বছর পাঁচেক আগেও দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষজন ভাবতে পারেননি তাদের জীবনযাত্রার মান আমূল পাল্টে যাবে। গ্রামের পরিবেশ হয়ে উঠবে আধুনিক। আনাচে-কানাচে গড়ে উঠবে ছোটবড় শিল্প কারখানা। দক্ষিণের সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা হয়ে উঠবে পর্যটকদের তীর্থ স্থান। কিংবা দক্ষিণবঙ্গের জনপদ জুড়ে গড়ে উঠবে অত্যাধুনিক যোগাযোগ অবকাঠামো। জলযান লঞ্চের আট-দশ ঘণ্টার ভ্রমণকে ইতি জানিয়ে সহজেই মাত্র চার থেকে পাঁচ ঘণ্টায় তারা পৌঁছে যাবেন রাজধানী ঢাকায়। দিনের কাজ শেষে রাজধানী ছেড়ে আবারও চলে যাবেন গ্রামে।
এক জাদুতেই এতো সব অসম্ভব মুহূর্তেই সম্ভবে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের আত্মমর্যাদার প্রতীক স্বপ্নের পদ্মা সেতু দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে রাতারাতি। এক সময় যে সেতু ছিল দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে মুধুই স্বপ্ন, সেটি এখন শুধু তাদের ভাগ্যের চাকাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের গতিপথকেই পাল্টে দিয়েছে পদ্মা সেতু। শুধু যে পদ্মা সেতু তা নয়, এই সেতুকে ঘিরে তৈরি হয়েছে করে এক্সপ্রেসওয়ে। একইসঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক যোগযোগ ব্যবস্থারও ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে।
স্বাধীনতার পর বরাবরই অবহেলিত ছিলো ধান-নদী-খালের জনপদ বৃহত্তর বরিশাল। শুধু বরিশাল অঞ্চলই নয়, এর সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আরো অনেকগুলো জেলা যোগাযোগের ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল যোজন যোজন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে এসবস জেলার কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের দুঃখ-কষ্ট ও আক্ষেপ দূর হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ওই অঞ্চলে উন্নয়নের পালে হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে পাল্টাতে শুরু করেছে বরিশাল বিভাগের বরিশাল, ভোলা, পিরোজপুর, ঝালকাঠী, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলার চিত্র। এই ছয় জেলার প্রাণকেন্দ্র বরিশাল শহর হয়ে উঠছে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। পদ্মা সেতু নির্মাণের পর বৃহত্তর বরিশালসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের পথের ক্লান্তি দূর হয়েছে। নৌপথের ৮-১০ ঘণ্টার জার্নি নেমে এসছে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টায়।
দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, পদ্মা সেতুর কারণে এবং যোগাযোগ অবকাঠামোর অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটছে বরিশাল অঞ্চলে। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে পায়রা বন্দর। এই দুই বড় অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে বরিশাল অঞ্চল দেশের বৃহত্তম অর্থনৈতিক করিডর হিসেবে গড়ে উঠবে। এখন দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন বলা হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েকে। অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা-দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল হাইওয়েও হয়ে উঠবে দেশের অর্থনীতির অন্যতম লাইফলাইন।
পদ্মা সেতু আর পায়রা বন্দরের কারণেই বরিশাল অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার ঘটছে দিনে দিনে। আগামী কয়েক বছরে এই অঞ্চলে ব্যাপক হারে গড়ে উঠবে শিল্পকারখানা। দেশের অর্থনীতিতে গতি আনবে এই অঞ্চল। ব্যবসায়ীরা স্বল্প খরচে এবং কম সময়ে বরিশাল অঞ্চল থেকে রাজধানীঢাকাসহ সারাদেশে পণ্য পরিবহন করতে পারবেন। একই সঙ্গে পায়রা বন্দরকে ব্যবহার করে স্বল্প সময়ে ও কম খরচে ও আমদানি-রফতানি করতে পারবেন। ইতিমধ্যে এই বন্দর দিয়ে আমদানি রফতানি উৎসাহিত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এটা দিনে দিনে বাড়তে থাকবে এবং অর্থনীতির গতিও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। বিনিয়োগকারিরাও এখন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দিকে ঝুঁকছেন।
এদিকে শুধু পায়রা বন্দর নয়, মোংলা বন্দরও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখবে। যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটায় এখন মোংলাবন্দর ব্যবহার করা আগের চেয়ে সহজ হবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন,পদ্মা সেতুর মাধ্যমে বরিশাল বিভাগ অর্থনীতিতে সরাসরি দুই ধরনের সুবিধা পাচ্ছে। প্রথমত, বরিশাল বিভাগসহ পুরো দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হয়েছে। এতে ওই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তার লাভ করছে। বিনিয়োগ বাড়ছে। দ্বিতীয়ত, কৃষক সরাসরি উপকৃত হচ্ছে। তাদের উৎপাদিত কৃষি পণ্য সরাসরি ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে স্বল্প সময়ের পাঠাতে পারছে। এতে পণ্যের ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে।
গড়ে উঠছে শিল্প কারখানা, পদ্মা সেতু আর পায়রা বন্দরকে কেন্দ্র করে বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই ঘটবে শিল্প বিল্পব। ইতোমধ্যে শিল্পায়নের কাজও শুরু হয়েছে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও শিল্প গ্রুপ দ্রুততার সঙ্গে বরিশাল অঞ্চলে শিল্প কারখানা স্তাপনের জন্য জমি ক্রয় শুরু করেছে। কেউ কেউ প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজও শুরু করেছেন। পায়রা সেতু থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত মহাসড়কের আশপাশে দেশের ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠান মালিকরা জমি ক্রয় করেছেন। পায়রা বন্দর এলাকার আশপাশে জমি ক্রয় করেছে মদিনা গ্রুপ ও এমএম বিল্ডার্স নামের প্রতিষ্ঠান।
দক্ষিণের প্রধান সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটাকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে শতাধিক হোটেল- মোটেল। পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার খাজুরা, গঙ্গামতী, কাউয়ার চর, ভোলা ও পটুয়াখালীর চরাঞ্চল এবং বরিশাল ও এর আশপাশে জমি ক্রয় করেছে সিকদার গ্রুপ, ইউএস বাংলা, সেঞ্চুরি, বসুধা, ওয়েস্টার্নসহ কমপক্ষে ১৫টি বড় বড় শিল্পমালিক। তারা ওই অঞ্চলে নির্মাণ করবে বিভিন্ন ধরনের ভারি শিল্প-কলকারখানা ও বহুতল ভবন। কুয়াকাটায় ১৭ তলা বিশিষ্ট ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণের অপেক্ষায়। বরিশালের বিসিক শিল্পনগরীতে প্রথমবারের মতো পোশাক তৈরির কারখানা, বোতলজাত পানি পরিশোধনাগার ও কমফোর্টারের কারখানা গড়ে উঠেছে।
শুধু বরিশাল অঞ্চল নয়, ভাঙ্গা মোড় থেকে বরিশাল পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে এখন আর কোনো প্লট খালি নেই। সবগুলোই দেশের কোনো না কোনো শিল্প গ্রুপ বা বড় শিল্প উদ্যোক্তারা কিনে নিয়েছেন। গড়ে তুরছেন শিল্প প্রতিষ্ঠান। যে হারে এই অঞ্চলে শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে শুরু করেছে তাতে আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে বরিশাল অঞ্চলে বেকারত্বের হার কমে আসবে ১০ থেকে ৩০ ভাগে।
বরিশালকে বলা হয় ‘ধান-নদী-খাল’ এর দেশ। পদ্মা সেতুর কারণে সেই নামের ফল পেতে শুরু করেছেন ওই অঞ্চলের কৃষকরা। বরিশালে ধান, শাকসবজি, নারকেল, সুপারি, পেয়ারা, আমড়া, তরমুজের পাশাপাশি তেজপাতারও চাষ হয়। এতো এতো উৎপাদন হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে এতোদিন এসব পণ্য তারা বাজারজাত করতে পারতেন না। পদ্মা সেতু ঘিরে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের কারণে এখন এসব পণ্যের বাজারজাত সহজ হয়েছে। এখন অন্যান্য কৃষিপণ্যের পাশাপাশি এ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে তেজপাতা চাষের মহাপরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে দিন দিন বাড়ছে নারকেল ও সুপারির বাগানও।
চাঁদপুরকে ইলিশের রাজধানী বলা হলেও মূলত বরিশাল অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি ইলিশের উৎপাদন হয়। সারাদেশে যে ইলিশ বাজারজাত হয় তার সবচেয়ে বড় অংশই হয় বরিশাল অঞ্চল থেকে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নযনের কারণে দিনের মাছ দিনেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে যাচ্ছে। এমনকি কলকাতায়ও।
এতোদিন অবহেলিত থাকলেও পর্যটন শিল্পে সম্ভাবনাময় ছোট-বড় নদীর জনপদ বরিশাল বিভাগজুড়ে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভবনা তৈরি করেছে পদ্মা সেতু। পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ কুয়াকাটাকে একটা মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় নিয়ে সরকার সেটিকে আধুনিক ও পরিকল্পিত পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তুলছে। বরিশালে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও স্টেডিয়ামসহ বহু স্থাপনা নির্মাণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
কুয়াকাটা ছাড়াও বরিশালের দূর্গাসাগার, লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি, দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের বাড়ি, রায়পাশা কড়াপুরের মিয়া বাড়ি মসজিদ, গুঠিয়া মসজিদ, গৈলা মনসা মন্দির, বার্থি তারা মায়ের মন্দির, ভোলার জ্যাকব টাওয়ার, চর কুকরি মুকরি, নেছারাবাদের আটঘর কুড়িয়ানায় ভাসমান পেয়ারা বাজার ও নৌকার হাট, পটুয়াখালীর চর মন্তাজে দিনে দিনে বাড়েছে পর্যটকের সংখ্যা।
বরিশালের গ্রাম পর্যায়ে কাজ করার চিন্তা করছেন জানিয়ে রূপা ফ্যাব্রিক্স অ্যান্ড রূপা নিটওয়ারের কর্ণধার শামসুল আলম চুন্নু বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে রাজধানীর সঙ্গে বরিশালের দূরত্ব এখন মাত্র ৪ ঘণ্টার। তাই বরিশালের গ্রাম পর্যায়ে কাজ করার চিন্তা করছি। ইউজোম গ্রুপের স্বত্বাধিকারী মর্তুজা খান বলেন, অবশ্যই আমরা বরিশালে বিনিয়োগ করব। বরিশালের উন্নয়ন ঘটবে অভূতপূর্ব। পোশাক শিল্পকে আমরাই তো বরিশালে নিয়ে আসছি। শিগগিরই আমরা কার্যক্রম শুরু করব। বরিশাল চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে এ অঞ্চলে শিল্প কারখানা ও বিনিয়োগ। সুযোগ সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের। এরই মধ্যে বিভিন্ন শিল্প কারখানার মালিকরা জমি ক্রয় করেছেন।
বরিশাল বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি ও ফরচুন গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের পণ্যবাহী ট্রাকগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে আনা-নেয়ার সময় বিভিন্ন ফেরিঘাটে অনেক সময় দিনের পর দিন আটকে থাকত। যার জন্য আমাদের অনেক শিপমেন্ট বাতিল হতো। পদ্মা সেতু আমাদের সেই ভোগান্তি থেকে মুক্তি দিয়েছে।’