সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সুপারিশ থাকায় অনলাইন জুয়ার গডফাদার মাদার আলী ওরফে মাদার মাস্টারকে পুলিশ তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও গ্রেফতার করতে পারেনি। ফরহাদ হোসেন ও তার স্ত্রী মোনালিসা হোসেন সরাসরি অনলইন জুয়াড়ীদের সাথে সখ্যতা বজায় রেখে মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নিতেন বলে তিনি অনেককেই গ্রেফতার থেকে বাঁচিয়েছেন। তার অন্যতম মাদার আলী। মেহেরপুর প্রতিদিনে তার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ হলে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই সময় তাকে শোকজ করেছিলেন। কিন্তু এখনও তিনি বীরদর্পে সাহেবনগর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করে যাচ্ছেন।
এনিয়ে ওই সময় পুলিশের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করলেও তা মুখ বুজে মেনে নিয়েছেন অনেক কর্মকর্তা। পুলিশের এক কর্মকর্তা অনলাইন জুয়ার দুর্গে অভিযান চালানোর ওই সময় মেহেরপুর প্রতিদিনকে এমনটি জানিয়েছিলেন। জেলা পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী সরাসরি পুলিশ সুপারকে ফোন করে মাদার মাস্টারকে গ্রেফতার না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যে কারণে পুলিশের কাছে দেওয়া অনলাইন জুয়ার এজেন্টের জবানবন্দীতে মাদার মাস্টারের নাম থাকলেও পরে সে নাম কেটে দেওয়া হয়। কারণ হিসেবে তিনি আরও বলেছিলেন, মাদার আলী মহাজনপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আমাম হোসেন মিলুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আমাম হোসেন মিলু মুলত অনলাইন জুয়ার মূল পৃষ্টপোষক ছিলেন এবং তিনি ছিলেন সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রীর ফরহাদ হোসেনের ডান হাত। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠান করতে মাদার আলী মিলুকে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগীতা করতেন। সবসময় মিলুর পাশাপাশি থাকতেন। এরকম বেশ কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হতেও দেখা গেছে। এমনকি সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন পাশে দাড়িয়েও অনেক ছবি তাকে ফেসবুকে দিতে দেখা গিয়েছে।
আরও পড়ুন ধরাছোঁয়ার বাইরে অনলাইন জুয়ার অন্যতম চার হোতা মুকুল-জামান-নুরুল-মাদার
মাদার আলীকে পুলিশ গ্রেফতার না করলেও তার ছেলে দেশের অনলাইন জুয়ার সেকেন্ড ম্যান খ্যাত মোস্তাক নাহিদ অনিককে দুই সহযোগীসহ পুলিশ ২০২৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আটক করে।
অনিককে আটকের পর পুলিশ জানিয়েছিল, অনিকের কাছে থেকে দুটি এবং হাসিবের কাছে থেকে একটি অনলাইন জুয়ার চ্যানেলসহ হাতেনাতে তাদের গ্রেফতার করা হয়। অনিকের কাছে দুটি অনলাইন চ্যানেলের মধ্যে একটি তার নামে এবং অপরটি তার পিতা মাদারের নামে রয়েছে। প্রতিটি চ্যানেলে গড়ে প্রতিদিন আয় হয় ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা। পুলিশ আরো জানায়, মোস্তাক নাহিদ অনিক বাংলাদেশের অনলাইন জুয়া কার্যক্রমের সেকেণ্ড ম্যান হিসেবে সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে আসছিলো। অনিক ওয়ান এক্স বেট, মেল বেট ও লাইন বেটের সকল চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ করেন। তার কাছে থেকে অনিক নাগাদ, লিনিয়া মাদার নামের দুটি মূল চ্যানেল, এবং হাসিবের কাছে থেকে সাজিব বিকাশ নামের একটি চ্যানেল সহ ব্যবহৃত মোবাইল ও সিম উদ্ধার করেছে।
এর আগে ২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বও মেহেরপুর প্রতিদিন ‘মাদার-নুরুল-জামান-মুকুল অনলাইন জুয়ার গডফাদার’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে। সংবাদের পরপরই মাদার আলী মেহেরপুর প্রতিদিন কার্যালয়ে ছুটে আসেন। প্রথমদিকে অনলাইন জুয়ার কথা অস্বীকার করলেও এক পর্যায়ে স্বীকার করেন তিনি অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত ছিলেন।
কে এই মাদার আলী
মাদার আলী ওরফে মাদার মাস্টার। তিনি কোমরপুরের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও সদর উপজেলার সাহেবপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কর্মরত। সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের ডান হাত মুজিবনগর উপজেলার অপসারিত চেয়ারম্যান আমাম হোসেন মিলুর ঘনিষ্ট সহচর ছিলেন মাদার আলী। ছোট একটা চাকরি করলেও কোটি টাকা খরচ করে ২তলা বিশিষ্ট রাজপ্রাসাদ বানিয়েছেন তিনি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১০ থেকে ১২টি লাইনবেট সাইটের এজেন্ট তিনি। তিনি নিজেও এই লেনদেনের সাথে জড়িত এবং তার ছেলে অনিক ঢাকা থেকে তার এসকল লেনদেন করে থাকেন বলে তার ছেলে পুলিশের কাছে আটক হওয়ার স্বীকারোক্তি দিয়েছিলো।
পড়ুন অনলাইন জুয়ার সেকেণ্ড ম্যান অনিক ও তার দুই সহযোগী আটক
দুই বছর আগে অনলাইন জুয়ার সংবাদ প্রকাশ ও পুলিশের অভিযান শুরু হওয়ার পর মেহেরপুর প্রতিদিনের সাথে যোগাযোগ করেন ক্ষতিগ্রস্থ এক অনলাইন জুয়ার এজেন্ট। তিনি মেহেরপুর প্রতিদিনকে দেওয়া ভিডিও সাক্ষাৎকারে দুর্লভ কিছু স্বীকারোক্তি দেন। স্বীকারোক্তিতে যাদের নাম জানান, তাদের মধ্যে ২০২০ সালে করোনাকালীন সময়ে মূলত কয়েকজন অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়েন। তারা হলেন- কোমরপুর গ্রামের মুকুল ইসলাম, নুরুজ্জামান ওরফে জামান মাস্টার, নুরুল ইসলাম ওরফে লালন মাস্টার, মাদার আলী ওরফে মাদার মাস্টার এদের অন্যতম। প্রায় অর্ধশত অনলাইন জুয়ার এজেন্ট পুলিশ গ্রেফতার করলেও এই চারজনের কাউকেই এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করেনি।
তাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে অনলাইন জুয়ার দূর্গ। তারাও হয়েছেন কোটিপতি। এদের রয়েছে প্রায় দু’ডজন এজেন্ট। যারা এই চারজনের চ্যানেল নিয়ে নিয়মিত অবৈধ ট্র্যানজেকশন করে চলেছেন।
পুলিশ সুপারের নামে স্থানীয় অনলাইন এজেন্টদের কাছে টাকা তোলার অভিযোগ ছিলো মাদার আলীর বিরুদ্ধে। তৎকালীন পুলিশ সুপার রাফিউল আলম অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষনা দিয়ে তার বাহিনীকে মাঠে নামিয়েছিলেন।
মুজিবনগর থানার ওসি সাইফুল আলমের সাথে সম্প্রতি যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িতদের ব্যাপারে পুলিশ তৎপর রয়েছে। যারা অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত তাদের তথ্য অনুসন্ধানের কাজ চলছে। যে কোন সময় তাদের গ্রেফতার চালানো হবে।