গত তিন/চার দিনের পত্র-পত্রিকা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের দেশটা একটা উদ্বেগের দেশ। ‘বিভ্রান্তি ছড়ানোর’ দায়ে অধিকার নামে একটি সংগঠনের সম্পাদক আদিলুর রহমান এবং পরিচালক নাসির উদ্দিন এলানের দুই বছর করে কারাদণ্ড দেয়ার পর একটা দেশি-বিদেশি চক্রে ঘুরছে এই উদ্বেগ। সময়টা আর্ন্তজালের । তাই তা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়েছে ঘৃণা আকারে। মনে হচ্ছে এই শাস্তি ঘোষণার চেয়ে গর্হিত কাজ আর কখনও হয়নি। এর প্রভাব পরিকল্পিতভাবে আরও দূরে নেয়া হচ্ছে।
পাঠক চলেন, আলোচনার শুরুতে যে ঘটনায় আদিলুর এবং এলানের শাস্তি হল সেটা দেখে আসি। ২০১৩ সালের ৫ মে। ওই দিন এবং এর পর দিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, হেফাজতে ইসলামীর ব্যানারে সেদিন রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বরে সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার মাদ্রাসা শিক্ষার্থী এসে জড়ো হয় মতিঝিলে। সমাবেশ শেষ হওয়ার নির্ধারিত সময় পরেও হেফাজত কর্মীরা শাপলা চত্বর ছাড়েনি।
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই সমাবেশ থেকে শুরু হয় তাণ্ডব। মতিঝিল থেকে শুরু করে পল্টন, বায়তুল মোকাররম, প্রেস ক্লাব, গুলিস্তানসহ অন্যান্য এলাকায় শুরু হয় জ্বালাও-পোড়াও। সরকারের কাছে তথ্য ছিলো, পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করতে হেফাজতের সমাবেশ শেষেও শাপলা চত্বরে থাকতে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমান্ড নির্দেশ দিয়েছিল। সেই নির্দেশেই হেফাজতের নেতারা মাদ্রাসার ছোট ছোট বাচ্চাদের রাস্তায় বসে থাকার নির্দেশ দেয়। এক পর্যায়ে গভীর রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হেফাজত কর্মীদের সরিয়ে দেয় শাপলা চত্বর থেকে। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে শাপলা চত্বরের একদিক খোলা রেখে বাকি তিন দিক ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কোনো ধরণের হামলা না করে শুধু সাউন্ড গ্রেনেড দিয়ে তাদের থামিয়ে দেয়।
এই ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা নিয়ে শুরু হয় নানা বিভ্রান্তি। বিএনপি-জামায়াতের নেতা এবং হেফাজতের নেতারা মিথ্যা প্রচার শুরু করেন। তারা বলতে থাকেন মতিঝিল চত্বরে লাশের স্তুপ হয়ে গেছে। হাজার হাজার হেফাজত কর্মীকে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী হত্যা করে লাশ গুম করেছে। তাদের এই অভিযোগের সঙ্গে সুর মিলিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আদিলুর ও এলানের ‘অধিকার’।
পুলিশের দাবি, মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজত ইসলামের সমাবেশে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ৬১ জন নিহত হওয়ার যে তালিকা প্রকাশ অধিকার দিয়েছে, তা অসম্পূর্ণ অসত্য এবং বিকৃত। গোয়েন্দা পুলিশের অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে, যে ৬১ জনের তালিকা প্রকাশ করেছে, এরমধ্যে পাঁচজনের নাম দুই বার করে এসেছে। চারজন নারায়ণগঞ্জ এবং দুজন চট্টগ্রামের হাটহাজারির গণ্ডগোলে মারা গিয়েছিলেন। একজন মারা যান অসুস্থ হয়ে। নাম আছে কিন্তু ঠিকানা নেই ১১ জনের। নাম এবং ঠিকানা ভুয়া সাত জনের। ১০নম্বর ক্রমিকে কারো নাম নেই। এছাড়া চারজন জীবিত আছেন, তাদের মধ্যে কেউ জেলখানায়, কেউ মাদ্রাসায় পড়ছেন, আবার কেউ চাকরি করছেন।
এমনিতেই ৩৫ জনের নাম বাদ পড়ে, যে ২৬ জন বাকি থাকে, তাদের কারোরই শাপলা চত্বরে পুলিশি অভিযানে মারা যাওয়ার কোন তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তথ্য অনুযায়ী তারা কেউ রাজনৈতিক দলের কর্মী, অফিস কর্মচারী, পথচারী ও পরিবহন শ্রমিক। তাদের পরিবারের কেউ আইনশৃংঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে এসে কোন অভিযোগ করেনি।
এই তালিকার ১ নম্বরে সিদ্দিকুর রহমান নামে একজনের নাম উল্লেখ রয়েছে। তিনি পুলিশের রিক্যুজিশন করা গাড়ির চালক। ৫ মে দুপুরে বায়তুল মোকাররম এলাকায় হেফাজতে ইসলামের হামলায় তিনি মারা যান। হেফাজতে ইসলামের হামলার শিকার হয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তা মারা গেলেও অধিকারের তালিকায় তার নাম ছিল না। হেফাজত কর্মীরা ৫ মে সারাদিন যে তাণ্ডব করেছিল, প্রতিবেদনে তার কোনো বর্ণনাও ছিল না।
অধিকারের কাছে এনিয়ে তথ্য চাওয়া হলে তারা কারো ব্যাপারে তথ্য দিতে রাজি হয়নি। পরে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে ২০১৩ সালে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে ‘বিভ্রান্তি ছড়ানোর’ অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। সেই ঘটনার প্রায় এক দশক পর গত বৃহস্পতিবার দুপুরে এই রায় ঘোষণা করা হয়।
এর পর থেকেই দেশি বিদেশি বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ চলছে। ওইদিন রাতেই ইইউ পার্লামেন্ট , অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ঢাকার মার্কিন দূতাবাস উদ্বেগ জানায়। সবার কথায় একই রকম সুর। “মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নথিবদ্ধ করাটা কোন অপরাধ নয়” “আদিলুর এবং এলানকে অতিদ্রুত মুক্তি দেয়া হোক”। কিন্তু কেউ সরকারি তদন্তের পয়েন্টগুলো উল্টেও দেখছে না। আদিলুরের দেয়া রিপোর্ট মুহূর্তে মহা সত্য হয়ে গেলো।
এত বড় বড় সংস্থা শুধুই উদ্বিগ্ন হলো, তারা যে কেউ একটি রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত রিপোর্ট এবং একটি সংগঠনের রিপোর্টের অমিলগুলো মিলিয়ে দেখলো না? কী অদ্ভুদ! কেউ একটি প্রশ্ন্ও তুললো না! নাম ঠিকানার প্রসঙ্গ না হয় বাদ দিলাম। এই প্রশ্নটা কী উঠতে পারতো না যে, জীবিত চারজনের নাম কেন মৃতের তালিকায়? যে পাঁচ জনের নাম দুইবার এসেছে তারা কেন ৬১তে যুক্ত হয়েছেন? পাঠক আপনারাই বলুন, যারা একটি সত্যিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করবে তাদের জন্যে এসব জবাব দেয়া কী কঠিন?
এখন আমার প্রশ্ন, তাহলে কেন এমন সব সরল প্রশ্নবিদ্ধ রিপোর্ট? কেউ প্রশ্ন তুলবে না নিশ্চিত হলেই কেবল এমন রিপোর্ট আসেতে পারে। এই এক রিপোর্ট ধরেই এখন আমরা নানা সরল কথা বলে ফেলতে পারবো। যেমন দেশ বিদেশে নিন্দার ঝড় তোলার জন্যেই এমন রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। কারা কবে কখন নিন্দা জানাবে সবই ছক কষা ছিলো। যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন এতে আদিলুরের কী লাভ ? তিনি তার দলের প্রতি আনুগত্য থেকে এই মিথ্যাচারের সোপান সাজিয়েছেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন তিনি।
কিন্তু যে বিষয়টি একটু চিন্তা করে বের করতে হবে, সেটা হচ্ছে শুধু আনুগত্য প্রকাশই কী আদিলুর চক্রের উদ্দেশ্য? এ জন্যে তো একটা ব্যানার নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ালেই হতো। তাহলে কেন এতো আয়োজন? পাঠক আমাদের আবারও ২০১৩তে ফিরতে হবে। হেফাজতের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল? চিন্তা করুন। নিশ্চয়ই আপনারা আমার সঙ্গে একমত তারা আসলে নানা অজুহাতে যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করতে চাইছিলেন। ১৯৭১এ যে পাহাড় সমান মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছিল তার বিচার শুরু করেছিল সরকার। আদিলুররা এসব চক্র সাজিয়ে সেই বিচার বন্ধ করতে চাইছিল। যে রুদ্ররোষ তারা পুষে রেখেছে আজও। আজ আমাদের যেসব বিদেশি বন্ধু বাংলাদেশ নিয়ে একতরফা মন্তব্য করছেন, তাদের জেনে রাখা দরকার, এই আদিলুরদের শেকড় অনেক গভীরে। প্রকাশ্যে বক্তৃতা বিবিৃতি তারা কম আসেন। তাদের মূল অস্ত্র অপপ্রচার অথবা মিথ্যাচার।
সম্প্রতি রিউমার স্ক্যানার নামে একটি আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট চেকিং নেটওয়ার্ক একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেখানে তথ্য উপাত্ত দিয়ে বলা হয়েছে গণমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্যের শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রিউমর স্ক্যানারের পর্যবেক্ষণ বলছে, বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় চলতি বছর ইন্টারনেটে রাজনৈতিক বিষয়ক ভুল তথ্যের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন জড়িয়ে গত আট মাসে ৭৪টি ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। নির্বাচন সামনে রেখে বিদেশি গণমাধ্যম, রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং তাদের নেতৃত্বকে উদ্ধৃত করে বা জড়িয়ে ভুয়া মন্তব্য বা তথ্য প্রচারের প্রবণতাও লক্ষ্য করেছে রিউমর স্ক্যানার। যার সংখ্যা ২৪টি।
লেখা বড় হচ্ছে । কিন্তু একটি কথা না বলে উপায় নেই। কথাটি আবারো সেই ইইউ ইপি বা অ্যামোনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মত সংগঠনের উদ্দেশ্যে বলা। বাংলাদেশের মত একটি উন্নয়নশীল দেশের উন্নত দেশের সহায়তা সবসময় দরকার। আপনাদের মত প্রতিষ্ঠান যদি কোন বাছ বিচার না করে একটি মিথ্যা প্রতিবেদন দেয়া প্রতিষ্ঠানকে সমর্থন করে তাহেলে সত্য লজ্জা পায়। আদিলুরের রিপোর্টটি কোন সাধারণ রিপোর্ট নয়। এরকম একটি সত্য রিপোর্ট একটি দেশে অথবা জাতির ভাবমূর্তি মাটিতে মিশিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। শুধু তাই নয় এতে আদিলুরদের মত কূটবুদ্ধির মানুষেরা আরও ভয়ঙ্কর মিথ্যাচারে উৎসাহিত হয়। তাই আপনাদের উচিতে একবার হলেও সত্যের কাছাকাছি আসা।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী