বিলম্বে হলেও আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৬৪ জেলাকে রেল নেটওয়ার্কে আওতায় আনতে কাজ শুরু করেছে সরকার। অথচ দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ও পুরনো যোগাযোগ মাধ্যম হলো রেলপথ। ১৯৬২ সালে ব্রিটিশ আমল থেকেই এ অঞ্চলে রেল যোগাযোগ শুরু হয়। এতোদিনেও সকল জেলায় রেল লাইন হয়নি, যা সত্যিই বিস্ময়ের। তবুও পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে ৪৩ থেকে ৪৭ জেলা রেল যোগাযোগে যুক্ত হয়েছে।
আগামী ১২ নভেম্বর দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। এরমধ্য দিয়ে রেল যোগাযোগে আরেকটি মাইল ফলক অর্জনের পথে বাংলাদেশ। সরকারের ফাস্টট্র্যাক প্রকল্পের একটি চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ। এর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে পর্যটন নগরী কক্সবাজারও আসছে রেল যোগাযোগের আওতায়। ঢাকা থেকে সরাসরি ট্রেনযোগে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত দেখতে যেতে পারবেন পর্যটকরা। যা সত্যিই আনন্দের খবর।
শুধু কি তাই? এ প্রকল্প চালুর মধ্য দিয়ে গোটা কক্সবাজারের অর্থনীতিতে আরো বেশি গতি ফিরবে। কারণ পর্যটক আগের চেয়ে অনেক বাড়বে। তেমনি তৈরি হবে কর্মসংস্থানের সুযোগ। কারণ এখানে শুধু সমুদ্র সৈকত আছে তা নয়, অন্তত ১৫টি পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে জেলাজুড়ে। এর সবকটিতেই পর্যটক উপস্থিতি বাড়বে, তা নিঃস্বন্দেহে বলা যেতে পারে। এই সুযোগটিকে সরকার কতোটুকু কাজে লাগিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবে তাই দেখার বিষয়।
কক্সবাজারের প্রাচীন নাম পালংকী। একসময় এটি প্যানোয়া নামে পরিচিত ছিল। প্যানোয়া শব্দটির অর্থ ‘হলুদ ফুল’। অতীতে কক্সবাজারের আশপাশের এলাকাগুলো এই হলুদ ফুলে ঝকমক করত। এটি চট্টগ্রাম থেকে ১৫৯ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। এ জেলায় রয়েছে প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন। সমুদ্র সৈকতের চেয়ে এ দ্বীপের প্রতি পর্যটকদের আকর্ষণ অনেকগুন। এর বাইরে রাবার বাগান, সোনাদিয়া দ্বীপ, রামকোট সহ বেশ কয়েকটি বড় ও আকর্ষণীয় বৌদ্ধ বিহার। পাশাপাশি হিমছড়ি, রাবার স্টেশন, ডুলাহাজরা সাফারি পার্ক, মহেশখালী জেটি, কুতুবদিয়া বাতিঘর, আদিনাথ মন্দির, অজ্ঞামেবী ক্যং প্রভৃতি পর্যটন কেন্দ্র পর্যটকদের তালিকায় এগিয়ে। রেলপথ চালুর পর এর সবকটিতেই কমবেশি পর্যটক বাড়বে। এর বড় কারণ হলো, ট্রেন যাত্রা অনেকটাই আরামদায়ক। ভাড়া বিবেচনায় আকাশ ও সড়ক পথের চেয়েও অনেকক্ষেত্রে সাশ্রয়ি।
বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৫১টি দেশের পর্যটকরা বাংলাদেশে ভ্রমণ করবেন, যা মোট জিডিপিতে ১০ শতাংশ অবদান রাখবে। পর্যটনশিল্পের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ার রোল মডেল। পর্যটন ব্যবসায়ীদের সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) হিসাব অনুযায়ী, বছরে এখন ৫০ থেকে ৬০ লাখ মানুষ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যান। বছর পাঁচেক আগেও এ সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ লাখ ছিল।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে দেশের পর্যটন খাত। আর্থিক মূল্যে দেশীয় পর্যটন খাতের আকার দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ৪ হাজার কোটি টাকার। সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ২০ লাখ পর্যটককে আতিথেয়তা দেয় কক্সবাজার। বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় দুই শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালের মধ্যে পর্যটনশিল্পের সর্বোচ্চ বিকাশে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। পুরো দেশকে আটটি পর্যটন জোনে ভাগ করে প্রতিটি স্তরে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথমবারের মতো সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসাবে কক্সবাজারে পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণে ২৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলোয় প্রায় প্রত্যক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। পরোক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ১ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা।
মূলত পর্যটকদের সুবিধার্থে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণ করছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, জেলা শহর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর দৃশ্যমান আইকনিক রেল স্টেশন। ঝিনুকের আদলে তৈরি দৃষ্টিনন্দন এ স্টেশন ভবনটির আয়তন এক লক্ষ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয়তলা বিশিষ্ট স্টেশনটি নির্মাণে চীন, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। পুরো প্রকল্পটিতে ১১০ জন বিদেশিসহ মোট ২৫০ জন প্রকৌশলী এবং ছয় শতাধিক লোক কাজ করছে। চার বছরের শ্রমে আইকনিক রেলস্টেশন ভবনটি আজ সত্যিই চোখ জুড়ানো বাস্তবতা।
এশিয়ার প্রথম শতভাগ পর্যটনবান্ধব কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্টেশনে রয়েছে পর্যটকদের জন্য সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা। পর্যটকরা যেন কক্সবাজারে দিনে এসে ঘুরে আবার ফিরে যেতে পারেন, সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। স্টেশনে থাকবে লাগেজ ও লকার সিস্টেম। থাকছে আধুনিক ট্রাফিক সুবিধা। নিচতলায় টিকেট কাউন্টার, অভ্যর্থনা কেন্দ্র। দ্বিতীয়তলায় শপিংমল ও রেস্তোরাঁ। তিন তলায় তারকা মানের হোটেল। থাকছে মসজিদ, শিশু যত্ন কেন্দ্র ও চলন্ত সিঁড়ি। এখনে থাকছে এটিএম বুথ, পোস্ট অফিস, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন বুথসহ নানা সেবা কেন্দ্র।
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেলপথটি দুটি ভাগে কাজ করছে ঠিকাদার। দোহাজারী থেকে চকরিয়া অংশের কাজ করছে সিআরইসি এবং তমা কনস্ট্রাকশন। আর চকরিয়া থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত অংশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিসিইসিসি এবং ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল প্রকল্পটি ফাস্টট্র্যাকভুক্ত হয়। ২০১০ এর জুলাই থেকে শুরু হয়ে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে।
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথে ঢাকা থেকে দিনে দুটি ট্রেন চালানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বলা হয়েছে- একটি ট্রেন সকাল সোয়া আটটায় ঢাকার কমলাপুর থেকে যাত্রা করে দুপুর সোয়া দুইটায় কক্সবাজারে পৌঁছাবে। ওই ট্রেনটি কক্সবাজার থেকে রাত সাড়ে সাতটায় যাত্রা করে কমলাপুর পৌঁছাবে ভোর তিনটা ৪০ মিনিটে। আরেকটি ট্রেন কমলাপুর থেকে রাত সাড়ে ১০টায় যাত্রা করে সকাল সাড়ে ছয়টায় পৌঁছাবে কক্সবাজারে। সেখান থেকে দুপুর ১২টায় ফিরতি যাত্রা করে কমলাপুরে ফিরবে রাত আটটায়।
সম্প্রতি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ। এটি ট্রেন চলাচল শুরু করার ক্ষেত্রে তেমন একটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। বন্যায় ক্ষতি হওয়া লাইনের মেরামত ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।
পর্যটনশিল্প-বিকাশে অবারিত সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। বিদেশি পর্যটক ছাড়াও দেশের পর্যটকদের নিরাপত্তা, যোগাযোগের সুবিধা ও আকর্ষণীয় অফার দিলে সাগড়কন্যাখ্যাত পর্যটনগরী কক্সবাজারে লোক সমাগম বাড়বে। এক্ষেত্রে স্থানীয় যাতায়াতের সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি আরো কিছু পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় ভাবনার জায়গাটি খুবই দুর্বল বা অবেহেলিত বলা যেতেই পারে। পর্যটনে এগিয়ে যেতে হলে অঞ্চল বা জেলা ধরে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেমন, কক্সবাজারের পর্যটনসমৃদ্ধ এলাকাগুলোতে অবকাঠামো উন্নয়ন, পর্যটকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা, পর্যটন এলাকায় পর্যটন পুলিশকেন্দ্র স্থাপন, বিদেশি পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক গাইডের ব্যবস্থা, বিদেশে বাংলাদেশের ট্যুরিজম প্রমোশনে রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারের উদ্যোগী ভ‚মিকা পালন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রচারণা, পর্যটন এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, গ্যাস ও টেলিফোন ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয়সংখ্যক হোটেল নির্মাণ। যেন সাধ্যের মধ্যে পর্যটকরা সব ধরণের হোটেলে থাকার সুযোগ পান। সবশেষে পর্যটনে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় যাত্রা শুরু হোক ঢাকা-চট্টগ্রাম হয়ে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট