স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে যাত্রীবাহী ট্রেন চলবে আজ
বাংলাদেশের আত্মমর্যাদার প্রতীক পদ্মা সেতু দিয়ে এবার চলবে ট্রেন। মঙ্গলবার সবুজ পতাকা নেড়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাঙ্গা থেকে ঢাকা অভিমুখি যাত্রীবাহী ট্রেনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। পরের দিন থেকে যাত্রীরা চলাচল করতে পারবেন। পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচলের সাড়ে ১৫ মাস পর ট্রেন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে স্বপ্নের সেতুটি।
দু’তলা এই সেতুর উপর দিয়ে চার লেনে চলাচল করছে যানবাহন। আর নিচ তলা দিয়ে ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার বেগে চলবে ট্রেন। এরমধ্য দিয়ে রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে। একই সঙ্গে সারাদেশ রেল যোগাযোগের আওতায় চলে আসার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
রেল মন্ত্রণালয় ও পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হলো। এই রেল যোগাযোগ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখবে। সংশ্লিষ্টদের আশা, মোট দেশীয় উৎপাদন (জিডিপি) আনুমানিক এক (১) শতাংশ বৃদ্ধি পাবে রেলপথ চালু হওয়ার কারণে।
৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার এই প্রকল্পের আওতায় ঢাকার কমলাপুর থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেল লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৪ সালের মধ্যে। এই প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হচ্ছে নতুন ১৪টি স্টেশন ও ৬৬টি বড় সেতু। এছাড়াও ৬টি পুরনো স্টেশন পুনঃনির্মাণ ও ২৫৪টি ছোট সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে এই প্রকল্পেরে আওতায় ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার রেললাইন ও স্টেশন নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন।
পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ হয়ে গেলে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলা নতুন করে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আসবে। ধাপে ধাপে বরিশাল ও পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরকে রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা যেমন সহজ হবে, তেমনি ওই অঞ্চলের মানুষের জন্য কম খরচে ট্রেনের মাধ্যমে পণ্য পরিবহনও সহজ হবে। এতে করে দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটবে।
ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের ফলে ঢাকা থেকে যশোরের দূরত্ব কমবে ১৮৪ দশমিক ৭২ কিলোমিটার, ঢাকা-খুলনা দূরত্ব কমবে ২১২ কিলোমিটার এবং ঢাকার সঙ্গে দর্শনার দূরত্ব কমবে ৪৪ কিলোমিটার ফলে যাত্রার সময়ও কমে আসবে। এই রেলপথটি শুধু দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের ক্ষেত্রেই নেয়, আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করতে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও বড় অবদান রাখবে। এছাড়া ভাঙ্গা থেকে পাচুরিয়া-রাজবাড়ী সেকশনটি পদ্মা সেতু হয়ে সরাসরি ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হবে।
পদ্মা রেল লিংকটি শুধু দেশের রেল যোগাযোগেই পরিবর্তন আনবে। এই রুটটি যুক্ত হবে ট্রান্স এশিয়ান রেল রুটের সঙ্গে। বাংলাদেশ থেকে মায়ানমার হয়ে চীন পর্যন্ত সংযোগ ঘটাবে এই রেল রুট। পদ্মাসেতুর রেল রুট ব্যবহার করে পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতকে সংযুক্ত করে বেনাপোল-যশোর-নড়াইল-ভাঙ্গা-মাওয়া হয়ে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-টঙ্গী-আখাউড়া-চট্টগ্রাম-দোহাজারি হয়ে মিয়ানমারের গুনদুম সীমান্তে গিয়ে মিলবে। এর ফলে নানামুখী সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে।
ট্রান্স-এশিয়ান রেল রুটের সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক(পিডি) প্রকৌশলী গোলাম ফখরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, উদ্দেশ্য একটাই, দ্বার খুলে দেয়া এবং সংযোগ বাড়ানো। এরইমধ্যে ভারতের সঙ্গে আমাদের সংযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এবারে আমরা মিয়ানমারকে সংযুক্ত করতে যাচ্ছি। সেখান থকে চীনের সঙ্গে সংযোগ ঘটবে। এই রুটের মাধ্যমে আরো অনেক দেশে যেতে পারবো। অর্থাৎ, সম্ভাবনা অনেক।
দেশের প্রথম পাথরবিহীন রেলপথ নির্মাণ হয়েছে পদ্মা সেতুতে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাথরবিহীন এই রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে মূল সেতুতে। যার দৈর্ঘ্য ১৩ দশমিক ৩ কিলোমিটার। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভ্রমণের ক্ষেত্রে পাথরবিহীন রেলপথ খুবই আরামদায়ক। সেতুতে যাতে কোনো ঝাঁকুনি (জার্কিং) না হয়, সেজন্য তারা পাথরবিহীন রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তারা জানান, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাথরবিহীন রেলপথ দিয়ে ঘণ্টায় ৩০০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলতে পারে। পদ্মা সেতুতে এর গতি নির্ধারণ করা হয়েছে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভুক্ত (ফার্স্ট ট্র্যাক) ১০ প্রকল্পের একটি। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রথমে ব্যয় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। পরবর্তিতে নতুনভাবে ডুয়েলগেজ নির্মাণ, ভাঙ্গা জংশনে ওভারহেড স্টেশন, নড়াইলের তুলারামপুরে নতুন আন্ডারপাস, ভায়াডাক্টের পিয়ারের নকশা পরিবর্তন, ১০০টি বিজি কোচের ডিজাইন পরিবর্তন, স্টেশনগুলোতে অপারেশনাল সুবিধা বৃদ্ধিজনিত পরিবর্তন, নদীর নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স বৃদ্ধির কারণে কারণে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকায়। এছাড়া ঢাকা-মাওয়া ও ভাঙ্গা-যশোর সেকশনে জমি অধিগ্রহণে বিলম্ব এবং ইউটিলিটি লাইন স্থানান্তর। তুলারামপুর ও টিটিপাড়া পয়েন্টে লেভেল ক্রসিংয়ের পরিবর্তে রেলওয়ে আন্ডারপাস নির্মাণের মতো পরিকল্পনা গ্রহণ করায় এই ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে । পদ্মা সেতু রেল লিংক প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন হচ্ছে ১৮ হাজার ২১০ কোটি টাকা। বাকি ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা অর্থায়ন করছে চীন।