মেহেরপুর জেলায় আশংকাজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। পৌরসভা থেকে মশক নিধন স্প্রে না করা, জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে আগাম প্রস্তুতি না নেওয়া ও জনসচেতনতামুলক প্রচারণা না থাকায় মেহেরপুরে আশংকাজনক হারে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু।
প্রতিদিনই মেহেরপুর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, গাংনী ও মুজিবনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছাড়াও ক্লিনিকগুলোতে ভর্তি হচ্ছেন নতুন নতুন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী।
গত ২৪ ঘন্টায় গত শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) থেকে গতকাল রবিবার (২২ সেপ্টেস্বর) সকাল পর্যন্ত মেহেরপুর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ৯ জন, গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫ ও মুজিবনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
বর্তমানে গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৬ জন, মেহেরপুর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ২৫ ও মুজিবনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫ জন ডেঙ্গু রোগী।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। গত আগস্ট মাসে মেহেরপুর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ৮০, গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬৬ ও মুজিবনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫ জনসহ মোট ১৫১ জন ডেঙ্গু রোগী সনাক্ত করা হয়েছে।
চলতি সেপ্টেম্বর মাসের গতকাল ২২ তারিখ পর্যন্ত মেহেরপুর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ১২৪ জন, গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৭৭ জন ও মুজিবনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০ জনসহ ২১১ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন।
জানা গেছে, আবহাওয়াজনিত কারণে সর্দি-কাশি ও জ্বর দেখা দিয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই গ্রাম্য হাতুড়ে ডাক্তারদের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকে। পরে অবস্থা গুরুতর হলে হাসপাতালে আসছেন। এখানে রক্ত পরীক্ষা করলেই মিলছে ডেঙ্গুর জীবাণু। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখ পর্যন্ত জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৩৬১ জন। এ মাসে আরও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা।
হাসপাতালগুলোতে সরেজমিনে গিয়ে সাধারণ রোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছ, সাধারণ রোগীদের সাথে রাখা হয়েছে ডেঙ্গু রোগীদের। এতে সাধারণ রোগীরা রয়েছে চরম ঝুঁকির মধ্যে।
স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, স্থান সাংকুলাণ না হওয়ায় রোগীদের এক সাথে রাখা হয়েছে। তবে, ডেঙ্গু রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রয়েছে হাসপাতালে।
সূত্র মতে জানা গেছে, মেহেরপুর পৌরসভা ও গাংনী পৌরসভার পক্ষ থেকে ফগার মেশিন দিয়ে স্প্রে করার কথা থাকলেও বিগত কয়েক বছর কয়েক কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও মশক নিধনে পৌরসভা দুটি সেটা করা হয়নি। ফগার মেশিন দিয়ে মশক নিধন ও স্প্রে করার পাশাপাশি ওয়ার্ড পর্যায়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এতে এই দুই পৌরসভার মেয়র এই খাত থেকে প্রায় কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়া ডেঙ্গু সংক্রমণ ঠেকাতে বা সতর্কতামূলক প্রচারণার পদক্ষেপ নিতে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ও ইউনিয়ন পরিষদ গুলোও কোনো প্রচারণা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। মশক নিধনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ায় শহর কিংবা গ্রাম; সবখানেই ঝোপ জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। এসব স্থান মশার প্রজননকেন্দ্র হিসেবে ধরা যায়। পৌর কর্তৃপক্ষ আজও কোনও প্রচারণা চালাচ্ছেন না। এদিকে মেহেরপুর-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণ কাজের ধীর গতির কারণেও গাংনী পৌরসভা এলাকায় বেড়েছে এডিশ মশা।
গাংনী উপজেলা শহরে রাস্তার দু পাশে খুড়ে ফেল রাখার কারনে স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা ডিম পাড়ছে। এখান থেকে উৎপাদিত এডিশ মশা এখন সবখানেই ছড়িয়ে পড়ছে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত গাংনী পৌর এলাকার বাজার পাড়ার আজিজুল হক রানি, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশ এর গাংনীর এরিয়া অফিসের সমন্বয়ক হেলাল উদ্দিন, সাংবাদিক মাহবুব আলম, গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তব্যরত নার্স শাকিলা বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে হঠাৎ ১০৩-১০৪ জ্বর দেখা দেয়। জ্বর কমে গেলেও ডেঙ্গুর ভয়াবহতা রয়ে যায়। শুরু হয় পেটব্যথা, মাথাব্যথা, বমি, মাথা ঘোরা, পাতলা পায়খানা ও শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া।
গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) চিকিৎসক আব্দুল আল মারুফ বলেন, অনেকে জ্বর নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসছেন। তাদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে রক্ত পরীক্ষা করার। সেইসঙ্গে স্বাস্থ্য সচেতনতার কথাও বলা হচ্ছে। মশারি ব্যবহার করারও পরামর্শ দেওয়া হয়।
রোগীদের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু হোক আর হেমোরেজিক হোক, এই সময় জ্বর হলেই পরীক্ষা করিয়ে ওষুধ নেওয়া উচিত। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আবারও ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে রোগীর অবস্থা বেশি ঝুঁকিতে পড়তে পারে। তাই জ্বর হলেই সতর্ক থাকতে হবে।
মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসক জমির মোহাম্মদ হাসিবুর সাত্তার বলেন, ‘এ পর্যন্ত গত এক মাস বাইশ দিনে জেলায় ৩৬১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় কীট, আলাদা ওয়ার্ডসহ সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। তবে সবখানে প্রচারণা চালানো প্রয়োজন; যাতে সবাই ডেঙ্গু নিয়ে সতর্ক হন। সেক্ষেত্রে বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখা ও নর্দমায় নোংরা পানি বা জলাবদ্ধতা না থাকে, তার ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।’