নব্বইয়ের দশকের পর থেকে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটতে শুরু করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সশস্ত্র জঙ্গিবাদের উত্থানের সর্ববৃহৎ আলামত দৃশ্যমান হয় ২০০৫ সালে জেএমবির ৬১টি জেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে। এরপর সারা দেশে ছোট-বড় আরও অনেক সশস্ত্র জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ ও নৃশংস ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালের ১ জুলাইয়ে গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয়। সেখানে ৫ জঙ্গিসহ ২৯ জনের প্রাণহানি ঘটে।
দুই দশকে এসব হামলার শিকার হয়েছেন খোদ বর্তমানের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশকে জঙ্গিগোষ্ঠীর হাত থেকে রক্ষা করতে তিনি ঘোষনা দেন জিরো টলারেন্সের। এটা যে কোন মুখের কথা ছিলো না তা বাংলাদেশ বুঝতে শুরু করেছে। একের পর এক জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান, একের পর এক নৃশংস হামলার পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন জঙ্গিমুক্ত দেশে পরিণত হতে চলেছে।
নানা চড়াই উৎরাইয়ের পর বিশ্বে জঙ্গিবাদ দমনে যে অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ তার ক্যাপ্টেন বর্তমানের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেশব্যাপী জঙ্গিবিরোধী অভিযানে এই সাফল্য অর্জন করেছে। বৈশ্বিক ইনডেক্সে হাই রিস্কের (উচ্চ ঝুঁকি) দেশ থেকে লো রিস্কের (নিম্ন ঝুঁকি) দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) তত্ত্বাবধানে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করলেও তা যৌথ বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের মুখে অনেকটা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে।
গোবাল টেররিজম ইনডেক্স (জিটিআই)-২০২৩ প্রতিবেদন অনুযায়ী এর সূচকে বাংলাদেশ তিন ধাপ উন্নতি করেছে। অর্থাৎ দেশে সন্ত্রাসবাদ আরও কমেছে, দেশ নিরাপদ হয়েছে। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো করা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি ও ভারতের চেয়েও জঙ্গি দমনে ভালো করেছে বাংলাদেশ। জঙ্গিবাদ পুরাপুরি নির্মূল না হলেও জঙ্গি সংগঠনগুলোর মেরুদন্ড ভেঙে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে এখনও অনলাইনে সক্রিয় রয়েছে বেশকিছু জঙ্গি সংগঠন।
পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সাল থেকে ২০২৩ সাল গত ২২ বছরে সারাদেশে জঙ্গিবাদ বিষয়ক প্রায় ২ হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৯ হাজারেরও বেশি জঙ্গি। এসব জঙ্গিরা হচ্ছে জেএমবি, নব্য জেএমবি, আনসার আল ইসলাম, হরকত-উল-জিহাদ হুজি, হিযবুত তাহরির, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। বিশেষ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পরিকল্পনা করে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে যার মধ্যে সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রণয়ন এবং প্রাসঙ্গিক আইন সংশোধন অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
২০০৯-২০১৩ সালে, ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ পুরোহিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী, ভিন্নমতের ইসলামী মতাদর্শের অনুসারী, আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা এবং বিদেশীদের ওপর ধারাবাহিক আক্রমণ দেশে জঙ্গিবাদ বিরোধী কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জে ফেলেছিল। তবে এখনো পুরনো জঙ্গি সংগঠন জএমবি, আনসার-আল ইসলাম ও হুজিবি সংগঠিত হওয়ার সময়ে অনেক জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়েছে। নব্য জেএমবির সর্বশেষ আমির মেহেদি হাসান জন তুরস্কে বসে সংগঠনটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছিল। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।
বাংলা ভাইয়ের সন্ত্রাস, হরকাতুল জেহাদের হুমকি ধামকির বিপরীতে বিশুদ্ধ বাংলাদেশ ও জঙ্গিবাদ নির্মূল সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্স নীতির কারণে। দেশে এখনো পর্যন্ত জেএমবি, শাহাদাত-ই-আল-হিকমা, জেএমজেবি, হিজবুত তাহরির, হুজি-বি, এবিটি, আনসার আল ইসলাম এবং আল্লাহ দল নামে আটটি জঙ্গি সংগঠনকে বাংলাদেশ সরকার নিষিদ্ধ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সরকারের কঠোর ভূমিকার কারণে দেশের জঙ্গিবাদ নেটওয়ার্ক ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে।
বলতে দ্বিধা নেই, জঙ্গিবাদ দমনে ২০১৬ সালে গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনার আগে জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ পুলিশের তেমন দক্ষতা ছিল না। এরপর গঠন করা হয় পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট, ডিএমপির কাউন্টার-টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, সাইবার ক্রাইম, ইনভেস্টিগেশন সেন্টার এবং পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ইন্টারসেপশন ইউনিট জঙ্গিবাদ দমনে সরাসরি কাজ করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইনে জঙ্গিদের তৎপরতা ঠেকাতেও সতর্ক রয়েছে এসব বাহিনী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ।’ এ দেশের মানুষ ধর্মীয় উগ্রবাদিতা ও তাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত জঙ্গিবাদকে ঘৃণা করে। শিশুদের জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ থেকে দূরে রেখে একটি আধুনিক ও জ্ঞানভিত্তিক উন্নত জাতি গঠনে অবদান রাখতে হজযাত্রী এবং আলেম-ওলামাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আপনাদের (হজযাত্রীদের) এবং আলেম-ওলামাদের জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছি যাতে আমাদের শিশুরা এটি থেকে দূরে থাকতে পারে এবং উন্নত বাংলাদেশ গড়তে আধুনিক প্রযুক্তিতে প্রস্তুত হতে পারে। শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন, যারা জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টি করছে তারা সব ধর্মেই আছে। ‘যদি কেউ মনে করে যে তারা নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে বেহেশতে যাবে, তা কখনোই হবে না। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা বলেননি এবং আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তা বলেননি।
তিনি এই কথাগুলো বিশ্বাস করেন বলেনই তার সরকারের প্রথম মেয়াদে (২০০৯-২০১৩) জঙ্গিবাদ দমনে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। অপরাধ দমন, অপরাধী শনাক্তকরণ, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার রোধ, মাদকদ্রব্য চোরাচালান রোধ, মানবপাচার রোধ ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।