“বাংলাদেশের বাঙালিরা আমার বাবাকে মারবে, এটা আমাদের ধারণারও বাইরে ছিল”। ‘হাসিনা: আ ডটার’স টেল’ ছবিতে, ১০টি শব্দের আর্তনাদ ভরা একটি বাক্যটি বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা। ১৫ আগস্ট রাতে বাবা-মা-ভাই-স্বজনদের হারানোর ভয়ার্ত কলঙ্কিত ইতিহাস উঠে এসেছে ওই বাক্যে। প্রতিটি শব্দ আর কষ্ঠস্বরে ছিল প্রিয়জন হারানোর বেদনা। শেখ রেহানার এই ১০ শব্দের বাক্য, আমাদেরও প্রতি মুহূর্ত প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে রাখে। যে পিতা আমাদের মুক্তি দিয়েছিলেন, তাঁকেই আমরা বাঁচাতে পারেনি- এই অপরাধবোধ বাঙালিদের বইয়ে বেড়াতে হবে অনন্তকাল।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যখন দেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ ঘাতকের হাতে। তখন দেশের মানুষ তো বটেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বাংলাদেশের প্রকৃত খবর জানতো না। আর বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ বা বিচার চাওয়া ছিল দুঃস্বপ্ন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে জাতির পিতার হত্যার প্রথম বিচারের দাবি জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা। ১৯৭৯ সালে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা খুনিদের বিচারের দাবি উত্থাপন করেন তিনি। এটি ছিল বিশ্বদরবারে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রথম আহ্বান।
আন্তর্জাতিক খ্যতিসম্পন্ন ব্রিটিশ আইনজীবীর স্যার টমাস উইলিয়ামসের সম্মতি নেয়ার জন্য ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে ‘হাউস অব কমন্সে’ গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন শেখ রেহানা ও তার স্বামী ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিক। তিনি এই প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর পঞ্চম শাহাদাতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে ১৬ আগস্ট ১৯৮০ পূর্ব লন্ডনের মাইল্যান্ড ইয়র্ক হলে যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালিদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি এবং স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসি এমপি প্রধান বক্তা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যা সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য বিশ্বখ্যাত আইনজ্ঞদের নিয়ে ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর লন্ডনে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৮২ সালের ২০ মার্চ আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গ এবং চার জাতীয় নেতার হত্যা সম্পর্কে প্রাথমিক রিপোর্ট পেশ করে।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের দাবিতে দৃঢ় ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের আবার ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। শুরু হয় আইনি প্রক্রিয়া। ওই বছরের ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি’ অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১২ মার্চ বিচার শুরু হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর বিচারক কাজী গোলাম রসুল মামলার রায়ে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন।
১৯৭৯ সালে সুইডেনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের যে দাবি তুলেছিলেন শেখ রেহানা, তা বাস্তবায়ন হয় ৩১ বছর পর। যদিও সব আসামিকে এখনও ফাঁসিতে ঝোলানো যায়নি। পলাতক আসামিদের দেশে ফিরেয়ে এনে আদালতের রায় কাযকর হলে বাঙালি জাতি হিসেবে আমরাও কলঙ্কমুক্ত হবো।
জাতির পিতাকে হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলন করে সফল হওয়া শেখ রাহানার ৬৯তম জন্মদিন আজ (১৩ সেপ্টেম্বর)। ১৯৫৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বঙ্গবন্ধু পরিবারের কনিষ্ঠ মেয়ে রেহানার নাম রাখা হয়, মায়ের ডাক নাম রেণুর প্রথম অক্ষর আর বড় বোন হাসিনার শেষের অক্ষর অক্ষুণ্ণ রেখে। পারিবারিক পদবি যুক্ত হয়ে পরিপূর্ণ নাম হয় শেখ রেহানা। অতি আদরের ছোট ভাই রাসেলের কাছে যিনি ছিলেন ‘দেনা’ আপা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা যখন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করে, তখন তিনি বড় বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে জার্মানির কার্লসরুইয়ে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু তাদের অনেক চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিতে হয়েছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন আরেক বাঙালি পরিবারের সঙ্গে রুম ভাগাভাগি করে। আর্থিক অনটনের কারণে চাইলেই একক বাড়ি ভাড়া করে থাকার সামর্থ্য তাদের ছিল না। তাই শেখ রেহানাও বিভিন্ন জায়গায় চাকরির চেষ্টা করছিলেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনেও কর্মখালি দেখে চেষ্টা করেছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি। লন্ডনে মেট্রো ও বাসে যাতায়াত করতে হয়েছে তাঁকে।
শেখ রেহানা নিজেই লিখেছেন- “লন্ডনে আসার পর চাকরির জন্য যখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি, তখন কত পরিচিতজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, সবাই এড়িয়ে যেতে চায়। চাকরি নিলাম একটি লাইব্রেরি ও পাবলিশার্স কোম্পানিতে। এর পর তো অনেক পথ পাড়ি দিলাম। আমাদের বাসায় রাত-দিন আসা-যাওয়া করত এমন ব্যক্তিও রাস্তায় দেখা হলে চোখ ফিরিয়ে নিত। অবশ্য কেউ কেউ সাহায্যও করেছে।”
ঘাতকরা অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখিয়েছিল ঠিকই কিন্তু বাংলার সাধারণ মানুষ কখনও বঙ্গবন্ধুকে ভুলে যায়নি। অনেক লড়াই সংগ্রামের পর ১৯৯৬ সালে আবারও ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় কিন্তু কখনই সরকার বা রাজনীতিতে দেখা যায়নি শেখ রেহানাকে। তবে মানুষের কল্যাণে বড় বোন শেখ হাসিনার পাশে সব সময়ই পাশে রয়েছেন শেখ রেহানা। এই বিষয়ে শেখ রেহানা নিজেই বলেছেন- “আমরা দুবোন একে অপরের পাশে আছি। দুজন দুজনকে সাহায্য করি। খুব ভালোবাসি।” আর বড় বোন শেখ হাসিনাও অকপটে বলে থাকেন- “রেহানা ছাড়া তিনি পরিপূর্ণ নন। রেহানার মাঝে তিনি তার মায়ের ছায়া দেখতে পান। সুযোগ্য মায়ের যোগ্য উত্তরসূরি শেখ রেহানা।”
অতি সাধারণ মানুষের মতোই জীবনযাপন করেন শেখ রেহানা। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের কাছে ‘ছোট আপা’ হিসেবে পরিচিত তিনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলের পাশে থেকে অনুপ্রেরণা, সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন শেখ রেহানা। ২০২২ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে শেখ রেহানা শিশুদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমার বোন শেখ হাসিনা প্রবাস থেকে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন দেশে ফিরবেন সিংহের মতো। ঘাতকদের ভয় করলে চলবে না। তাই আমি তাকে সিংহ বলেই ডাকি।’ ১/১১ এর সময় শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের পর যখন আওয়ামী লীগকে ভাঙার চেষ্টা হয়, শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্র হয়। তখন পর্দার আড়ালে থেকে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে সেই সংকট থেকে জাতিকে উদ্ধারে বড় ভূমিকা রাখেন শেখ রেহানা।
শেখ রেহানা একজন ‘রত্নগর্ভা মা’। সন্তানদের তিনি গড়ে তুলেছেন মায়ের শিক্ষা ও বাবার আদর্শে। মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একজন গুরুত্বপূর্ণ এমপি। ছেলে রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি একজন গবেষক এবং আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) ট্রাস্টি হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি দেখভাল করেন। ছোট মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রুপন্তী মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে পাশ্চাত্যে সাড়া ফেলেছেন।
নিরহংকারের অন্যতম উদাহরণ হলেন শেখ রেহানা। বড় বোন চারবারের প্রধানমন্ত্রী অথচ তার পথচলায় এর কোনো চিহ্ন নেই। সব সময় ভাবেন দেশের মানুষের কল্যাণ। বড় বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িটি স্মৃতি জাদুঘর করে দেশের জনগণের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছেন শেখ রেহানা। একইভাবে ধানমন্ডিতে তার নামে বরাদ্দ বাড়িটিও দান করে দিয়েছেন দেশের কাজে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।