একটা দেশের জনবহুল শহরের মানুষের যাতায়াতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে গণপরিবহণ। বিশ্বের বড় বড় শহরগুলোতে গণপরিবহণ হচ্ছে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম। বিশেষ করে পিক আওয়ার বা ব্যস্ত সময়ে হাজার হাজার মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ির বদলে গণপরিবহণে যাতায়াত করে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ছুটে যান। বাড়িও ফিরেন একই ব্যবস্থায়। এতে করে ওই শহরের উপর যেমন ছোট ছোট যানবাহনের চাপ কম পড়ে তেমনি মানুষও স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করতে পারেন এবং নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে ঢাকা মহানগরীর মত জনবহুল শহরে সেই রকম গনপরিবহণ গড়ে উঠেনি স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছরেও। শাসক এসেছে, শাসক গিয়েছে, কিন্তু কেউ এ নিয়ে ভাবেনি। বরং স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশ রাষ্ট্র যেন পিছনের দিকে হাঁটতে শুরু করে।
মুক্তিযুদ্ধের পর ভঙ্গুর বাংলাদেশ যখন সবেমাত্র গড়ে তোলার কাজে হাত দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু ঠিক তখনই বাংলাদেশের আকাশে যেন কালো মেঘ ভর করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করে বাংলাদেশকে পিছনের দিকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করে খন্দকার মোশতাক থেকে শুরু করে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান , স্বৈরাশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি এবং পরবর্তিতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। পরবর্তীতে একই ধারবাহিকতা যেন বজায় রাখে ফখরুদ্দীন-মঈন উদ্দীনের সরকার। তারা জনগণের বাহবা নিতে দেশব্যাপী শুরু করে উচ্ছেদ অভিযান। যাতে হাজার হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কিন্তু এসব সরকারের কেউই বাংলাদেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। না হলে তো রাজধানীর ঢাকার মত জনবহুল শহরকে নিয়ে, শহরের যোগাযোগ অবকাঠামো নিয়ে ভাবতো, পরিকল্পনা গ্রহণ করতো। আমরা স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছরে সেরকম কোনো উদ্যোগ দেখিনি।
২০০৯ সালে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যখন মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে সরকার গঠন করলো, দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিলো তখন থেকেই দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আর্থসামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ সামগ্রিক উন্নয়নে কাজ শুরু করেন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সময়েই যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে গ্রহণ করা হয় স্বল্প, দীর্ঘ ও মধ্য মেয়াদী নানান পরিকল্পনা। বিশেষ করে রাজধানীর ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
রাজধানীবাসীর যাতায়াত সহজ করার মধ্য দিয়ে নিত্য দিনের ভোগান্তি দূর করার জন্য নেওয়া হয় নানান পরিকল্পনা। এরমধ্যে অন্যতম একটি মহাপরিকল্পনা হচ্ছে জনবহুল সিটি ঢাকাকে মেট্রোরেলের আওতায় নিয়ে আসা।
আমাদের পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় প্রথম মেট্রোরেল চালু হয় ১৯৮৪ সালে। আমাদের স্বাধীনতার মাত্র ১৪/১৫ বছরের মাথায়ই কলকাতার যাতায়াতে এমন চমৎকার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়। অথচ আমাদের তৎকালীন সরকার প্রধানরা একবারের জন্যও ভাবেননি রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন নিয়ে। তারা ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের আখের গোছাতে। অথচ ওই সময়ে যদি আমাদের সরকার প্রধানরা তাদের ভাবনার মধ্যে নিতেন এই যোগযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের বিষযটি তাহলে হয়তো আজকে এই একুশ শতকে এসে আমাদেরকে এতো ভোগান্তি পোহাতে হতো না।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেই প্রথম পরিকল্পনা গ্রহণ করে রাজধানীর যোগযোগ ব্যবস্থা নিয়ে। কিভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজ করে কর্মজীবী সাধারণ মানুষের তথা নগরবাসীর যাতায়াত ব্যবস্থাকে নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা যায় সেই লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। এরই অংশ হিসেবে পরিকল্পনা নেওয়া হয় রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল ব্যবস্থা চালু করার। এতে দ্রুততম সময়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাতায়াত করা যাবে। কম সময়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছা যাবে। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। যেহেতু সাবওয়ে নির্মাণ ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ তাই প্রথম ধাপে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় মেট্রোরেল (উড়াল) নির্মাণের।
মেট্রোরেল নির্মাণের অংশ হিসেবে ২০১৩ সালে জনবহুল ঢাকা মহানগরীর ক্রমবর্ধমান যানবাহন সমস্যা ও পথের দুঃসহ যানজট কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এই পরিকল্পনার অধীনেই প্রথমবারের মত ঢাকায় মেট্রো রেল স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। তার আগে ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের অন্যতম মেট্রোরেল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রথমে ঢাকায় তিনটি মেট্রোরেল লাইন স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হলেও ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সেই পরিকল্পনাকে সম্প্রসারিত করে তিনটির বদলে পাঁচটি লাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। মূলত রাজধানীকে পুরোপুরি একটি পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল যোগাযোগ ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসতেই এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
এরই অংশ হিসেবে প্রথম পর্যায়ে উত্তরা থেকে মতিঝিল পরবর্তিতে সেটি সম্প্রসারিত করে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত মেট্রোরেল-৬ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। উত্তরা থেকে মতিঝিল হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার এমআরটি লাইন-৬ নির্মাণে কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের ২৬ জুন। মেট্রোরেলের এই লাইনটি দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশ গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছেন। আর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশটি আগামী মাসেই খুলে দেওয়া হবে সাধারণের চলাচলের জন্য। প্রধানমন্ত্রী সেটি উদ্বোধনের কথা রয়েছে।
শুধু মেট্রোরেল লাইন-৬ নয়, জনবহুল রাজধানী ঢাকার নাগরিকদের যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত করতে ঢাকায় নির্মাণ করা হচ্ছে মেট্রোরেলের আরও ৫টি লাইন। ইতিমধ্যে লাইন-১ এর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বাকীগুলোর মধ্যে লাইন-২, লাইন-৪, লাইন-৫ উত্তর এবং লাইন-৫ দক্ষিণের কাজও শুরু হবে শিগগির।
এই যে একটা জনবহুল শহরের যোগাযোগের চেহারা বদলে দিতে, মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থাকে নাগালের মধ্যে নিয়ে আসতে এতো পদক্ষেপ কিন্ত শেক হাসিনার সরকারই নিয়েছে। অদম্য সাহস আর সদিচ্ছা না থাকলে এমন যুগান্তকারী পদক্ষে নেওয়া যায় না। কেউ নিতে পারে না। এটা তো আর বরার বিষয় না। এটা এখন প্রমাণিত। অতীতে তো কোনো সরকার প্রধানকে দেখা যায়নি এমন উদ্যোগের বিষয়ে ভাবতে বা চিন্তা করতে। কারণ দেশপ্রেম যদি জাগ্রত না থাকে তাহলে কেউই দেশ বা দেশের মানুষের জন্য বাবে না, চিন্তা করে না।
শেখ হাসিনা সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে শত বাধা উপক্ষো করে দেশটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তার কাছে দেশ এবং দেশের মানুষ সবার আগে।
আজকে যদি দীর্ঘমেয়াদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় না থাকতো তাহলে হয়তো যোগাযোগ অবকাঠামোর বিশেষ করে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে এমন পরিকল্পনা হতো না। কারণ পাঁচ বছর মেয়দী সরকার কখনই দীর্ঘ মেয়াদী কোনো পরিকল্পনা নিতে চায় না কিংবা নেয়ও না। এটা তো নিকট অতীতে আমরা দেখেছি।
শুধু যে মেট্রোরেল দিয়েই জনবহুল নগরীর যানজট সমস্যার সমাধান করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তা কিন্তু নয়, এই শহরকে যানজটমুক্ত করতে এবং নগরবাসীকে যাতায়াতের ক্ষেত্রে স্বস্তি দিতে শেখ হাসিনার সরকার রাজধানী ঢাকা ঘিরে আরও বহু পরিকল্পনা নিয়েছে। যার অনেকগুলো ইতিমধ্যে বাস্তবায়নও হয়েছে। এরমধ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে অন্যতম একটি। বিমানবন্দর সংলগ্ন কাউলা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডের কুতুবখালী পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ অর্থাৎ কাউলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত খুলে দেওয়া হয়েছে। গত ২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করেন। এরপর দিনই যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় এক্সপ্রেসওেয়েটি। যার সুফলও পাওয়া যাচ্ছে।
এতো কিছু সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র শেখ হাসিনার সরকারের উন্নয়ন নীতির কারণে।
এই উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে দরকার একটা স্থিতিশীল ও দীর্ঘমেয়াদের সরকার। না হলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। আমরা অতীতে দেখেছি , সরকার পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই থমকে যায় আগের সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো। তাই উন্নয়ন ধারবাহিকতা রাখতে গেলে প্রয়োজন সরকারের ধারাবাহিকতা।
লেখক- গণমাধ্যমকর্মী।