মাধ্যমে, কখনও ঘটেছে কোনো দেশে গৃহ যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়ার মাধ্যমে, কখনও কোনো দেশে বা অঞ্চলে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে। আর এসবের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে গণমাধ্যমকে। চমস্কি দেখিয়েছেন কীভাবে প্রোপাগান্ডা মডেল বা রাষ্ট্র কিভাবে প্রোপাগান্ডা মেশিন গড়ে তোলে ও তাকে ব্যবহার করে জনগনের মাঝে এর বয়ানের স্বপক্ষে সম্মতি উৎপাদন করার জন্যে।
সেই আমেরিকা যখন বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে চোখ রাঙিয়ে বলে আভ্যন্তরীণ নির্বাচনে বিঘ্ন ঘটালে পড়তে হবে নিষেধাজ্ঞার আওতায় তখন বিস্ময় জাগে- আসলে কী নির্বাচনের জন্য তারা এসব বলছে? নাকি পিছনে বড় লুকায়িত কোনো স্বার্থ আছে, যা তারা ভয় দেখিয়ে অর্জন করতে চায়।
আরেকটা অতি প্রচলিত গল্প দিয়ে শেষ করি, একদিন এক বৃদ্ধার সন্তান মহানবী (সাঃ) কে বললেন তার মায়ের বহুমূত্র রোগ আছে। তাকে মিস্টি খেতে যেনো নবীজী নিষেধ করে দেন। মহানবী চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ, তারপর সে সন্তানকে কিছুদিন পরে আসতে বললেন। সেই নির্ধারিত দিনে ছেলে তার মাকে নিয়ে গেলে নবীজি মাকে বুঝিয়ে বলেন কেনো তার মিস্টি খাওয়া ঠিক না। ছেলেটি তখন বললো- হে নবী, আপনি সেইদিনই কোনো কাজটি করলেন না। উত্তরে তিনি বলেছিলেন- সেসময় আমি নিজে মিস্টি খেতাম। সেদিনের পরে আমি নিজে মিস্টি খাওয়া ছেড়েছি। তারপর আমি মাকে ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছি। আমেরিকা নিজে যা করে তার একভাগও করেনি এমন দেশকে চোখ রাঙায় কেবল মোড়লি জিইয়ে রাখতে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।