ঊনিশ শতকের ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও ঔপন্যাসিক ভিক্টর হুগো সমাজ ও মানুষের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করতে গিয়ে বলেছেন, সমাজ ও সংসারের কাছ থেকে মানুষ অনেক কিছু আশা করে। সমাজ ব্যবস্থা তেমন হওয়া উচিত যাতে মানুষ তার আশা থেকে বঞ্চিত না হয়। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন, জীবনের চূড়ান্ত মূল্য শুধুমাত্র বেঁচে থাকার উপর নির্ভর না করে সচেতনতা এবং চিন্তার শক্তির উপর নির্ভর করে। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করলেই কেবল সমাজের পরিবর্তন ঘটে না, এর সাথে সাথে মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও চিন্তার সমন্বয় ঘটাতে পারলেই সমাজের পরিবর্তনগুলো ইতিবাচক হয়ে উঠে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্টের উন্নয়নের দর্শনকে এগিয়ে নিতে মানুষের প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলোকে যেমন এগিয়ে নিচ্ছেন, তেমনই মানুষের ভিতরের ইতিবাচক চিন্তা করার শক্তি গড়ে দিচ্ছেন। প্রসঙ্গতভাবে পদ্মা সেতুর বিষয়টি এখানে উদাহরণ হিসেবে টেনে আনা যেতে পারে। যখন দেশ-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে পদ্মা সেতুর নির্মাণের কাজ বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল। তখন দেশ-বিদেশের মানুষ ভেবেছিলো, বাংলাদেশ আর কখনো পদ্মাসেতু নির্মাণ করতে পারবে না। বিশেষ করে দেশের মানুষ তাদের বহু দিনের লালিত স্বপ্ন ভেঙে যাবে বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। এমন এক বিরূপ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিছিয়ে যাননি, বরং দৃঢ় চিত্তে ঘোষণা করেছিলেন, অন্যের উপর নির্ভর না করে আমাদের নিজেদের অর্থায়নে আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণ করবো। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা মানুষের মনের মধ্যে অমিত সাহস ও আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিয়ে ছিলো। পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়, এখন বাস্তবতা। বাংলাদেশের মানুষের মনোজগতে ঘটে গেছে এক ইতিবাচক পরিবর্তন। মানুষের মনকে যে ইতিবাচকভাবে পরিবর্তন করা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত তার প্রমাণ। মানুষ এখন নেতিবাচক চিন্তা করছে না, বরং মানুষ এখন ইতিবাচক চিন্তা করতে শিখেছে।
মানুষের মনোজগতের চিন্তা যখন স্বপ্ন, সাহস ও বিশ্বাসকে জয় করতে পারে, তখন সমাজের যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ইতিবাচক দৃষ্টি ভঙ্গির প্রতিফলন ঘটে। তখন সমাজ পরিবর্তনের মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা ক্রিয়াশীল হয়ে মানুষের মধ্যে দেশ প্রেম গড়ে দেয়, যার মাধ্যমে মানুষ রাষ্ট্র গঠনে তাদের সক্রিয় হয়ে উঠা চিন্তা শক্তিকে কাজে লাগাতে পারে। পরনির্ভরশীলতা নয়, নিজেদের শক্তি ও স্বকীয়তায় পারে দেশকে বদলে দিতে। সমাজ যত প্রযুক্তি নির্ভর হবে, মানুষের তত কুসংস্কারের মতো নেতিবাচক ধারণাগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। বিশ্বখ্যাত স্কটিশ দার্শনিকও রাজনৈতিক অর্থনীতি তত্ত্বের জনক অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ কুসংস্কার থেকে উত্তোরণ প্রসঙ্গে বলেছেন, বিজ্ঞান হল কুসংস্কার নামক বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহৌষধ। মহাত্মাগান্ধী কুসংস্কার সমন্ধে বলেছেন, কুসংস্কার এবং সত্য কখনো এক সাথে যেতে পারে না। কুসংস্কার মানুষের মধ্যে অন্ধবিশ্বাস ও ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করে, যেগুলো সমাজ ও রাষ্ট্রের অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। মনে রাখতে হবে, মানুষ মনের দিক থেকে পিছিয়ে পড়লে প্রগতিও পিছিয়ে পরে, মনকে এগিয়ে নিতে পারলে প্রগতিও এগিয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুসংস্কার মুক্ত উন্নত সমাজ ও টেকসই রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তুলতে বিজ্ঞানের দৃষ্টি ভঙ্গিকে প্রাধান্য নিয়ে প্রযুক্তি নির্ভর উন্নত বাংলাদেশ গড়ার দর্শন দিয়েছেন। এই দর্শনের গভীর বোধ হলো, মানুষকে বর্তমান সময় নিয়ে ভাবলেই চলবে না, বরং ভবিষ্যতকে দেখার মতো মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে, যেটাকে বলা হয় ডাইরেকশন অফ ভিশন। বিখ্যাত স্প্যানিশ চিত্র শিল্পী ও ভাস্কর পাবলো পিকাসোর উল্লেখযোগ্য চিত্র কর্মগুলো হলো: ল্যা মুল্যাঁ দা ল গালেৎ, দ্য ব্লু রুম, ওল্ড গিটারিস্ট, সালত্যাঁবাঁক, সেলফ-পোর্ট্রটে, টু নুডস, আভাগঁর রমণীরা, থ্রি মিউজিশিয়ানস, স্কাল্পটর, মডেল অ্যান্ড ফিশবৌল, থ্রি ড্যান্সার্স, গিটার, গ্লাস অব আবস্যাঁৎ, সিটেড বাথার, পালোমা ও গোয়ের্নিকা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তিনি চিত্র কর্মের প্রত্যেক পর্যায়ে তার আগের চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এক একটা চিন্তাকে ভেঙে আর একটা চিন্তার পর্যায়ে গেছেন। চিন্তাকে কোনো একটা ধারার মধ্যে না রেখে যতই এগিয়েছেন ততই শিল্পকর্ম গড়ার ক্ষেত্রে নতুন চিন্তার জন্ম দিয়েছেন, যেখানে চিন্তার বৈচিত্র্য প্রধান উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ডাইরেকশন অফ ভিশনকে নতুন নতুন চিন্তা ও বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিচ্ছেন। এটি সামাজিক সচেতনতারই একটি অংশ, এর কারণ আমাদের দেশের মানুষ আগে জানতো না ডাইরেকশন অফ ভিশন বলে কোনো বিষয় থাকতে পারে, বরং মানুষ বর্তমান সময়কে নিয়েই বেশি ভেবেছে। এতে করে সময়ের সাথে যে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটানো যায় তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এর প্রমাণ, যার মাধ্যমে খুব দ্রুত মানুষ আধুনিক প্রযুক্তির সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে। সাধারণ মানুষ যে কোনো ধরণের সেবা বাসায় বসেই পাচ্ছে। এছাড়া প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে দুর্নীতি রোধ করা গেছে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বেড়েছে।
সামাজিক সচেতনায় ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা মানুষের জীবনে সুফল বয়ে এনেছে। মূলত কানেক্টিভিটি, দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন, ই-গভর্মেন্ট এবং আইসিটি ইন্ডাষ্ট্রি প্রোমোশন এই চারটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে ডিজিটাল বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হয়েছে। ব্রড ব্যন্ড কানেক্টিভিটি ইউনিয়ন পর্যায়ের মানুষের হাতে পৌঁছে গেছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বর্তমানে দেশে প্রায় ১৩ কোটিরও বেশি এবং মোবাইল সংযোগের সংখ্যা ১৮ কোটিরও ওপরে। ৮ হাজার ৮০০ টি ডিজিটাল সেন্টারে প্রায় ১৬ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা তাদের কর্মযজ্ঞ অব্যাহত রেখেছে। আশার বিষয় হচ্ছে, এই উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রায় ৫০% নারী রয়েছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশে বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারী-পুরুষের বৈষম্য, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ও গ্রাম-শহরের বৈষম্য দূর হয়েছে। এছাড়া প্রতি মাসে গড়ে ৭০ লাখেরও অধিক সেবা এসব ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে নাগরিকদের প্রদান করা হচ্ছে।
আধুনিক সভ্যতার এই যুগে তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যে আদান-প্রদানের ডিজিটাল প্রযুক্তি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০৪১ সালের জন্য ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্স কে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’ হিসেবে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ বির্নিমাণে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনোমি ও স্মার্ট গভর্নমেন্ট এই চারটি স্তম্ভ গুলোর মাধ্যমে দেশের নাগরিকগণ প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের সকল সুযোগ-সুবিধা পাবেন এবং দেশের নাগরিকদের সামাজিক অগ্রগতি ও প্রতিভা বিকাশে অবদান রাখবে। স্মার্ট বাংলাদেশের প্রতিটি স্তম্ভে নাগরিকদের আদর্শ ও সচেতন এক বৈশ্বিক নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলবে। এছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সোনার বাংলা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল নীতি বাস্তবায়ন করেছেন। এ কৌশল বাস্তবায়নের ফলে সরকারের সকল প্রতিষ্ঠান, দপ্তর, সংস্থা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সময়ানুবর্তী ও বার্ষিক কর্ম পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রত্যেক নাগরিককে তাদের সিটিজেন চার্টার অনুযায়ী সেবা গ্রহণে উদ্ধুদ্ধ করছেন। তথ্য অধিকার বাস্তবায়নের ফলে তথ্যের অবাধ প্রবাহের গতিশীলতা কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে। এই কৌশলের আওতায় অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থাপনার ফলে নাগরিকগণ তাদের যে কোন অভিযোগ করতে পারছেন ও তার সমাধান পাচ্ছেন। সর্বোপরি, এই কৌশল একজন স্মার্ট নাগরিক হিসেবে নিজেদেরকে সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নের উপযোগী করে গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। এছাড়া বর্তমান সরকার সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, দুস্থ ও অসহায় দুরারোগ্য রোগীদের সহায়তাসহ নানা কার্যক্রম উত্তরোত্তর অব্যাহত রেখে দেশের মানুষকে সুস্থ ও মানসম্মত জীবন-যাপনের ধারা ত্বরান্বিত করেছেন।
সর্বোপরি, ইন্টারনেটের এই যুগে একজন মানুষ যদি সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে তবে তিনি কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনে জীবনযাত্রার মান উন্নতি করতে পারবেন। সে লক্ষ্যেই বর্তমান সরকার তথ্য ও প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমের আওতায় নাগরিকদের সচেতন করে তুলছেন। আজ তার সুফল আমরা ভোগ করছি। এখন একজন কৃষক তার কৃষি সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যাবলী সংক্রান্ত সমস্যা দ্রুত পাচ্ছেন। সরকার জরুরী সেবা ৯৯৯ চালু করে নাগরিকদের যে কোন বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিক এর মাধ্যমে দেশের তৃণমূল পর্যায়ে মানুষেরা যেমন চিকিৎসা সুবিধা গ্রহণ করে আগাম স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য উপাত্ত পেয়ে সু-স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করছে। এসব কিছুই ঘটছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রযুক্তি নির্ভর সমাজ কাঠামো বিনির্মাণের দর্শনকে এগিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে। এর সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাজ ভাবনা মানবিক অর্থনীতির সাথে যোগসূত্র তৈরী করে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে। এখন দরকার সমাজের সকল স্তরের মানুষের দেশ গঠনে ভূমিকা রাখা ও দেশপ্রেমের মাধ্যমে নিজেদের প্রমাণ করা।
লেখক- অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর