যখনই কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে আসেন তখনই কোন এক অজানা প্রান্ত থেকে আসে বিপত্তি। প্রশ্ন ওঠে – ওই পদে ব্যক্তির যোগ্যতা নিয়ে। এটিই এখন একটি সচরাচর চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারী নেতৃত্বে দক্ষিণ এশিয়া বর্তমানে একটি অন্যতম অবস্থানে আছে। আর নারী নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় সবচেয়ে বেশি এই অঞ্চলেই। তেমনি একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন- বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সৃষ্টিশীল নারী নেতৃত্বের ১০০ জনের তালিকায় স্থান নেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদে বাংলাদেশের মনোনয়ন দেওয়ার পর থেকে সায়মা ওয়াজেদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। তবে তাদের প্রশ্নের যৌক্তিকতা নিয়েও আছে প্রশ্ন।
চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন তালহা বারকি নামে একজন বিশ্লেষক ও গবেষক। তার প্রতিবেদনে তিনি শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে সায়মা ওয়াজেদের একটি যোগসুত্র স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কন্যার রাজনীতির শীর্ষ নেতৃত্বে আসার সম্ভাবনা দেখছেন না বলেও বেশ কয়েকবার জানিয়েছেন। শেখ হাসিনার সরকারের সমালোচনার রেফারেন্সে তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বারকি ‘বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা একজন’ এর বরাত দিয়ে উল্লেখ করেন, সায়মা ওয়াজেদ বৈশ্বিক সম্মেলনে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদের জন্য, যদিও এমন কিছুই সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলনে দেখা যায়নি।
অপর একজন আন্তর্জাতিক রাজনীতির অধ্যাপকের বরাত দিয়ে বলেছেন, প্রাথমিক দক্ষতা হিসেবে স্বাস্থ্য সম্পর্কে জ্ঞানকে প্রাধান্য দেওয়া বোকামি।
মুলত ওই প্রতিবেদনে সায়মা ওয়াজেদ সম্পর্কে আংশিক এবং ভুল তথ্য তুলে ধরে তার মনোনয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। আর সেই প্রতিবেদনেক রেফারেন্স হিসেবে ধরে কয়েকটি গণমাধ্যমও একই প্রশ্ন তুলেছে। যদিও ল্যানসেটে প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে আগেও বিতর্ক আছে। ল্যানসেটের পক্ষ থেকে সায়মা ওয়াজেদের সঙ্গে ভুল ইমেইলে যোগাযোগ করা হলেও ফিনানশিয়াল টাইমস যোগাযোগ করতে পেরেছে। জবাবে সায়মা ওয়াজেদ জানান, “স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আপত্তিকর”। আরও বলেন, তিনি জানেন না তাঁর মা রাজনীতিবিদ বলে নাকি তিনি একজন মুসলিম নারী বলে তাঁর যোগ্যতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন তোলা হয়।
ঘটনাটি খুব বেশি দিন আগের নয়, ২০২০ সালের। হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে- ল্যানসেটে প্রকাশিত এমন একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এমন দাবি করা হয়েছিল। এটির ভিত্তিতে এ ওষুধ করোনার চিকিৎসায় ব্যবহার না করার পরামর্শ দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। যার ফলে বেশ কয়েকটি ট্রায়ালও বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু দিন পরেই গবেষণাটিতে ব্যবহৃত তথ্য-উপাত্তের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। গবেষণা প্রতিবেদনটি শেষ পর্যন্ত প্রত্যাহার করে নেন তিন গবেষক। যার ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও মত বদলাতে বাধ্য হয়।
বিভিন্ন সময়ে ল্যানসেটে করোনার বিরুদ্ধে কাজ করা ভ্যাকসিন নিয়েও নানা মত প্রকাশ করেছে। ভ্যাকসিনের বুস্টার শটের পক্ষে বিপক্ষে নানা মত ছাপানো হয়েছে এই সাময়িকীতে। অর্থাৎ দ্বিধাদন্দের মধ্যে থাকা প্রতিবেদনও ল্যানসেট ছাপিয়ে থাকে।
দ্য ল্যানসেট একটি সাপ্তাহিক পিয়ার-রিভিউড মেডিকাল জার্নাল যার প্রকাশনা সংস্থার নাম ‘এলসেভিয়ার’। এলসেভিয়ার একটি ডাচ একাডেমিক প্রকাশনা সংস্থা যা সম্প্রতি নিন্দিত হয়েছে তার একটি জার্নালের সম্পূর্ণ সম্পাদকীয় বোর্ডের পদত্যাগের জন্য। ৪০ জনেরও বেশি স্বনামধন্য বিজ্ঞানী প্রকাশনা ক্ষেত্রে ‘জায়ান্ট’ এলসেভিয়ারের ‘লোভ’ এর প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। এর মধ্যে ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, কিংস কলেজ লন্ডন এবং কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা। কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রেন স্টিমুলেশনের প্রধান এবং পদত্যাগকারী দলের একজন প্রফেসর ক্রিস চেম্বারস বলেন, “এলসিভিয়ারের লোভের শিকার একাডেমিক কমিউনিটি। এই প্রকাশনা সংস্থার বিজ্ঞানে অবদান সামান্য, অথচ লাভের দাবি বিশাল।” তিনি বলেন, “এরা শুধু টাকাটাই চেনে”। তিনি বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীদের এলসেভিয়ারের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক পদে থাকার জন্য যা যা যোগ্যতা প্রয়োজন তার মধ্যে আছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ধারণ করা ও তার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকা, নেতৃত্বদান ও পরিচালনা করার দক্ষতা, পেশাদার ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা এবং শারীরিক সুস্থতা।
সায়মা ওয়াজেদ ১৯৯৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ২০০২ সালে ক্লিনিকাল মনস্তত্ত্বে স্নাতকোত্তর অর্জন করেন। তিনি ২০০৪ সালে স্কুল সাইকোলজির ওপর বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি অর্জন করেন। লাইসেন্সপ্রাপ্ত স্কুল মনোবিজ্ঞানী হিসেবে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অরেঞ্জ কাউন্টি ও ডুভাল কাউন্টির পাবলিক স্কুল সিস্টেমে কাজ করছেন।
ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সময় তিনি বাংলাদেশের নারীদের উন্নয়নের ওপর গবেষণা করেন। এ বিষয়ে তাঁর গবেষণাকর্ম ফ্লোরিডার একাডেমি অব সায়েন্সের কাছ থেকে শ্রেষ্ঠ সায়েন্টিফিক উপস্থাপনা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। বর্তমানে তিনি ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সাংগঠনিক নেতৃত্ব’ বিষয়ে পিএইচডি করছেন।
সায়মা ওয়াজেদের উল্লেখযোগ্য সাফল্যের মধ্যে রয়েছে তিনটি আন্তর্জাতিক রেজোলিউশনের খসড়া তৈরি করা, যা পরবর্তীতে জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলো দ্বারা গৃহীত হয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকের মানসিক স্বাস্থ্য ও অটিজম বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ২০১৪ সাল থেকে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক অভিজ্ঞ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। ২০২৩ সালের আগস্টে তিনি চাথাম হাউজের গ্লোবাল হেলথ প্রোগ্রামে একজন সহযোগী ফেলো হিসেবে নিযুক্ত হন, যেখানে তিনি ২০২২ সাল থেকে ইউনিভার্সাল হেলথ কমিশনের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
এর আগে তিনি ২০২০ সাল থেকে তিনি ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম এর ‘থিম্যাটিক এম্বাসেডর ফর ভালনারেবিলিটি’ হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এসইএআরও এর শুভেচ্ছাদূত হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশে তিনি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কৌশলগত পরিকল্পনা ২০২০-২০২৫ এর মুখ্য উপদেষ্টা। ২০১২ সাল থেকে তিনি অটিজম ও স্নায়ুবিকাশজনিত উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপার্সন হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
বর্তমানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের ভিজিটিং স্পেশালিস্ট এবং ঢাকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি হিসেবে কাজ করছেন।
সায়মা ওয়াজেদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন, রুয়ান্ডায় কমনওয়েলথ সরকার প্রধানদের সভা, জাপানে নারীদের বিশ্ব সমাবেশ, স্কটল্যান্ড ও মিশরে কপ ২৬ এবং ২৭, শ্রীলংকায় জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের গোলটেবিল বৈঠক, ক্যাম্বোডিয়ায় গ্লোবাল চাইল্ড নিউট্রিশন ফোরাম, ভারতে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম, পর্তুগালে ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস অব সাইকিয়াট্রি সহ বিভিন্ন উচ্চ-স্তরের সম্মেলন ও ইভেন্টে বক্তৃতা করার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
তাঁর কর্মময় জীবনে তিনি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন, তার মধ্যে আছে ডব্লিউএইচও এসইএআরও এর ‘সাইটেশন ফর এক্সেলেন্স ইন পাবলিক হেলথ’, ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট প্রাক্তন শিক্ষার্থী পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্রে শেমা কোলাইনু কর্তৃক আন্তর্জাতিক চ্যাম্পিয়ন পুরস্কার। তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা বৈশ্বিক মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে একজন উদ্ভাবনী নারী নেত্রী হিসেবে তালিকাভুক্ত।
বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সৃষ্টিশীল নারী নেতৃত্বের ১০০ জনের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। দীর্ঘদিন যাবৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বিশেষজ্ঞ হিসেবে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।