স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মোটামুটি একটি ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে এসেছে। সবসময়েই বাংলাদেশ বৃহৎ শক্তিগুলোর দ্বন্দ্ব থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছে। যখনই কোন জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তখনই বাংলাদেশ কোন অবস্থান ব্যক্ত না করে তার পররাষ্ট্রনীতি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই প্রথম বাংলাদেশ অনেকগুলো দ্বন্দ্বের মাঝখানে পড়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে আছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্র দেশগুলোর ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি।
বলা বাহুল্য, ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির পাশাপাশি জিওগ্রাফিক্যাল অবস্থানের জন্য ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ইন্দোপ্যাসিফিক স্ট্র্যাটিজিতে দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবেশপথ হিসাবে কাজ করতে পারে বাংলাদেশ। এমনকি এই অঞ্চলের আরেক শক্তি ভারতের সাথে সীমান্তবর্তী দেশ হওয়ায় কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। জনসংখ্যার বিচারেও বাংলাদেশ বড় একটি বাজার। অনেকেই বাংলাদেশের এই বাজারে ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন, বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন। আর ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির পর বাংলাদেশ যে বিশাল জলসীমা পেয়েছে, সেখানেও প্রচুর সম্পদ আছে। এসব কারণে বাংলাদেশ এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপানসহ কোয়াডের অন্য সদস্য এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে ঢাকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হওয়ায় বাংলাদেশ স্বাভাবিকভাবেই ভারত সাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর বেষ্টিত ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে ।
চীন কখন শক্তিশালী হয়ে উঠলো? বলা হয়ে থাকে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি বড় ধরণের বাঁক বদল ঘটেছিল ২০১৭ সালে। সেবছরের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করে। ২০১৭ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র যত ধরণের প্রতিরক্ষা, সামরিক বা কূটনৈতিক দলিল প্রকাশ করেছে, তার সব কিছুর কেন্দ্রে আছে চীন । এখন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মাথাব্যাথা কীভাবে চীনকে ঠেকানো যায়। কীভাবে সেটা করা যাবে? যুক্তরাষ্ট্রের এসব কৌশলের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি। এই স্ট্র্যাটেজির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইতমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারত—এই চার দেশের জোট কোয়াড গঠিত হয়েছে। বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরই নামের যে মহা-পরিকল্পনা নিয়ে চীন বিভিন্ন দেশে প্রভাব বিস্তার করছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি ছিল মূলত তার পাল্টা পরিকল্পনা, চীনকে ঠেকানোর কৌশল। ভারত এবং প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যত মিত্র দেশ আছে, এই ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজিতে তাদেরকে একটি চীন-বিরোধী জোটে জড়ো করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
একটু ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চল ঘুরে দেখা যাক। এই অঞ্চল এর রাজনীতি অর্থনীতি কেনো এতো গুরুত্বপূর্ণ? ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে দেশ আছে এক ডজনেরও বেশি। আছে চীন, ভারত, পাকিস্তানের মতো পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। আছে জাপান-কোরিয়ার মতো অর্থনৈতিক শক্তি। ইন্দো-প্যাসিফিক দেশগুলোতে যে জনসংখ্যা সেটা বৈশ্বিক জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি, যার ৫৮ শতাংশই আবার তরুণ। কর্মশক্তি এবং ভোক্তা -দুই হিসেবেই সংখ্যাটা বিশাল। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৈশ্বিক অর্থনীতিরই দুই-তৃতীয়াংশ, জিডিপি’র পরিমাণ হচ্ছে বৈশ্বিক জিডিপি’র ৬০ শতাংশ। ছাড়া বিশ্বে যে সমুদ্র আছে, তার ৬৫ শতাংশ পড়েছে ইন্দো-প্যাসিফিকে, ভূমির ক্ষেত্রে যেটা ২৫ শতাংশ। যার কারণে এই অঞ্চল হয়ে উঠছে বৈশ্বিক রাজনীতির ভরকেন্দ্র এবং আগ্রহের কারণ।
এদিকে ভারতের সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক বিবিসি ও রয়টার্সের সাবেক সংবাদদাতা। গত ৮ অক্টোবর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ন্যাশনাল হেরাল্ডের অনলাইন সংস্করণে ‘আই অন চায়না, প্রেসার অন বাংলাদেশ: আমেরিকাস লেটেস্ট গ্রেট গেম ইন দ্য ইস্ট’ শিরোনামে এক নিবন্ধে বাংলাদেশের ওপর মার্কিন চাপের অন্তর্নিহিত কারণগুলোকে তুলে ধরতে গিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কেন এত মাথাব্যথা সেই প্রশ্ন তুলেছেন। ভৌমিক বলেছেন, চীনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র যেসব কৌশল আঁটছে তার মধ্যেই এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেতে পারে। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের স্থল ও সমুদ্রে প্রবেশের রুটগুলোকে অবরুদ্ধ করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে তারা।
এই যে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের ওপর ক্ষোভ তার কারণ দেশটি এতো স্ট্যাটেজিতে পা দিচ্ছে না বাংলাদেশ। এবং আমেরিকার জন্য বড় চিন্তার হলো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি। ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় ইন্দো-প্যাসিফিক এখন বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, এই অঞ্চলকে ঘিরেই এখন তীব্র হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে দুই বৃহৎ শক্তিই বাংলাদেশকে তাদের পক্ষে চায় । ২৫ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি আবারও ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ। এই অঞ্চলকে ঘিরে ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কী হবে, সেটাই মূলত তুলে ধরা হয়েছে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা’ নামের ওই নীতিতে। “সবার সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে বৈরিতা নয়” বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির যে মূল ভিত্তি সেটিই তুলে ধরা হয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরে বাংলাদেশের রূপরেখায় ।
আর বিপত্তিটা ঘটলো এখানেই। ফলাফল, সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘন, সুষ্ঠু নির্বাচনের অজুহাতে দেশের অভ্যন্তরীণ সকল বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে প্রচ্ছন্নভাবে নানা দিক থেকে চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে বাংলাদেশকে । দীর্ঘবছর ধরেই বাংলাদেশের মানবাধিকার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের অজুহাতে দেশের প্রতিটি বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো। কিন্তু তারা অন্য অনেক দেশের কোন লঙ্ঘনকেই যুক্তরাষ্ট্র আমলে নেয় না। ফলে বলাই যায় যে, বাংলাদেশ ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের এত কূটনীতিক তৎপরতার কারণ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরে বাংলাদেশের নিরপেক্ষ অবস্থান ঘোষণা দেয়া।
আসলেই চীনকে প্রতিপক্ষ ভেবে কতদূর করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র? এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায় ৯ অক্টোবর রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত বে অব বেঙ্গল সম্মেলনে ‘ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রতিযোগিতা’ শীর্ষক অধিবেশনে যে কথা বলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সেটি থেকেই। তিনি সরাসরি বলেন, ইন্দোপ্যাসেফিক অঞ্চলে ক্রমেই চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবাধে বাড়তে দিলে তা এ অঞ্চলের দেশগুলোর নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠবে। ফলে চীন ঠেকাও যেমন মনোভাবে আছে, সেটা করতে বাংলাদেশকে দুর্বল করে সাথে নেওয়ার কৌশলও বিদ্যমান।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।