২০০১ সালের রামশীল যেন একাত্তরের শরণার্থী শিবির
বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন মানেই অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এখন আতঙ্কের আরেক নাম। দুরারোগ্য অসুখের মতো বাংলাদেশের বুকে লেগে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এমনিতেই সারা বছর হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের জীবনের বিশেষ দিনগুলোতেই অত্যাচার অব্যাহত রাখে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন এলে তাদের জীবন-সম্ভ্রম-সম্পদের ওপর নেমে আসে জামায়াত-বিএনপি সিন্ডিকেটের হিংস্র কার্যকলাপ। বিশেষ করে ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তো রীতিমতো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের সম্পদ লুট, হত্যা, ধর্ষণ, চাদাবাজি চলেছে। সেই কালযুগের ভিক্টিমরা আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে আবার আতঙ্কিত।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর দেশের দক্ষিণাঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্তদের ওপর চালানো আক্রমণ থেকে বাঁচতে প্রায় ২০ হাজার মানুষ রামশীলে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। এটি গোপালঞ্জের কোটালীপাড়ায় ১২টি ইউনিয়নের একটি রামশীল। বাগেরহাট বরিশালের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সেদিন কোটালীপাড়ার রামশীলকেই নিরাপদ ভেবে আশ্রয় নিয়েছিল। এক কাপড়ে ভিটেমাটি ছেড়ে বের হয়ে যেতে বাধ্য হওয়া কপর্দকশূন্য মানুষগুলোর পাশে সেদিন রামশীলের মানুষ নিজেদের সর্বস্ব নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিএনপি-জামায়াতের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার ওই জনগোষ্ঠীকে সাধ্যমত সাহায্য করেছিলেন রামশীলবাসী। ইউনিয়নটি পরিণত হয়েছিলো ১৯৭১ সালের মতোই এক শরণার্থী শিবিরে। যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও আলোচিত হয়েছিল।
২০০১ সালের ৪ অক্টোবর রামশীলে ঘরহারা নির্যাতিত মানুষ আসতে শুরু করে বানের জলের মতো। তখনকার সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, উজিরপুর, বাগেরহাটের মোল্লাহার এলাকা থেকে হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমান নির্যাতিতরাও হাজারে হাজারে রামশীল ইউনিয়নে এসে আশ্রয় নিয়েছিলো। বাস্তুচ্যুত এসব হতভাগ্যদের মধ্যে অনেক ধর্ষিত নারী ছিলেন বলে সেই সময়ের গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। নির্যাতিতরা কোনোপ্রকার চিকিৎসাসেবা না পেয়েই প্রাণ হাতে এলাকা ত্যাগ করেছিলেন সেদিন। কারণ নির্বাচনে জেতার পর বিএনপির নির্বাচিতরা সেখানে সরকারি-বেসরকারি সব সাহায্য পাবার পথ বন্ধ করে দিয়েছিল।
বাগেরহাটে ২০০১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে বাগেরহাট-১ (চিতলমারী-মোল্লাহাট-ফকিরহাট) ও বাগেরহাট-২ (সদর-কচুয়া) আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ হেলাল উদ্দিনের নির্বাচনী জনসভায় বোমা বিস্ফোরণে জনসভায় আসা আট জন নারী-পুরুষ নিহত হন। ভয়ঙ্কর এই ঘটনায় জড়িত ছিল হরতাকুল জিহাদ এবং বিএনপি জামায়াতের স্থানীয় নেতারা। নির্বাচনের পর ওই জেলার মোল্লাহাট উপজেলার জয়ঘা, চাঁদেরহাট, মাদারতলি, বুড়িগাংনি, বড়গাওলা, চাঘদা আক্রান্ত হয়। বেছে বেছে এই গ্রামগুলোতে তাণ্ডব চালানোর কারণ, এগুলো হিন্দু অধ্যুষিত।
বাগেরহাটের পাশাপাশি বরিশালও সহ্য করেছে ২০০১ সালের জামায়াত-বিএনপির নৃশংসতা। বরিশালের গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, উজিরপুর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং হিন্দু সস্প্রদায়ের মানুষজনের ওপর চালানো বর্বরতা সারা পৃথিবীতে সমালোচিত হয়েছিলো। ২০০১ সালে বিএনপির চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা আগৈলঝাড়ার বাশাইলের ইউপি সদস্য আলাউদ্দিন মোল্লাকে অপহরণ করে হত্যা করে। সরকারি গৌরনদী কলেজ ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক সফিকুল ইসলাম বুলেটকে গৌরনদী বন্দরে দিনের বেলাতেই ইট দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। বরিশাল নগরীর আমানতগঞ্জ এলাকার ছাত্রলীগ নেতা মাসুম সিকদারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
২০০১ সালে জামায়াত-বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের কর্মীবাহিনীর অত্যাচারের শিকার হয় বরিশালের গৌরনদী উপজেলার ধানডোবা গ্রামের ৩০টি, চাঁদশী গ্রামের ২০টি, খাঞ্জাপুর গ্রামের ১৫টি, বিল্লগ্রামের ২৫টি, ইল্লা গ্রামের ৫টি, গেরাকুল গ্রামের ৫টি এবং আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার গ্রামের ৫০টি, বাহাদুরপুর গ্রামের ৩০টি, বাকাল গ্রামের ২৫টি, রামানন্দেরআঁক গ্রামের ২৫টি, পতিহার গ্রামের ৩০টিসহ কয়েকশত পরিবার। বিকৃত রুচির এসব সন্ত্রাসী হিংস্রতা থেকে বাঁচতে হিন্দু পরিবারগুলোর নারী সদস্যরা অধিকাংশই গোপনে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যাদের সেই উপায় ছিলো না, তারা বিএনপি সন্ত্রাসীদের কালো থাবা থেকে বাঁচতে রাতের আঁধারে নির্জন পুকুর কিংবা দিঘির মাঝখানে কলাগাছের ভেলা বানিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। গৌরনদীর বিভিন্ন গ্রামের অসংখ্য পরিবার নির্যাতনের শিকার হয়ে বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল।
রামশীলে আশ্রয় নিতে আসা অনেক শিশু নিয়মিত খেতে পায়নি। এক বাড়িতেই প্রায় ২০০ আহত ব্যক্তি চিকিৎসা নিয়েছে। অনেক ধর্ষিত নারীকে আত্মহত্যার পথ থেকে বুঝিয়ে নিবৃত্ত করা হয়েছে বলে পরবর্তীতে জানিয়েছেন রামশীলের মানুষ। বরিশাল এবং বাগেরহাট থেকে রামশীলে এসে জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাসীরা হামলা করতে পারে এমন আশঙ্কাও দেখা দিয়েছিলো। এমন ভয়াবহ বিপদ মোকাবেলা করতে সেখানে সেদিন গড়ে তোলা হয়েছিলো ২১ সদস্যের কমিটি। কিন্তু হতভাগ্য এসব মানুষ রামশীলেও স্বস্তি পায়নি। জামায়াত- বিএনপির স্থানীয় প্রশাসন বরিশাল-বাগেরহাটের ওইসব শরণার্থীকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যেতে চাপ দেয়া শুরু করে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী রামশীল আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শনের কথা দিয়েও যাননি।
২০০১ সালের ১২ অক্টোবর তৎকালীন গোপালগঞ্জ ও বরিশালের ডিসি, এসপি আসেন রামশীলের শরণার্থীদের খবর নিতে। তারাও অত্যাচারিত মানুষদেরকে নিজ গ্রামে ফিরে যেতে বলেন। কিন্তু যারা ফেরার চেষ্টা করেছে, তারা পথেই জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাসীদের হাতে মার খেয়েছে। সন্ত্রাসীদের তাড়া খেয়ে প্রাণ বাঁচাতে আবারও পালাতে হয়েছে তাদেরকে।
দলীয় অবস্থান থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রামশীলে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের পাশে ছিলো। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সময় ব্যক্তিগতভাবে অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন তাদেরকে।
ঘটনার ১০ বছর পর হিন্দু সম্প্রদায়, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশনের সদস্যরা ২০১০ সালের ১৭ এপ্রিল রামশীল ইউনিয়ন পরিদর্শন করেন। নির্যাতিত ব্যক্তিদের আশ্রয়দানকারীদের ১৪জন ব্যক্তি তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মো. সাহাবুদ্দিন আহম্মদ, সদস্য শহিদুল ইসলাম ও মনোয়ার হোসেনের কাছে সাক্ষ্য দেন। শুধুমাত্র হিন্দু হওয়ার কারণে নির্যাতিত মানুষের দুঃসহ স্মৃতি আজও রামশীলবাসীদের মনে দাগ কেটে আছে।