জি-২০ সম্মেলনের ফাঁকেই দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। শুক্রবার দিল্লি সফরে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতিবেশি দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাই সাউথ ব্লক বা হায়দরাবাদ হাউসে নয়, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ৭, লোককল্যাণ মার্গেই এই বৈঠক হয়। আন্তরিকতার বার্তা দিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে গৃহ অভ্যর্থনার আয়োজন করেন নরেন্দ্র মোদি।
বাংলাদেশ জি-২০-র সদস্য নয়, তবে সভাপতিত্বের দায়িত্ব পাওয়ার পরই ভারতের পক্ষে প্রতিবেশী দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশই এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেয়েছে। অন্য দেশগুলো হলো মিশর, মরিশাস, নেদারল্যান্ডস, নাইজেরিয়া, ওমান, সিঙ্গাপুর, স্পেন এবং আরব আমিরাত। এর মধ্যে জি-২০ সংক্রান্ত সব সভাতেই বাংলাদেশ অংশ নিয়েছে।
ভারতের কাছে বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। বাংলাদেশকে অতিথি হিসেবে ভারতের আমন্ত্রণে দেশটি তার নিকটতম প্রতিবেশীকে ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ হিসেবে উচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের এই বন্ধুত্ব সর্বজনস্বীকৃত। অশান্তিপূর্ণ উত্তর-পূর্ব ভারতে শান্তি এনে দিয়েছে বাংলাদেশ। এর ফলে নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশ ভারতের কাছে অপরিহার্য অংশীদার হয়ে উঠেছে।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর, রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। অনেকেরই ধারণা, নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের বিপরীতে ভারতকে সক্রিয় করতে সক্ষম হবেন শেখ হাসিনা। কারণ জি-২০ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী দেশের নেতারা আসবেন, যেখানে ‘বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভুল বুঝাবুঝি থাকলে সেটিরও অবসান হবে-এমন প্রত্যাশাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহা. রুহুল আমীন জানান, বাংলাদেশের জন্যও এ সামিটে অংশ নেয়ার সুযোগটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানে আলোচনা কিংবা দরকষাকষির মাধ্যমে কারও সাথে দূরত্ব তৈরি থাকলে সেটি কমিয়ে আনার সুযোগ পাবে বাংলাদেশ।
আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্ল্যাহ বলেন, “আজকে যার সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝি, কে জানে কাল হয়তো তার অবসানও হতে পারে।”
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক জানিয়েছেন, দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুধু বাংলাদেশকেই সামিটে আমন্ত্রণ করা হয়েছে যেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এই সুযোগে বাংলাদেশ সাইড লাইনে প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে নিজেদের বিষয়ে কথা বলার সুযোগ তৈরি করে নিতে পারবে। অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে বিশ্ব নেতারা কী ভাবছেন, সেটি যেমন জানার সুযোগ আসবে, তেমনি রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও কথা বলার সুযোগ হবে আনুষ্ঠানিক কিংবা অনানুষ্ঠানিক আলোচনায়। বাংলাদেশের জন্য এগুলো খবুই গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া বর্তমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইন্দো প্যাসিফিক বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আর গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে যে কজন নেতৃত্ব প্রশংসিত হচ্ছেন তার মধ্যে শেখ হাসিনা অন্যতম।
২০২১-২২ সালে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মহামারি সত্ত্বেও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২০১৯ সালের ৯ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০২১ সালে ১৪ শতাংশ হারে বেড়েছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক অংশীদারত্ব বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি হিসেবে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে ভারতের জন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জিওনাল কানেক্টিভিটি বাড়াতে বাংলাদেশ মোংলা ও চট্টগ্রাম পোর্ট থেকে শুরু করে দুই দেশের বাণিজ্যের জন্য বেশ কিছু নতুন পোর্ট অব কল এবং প্রোটোকল রুটে যুক্ত করা হয়েছে। সড়ক, রেল, সমুদ্র সব রুটেই ভারতের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ বৃদ্ধিতে ট্রানজিট দিয়েছে বাংলাদেশ।
জি-২০ সম্মেলনে অংশ নেওয়া বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক নীতিকে প্রভাবিত করার একটি বিশেষ সুযোগ হিসেবে দেখছে আন্তজার্তিক বিশ্লেষকরা। এই সম্মেলন উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির সাথে সাক্ষাতে আলোচনায় উঠে এসেছে তিস্তা ইস্যু। যা বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে এই দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে। ভারতীয় মুদ্রায় জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধ, খাদ্য পণ্যের আমদানিতে কোটা নির্ধারণ, ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) অর্থায়নের প্রকল্পে শর্ত জটিলতা নিরসন প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
এই সম্মেলনে ভারত ছাড়াও আর্জেন্টিনা, কানাডা, কোরিয়া, সংযুক্ত আবর আমিরাত, সৌদি আরবের সরকার প্রধানের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাইডলাইনে আলোচনা হতে পারে। এসব দেশের সাথে আলোচনায় বিনিয়োগ, রপ্তানি, জনশক্তি রপ্তানি, খাদ্য, জ্বালানি, সার, পর্যটন ও সংস্কৃতি, নারী নেতৃত্ব উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে।
সৌদি প্রতিষ্ঠান এসিডব্লিউএ পাওয়ার কোম্পানি ৩০০ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ৪৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চায়। গত ৬-৭ বছরে সৌদি আবরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু নানান জটিলতায় সৌদি বিনিয়োগ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে জি-২০ সম্মেলনে সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বিনিয়োগের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। তাছাড়া সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানি, জ্বালানি তেল কেনা, হজ ব্যবস্থাপনা সহজ করার বিষয়ে আলোচনা হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জনশক্তি রপ্তানি ইস্যুতে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা হতে পারে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কোরিয়ার সঙ্গে।
বাংলাদেশে কানাডিয়ান বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) দেশটিতে কান্ট্রি ডেস্ক চালু করেছে। বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত বিনিয়োগ সুবিধা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে কানাডার বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। এছাড়াও বৈশ্বিক রাজনীতিতে বাংলাদশের করণীয় কি হতে পারে সে বিষয়েও কথা বলার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে এই সম্মেলন।