বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের (এসইএআরও) আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে নির্বাচিত হলে এ অঞ্চলের জনস্বাস্থ্য নীতি ও অনুশীলনে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় কাজ করার পরিকল্পনা করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। সম্প্রতি এসইএআরও আঞ্চলিক পরিচালক পদে তাকে মনোনয়ন দেয় সরকার।
এসইএআরও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ছয়টি আঞ্চলিক অফিসের মধ্যে একটি, যা সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত। এর সদস্য দেশগুলো হলো- বাংলাদেশ, ভুটান, উত্তর কোরিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড এবং পূর্ব তিমুর।
প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, একটু মমতা পেলেই তারা নিজেদের প্রমাণ করতে পারেন। এ দেশে এমনই এক বাস্তবতা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য উত্তরসূরি সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। তিনি শুধু বাংলাদেশই নয়, সারা বিশ্বে অটিস্টিক শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রথমসারির ব্যক্তিত্ব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের এই সদস্য যুক্তরাষ্ট্রেরে ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্লিনিক্যাল মনস্তত্বে স্নাতকোত্তার এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি নেন স্কুল মনস্তত্বে। সেখানে পড়তে পড়তে গবেষণা শুরু করেন বাংলাদেশের নারীদের উন্নয়ন নিয়ে। তাঁর এই গবেষণা শ্রেষ্ঠ সায়েন্টিফিক উপস্থাপনা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ফ্লোরিডার একাডেমি অব সায়েন্স।
ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শেষে অটিজম নিয়ে কাজ শুরু করেন পুতুল। ২০০৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাঁকে হু অ্যাক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড দেয়। একজন স্বীকৃত মনোবিজ্ঞানী এবং অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবেই তাঁর এ অর্জন। শিশুদের অটিজম এবং স্নায়ুবিক জটিলতাসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে তিনি কাজ শুরু করেন ২০০৮ সালে। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর কাজ বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়।
আমাদের দেশে দেড় দশক আগেও অটিস্টিক শিশুদের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের উদাসীনতা যে কোন পর্যায়ে ছিল তা জানেন একমাত্র ভুক্তভোগীরাই। শুধু যে মর্মান্তিকভাবে তারা অবহেলিত হয়েছে তাই নয়, হতে হয়েছে পরিবার ও সমাজের চরম নেতিবাচক মানসিকতার শিকার। পরিস্থিতি এমন জায়গায় চলে গিয়েছিল যে, অটিস্টিক শিশুরা যেনো সমাজের বোঝা। সেই সব পরিবারকে আশার আলো দেখিয়েছেন পুতুল। অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশুদের ওপর দৃষ্টিভঙ্গিগত ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছেন তিনি। এখন সাধারণত কেউ অটিস্টিক বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের লুকিয়ে রাখে না।
পুতুল সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান ডা. পুনম ক্ষেত্রপাল বলেছিলেন, ‘পুতুল তাঁর নিজের দেশ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অ্যাজেন্ডায় অটিজম ইস্যুকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে যে কাজ করছেন তা অভূতপূর্ব। একই সঙ্গে অটিজম বিষয়ে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক মনোযোগ আকর্ষণ করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর কাজের উপর ভিত্তি করে, বাংলাদেশে অটিজম দূর করার কর্মসূচি নেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।’
ড. ক্ষেত্রপাল বলেন, ‘পুতুলের চেষ্টায় এই অঞ্চলের ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অটিজম নিয়ে বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। দশটি মেডিক্যাল কলেজে শিশুদের অটিজমজনিত সমস্যা শনাক্ত করার জন্যে বিশেষ ইউনিট চালু করা হয়েছে।’
শিশুদের অটিজম এবং স্নায়ুবিক জটিলতা-সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পুতুলকে ‘হু অ্যাক্সিলেন্স’ অ্যাওয়ার্ড দেয় ২০১৪ সালে। বিশ্বখ্যাত এই মনস্তত্ত্ববিদ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অটিজম স্পিকসের পরামর্শক। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ডিজিটাল ক্ষমতায়নের জন্য ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক জুরি বোর্ডেরও সভাপতি তিনি। তিনি মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ পরামর্শক প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত হন ২০১৩ সালে।
পুতুলের পৃথিবী অনেক বড়। বাংলাদেশ তাঁর কারণেই অটিজম সচেতনতায় বিশ্বের কাছে মডেল। এশীয় অটিজম নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার অন্যতম কারিগর পুতুলের উদ্যোগেই ২০১১ সালে ঢাকায় প্রথমবারের মতো অটিজমবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে অটিজম নিয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অটিজম বিষয়ক ‘শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
২০২০ সালে পুতুল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলোর জোট ক্লাইমেট ভারনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) থিমেটিক রাষ্ট্রদূত নির্বাচিত হন। করোনা মহামারির সময় ফোরামের কাজে তাঁর সম্পৃক্ততা ব্যাপক প্রশংসিত হয়। স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যেও সারাবিশ্বে তিনি অটিস্টিক শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অটিজম আক্রান্ত শিশু ও তাদের পরিবারের জন্য স্বাস্থ্যসেবা এবং আর্থ-সামাজিক সহায়তা বৃদ্ধির প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল তাঁর উদ্যোগেই। কয়েক বছর আগে জাতিসংঘে প্রতিবন্ধি বিষয়ক এক সভায় বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি একজন প্রতিবন্ধীর জীবন বদলে দিতে পারে। এটি সভ্যতার দায়িত্ববোধও বটে।’
নিজের প্রতিভা, চেষ্টা ও শ্রম দিয়ে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও কুসংস্কার এড়িয়ে মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সহায়তা করছেন পুতুল। অনগ্রসর এসব মানুষের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করছেন। যাতে তারা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রের মূল ধারায় যুক্ত হতে পারেন। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের ১৩টি মন্ত্রণালয় অটিজম সমস্যা সমাধানে একযোগে কাজ করছে। অটিজমের উপর ছয় স্তরে কর্মসূচি বাস্তবায়ন হচ্ছে।
অটিজম দূর করতে কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যবসা-শিল্প প্রতিষ্ঠানকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সেন্টার ফর নিউরোডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অটিজম ইন চিল্ড্রেন সেন্টার’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি’ বিভাগ এবং অটিস্টিকদের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট চালু করা হয়েছে। কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষক, প্রশিক্ষক, চিকিৎসক, সেবাদানকারী ও মা-বাবার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। এছাড়া অটিস্টিকদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চিত্রকর্ম প্রদর্শনীসহ তাদের সৃষ্টিশীল মনের বিকাশে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে।
২০১৭ সালে প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক চ্যাম্পিয়ন পুরস্কারে ভূষিত হন পুতুল। নিজের সক্রিয়তার জন্য ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট প্রাক্তন শিক্ষার্থী পদক প্রাপ্ত হন। দ্যা রয়েল হাউস অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স, চ্যাথাম হাউজের এসোসিয়েটেড ফেলো তিনি। এই প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশের সরকারকে টেকসই, নিরাপদ, সমৃদ্ধ ও ন্যায়সঙ্গত সমাজ গাড়ায় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে। অটিজম নিয়ে অবদান রাখায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে বিশেষ সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়।