এ দেশে ‘জাতীয়’ শব্দটি গোড়াগুড়িই বালখিল্যতার পর্যায়ে রয়ে গেছে। ধারণাগত সংকট থেকে উত্তোরিত না হতে পারাই শব্দটির যথার্থ প্রায়োগ হয়নি। “তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি” শ্লোগানটি জাতীয় সংহতি সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে। বহুভাষী নানা সংস্কৃতির সাথে বাঙালির মেলবন্ধন গড়ে না ওঠা এর কারণ। সংখ্যাঘনিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেশ গড়ে তুলতে চাইলে জাতীয়তাবাদও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের মতোই আগ্রাসী প্রতিবেশ তৈরি করে, করেছেও তাই।
আদর্শ উদার মানবিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে এখানে সবপক্ষ সুবিধাজনকভাবে নির্বিকার থেকেছেন। খুব শক্তিশালী প্রগতিশীল চিন্তাকাঠামোর দীনতা, রাজনীতিকদের দ্বিধাবিভক্তি এবং জনগণের অযোগ্যতা জাতীয় ঐক্য গঠনে বিপত্তির প্রধান কারণ।
জাতীয় ফল কাঁঠাল কয়জনের ভালো লাগে কিংবা জাতীয় ফুল শাপলা কাদের ভালো লাগে তা জানা নেই। তবে এটা জানা যে, যা সুলভ এবং সৌন্দর্যসুষমায় পরিপুষ্ট তা-ই জাতীয় জীবনর অংশ হয়ে ওঠে। কিন্তু জাতীয় মাছ ইলিশ নিয়ে আমরা কথা বলিনা। সন্দেহ নেই ইলিশ স্বাদে-গন্ধে অতুল কিন্তু সুলভ কি? প্রাপ্তির তীব্রতা সত্ত্বেও জাতীয় এই অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে।
জাতীয় এমন নানা বিষয়ে আমরা দ্বিধান্বিত, প্রতিটি গর্বদীপ্ত আন্দোলন সংগ্রামের ক্ষেত্রে দ্বিধান্বিত, ঐতিহাসিক মুজিবনগর নিয়ে দ্বিধান্বিত, স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্কে দ্বিধান্বিত, জাতীয় নেতা ও কবি মান্যতায় দ্বিধান্বিত, জাতীয় সংগীতের ক্ষেত্রেও দ্বিধান্বিত। যেটি এই সময়ের নানা সংটের একটি। জাতীয় সংগীত নিয়ে বলার আগে জাতীয় কবি নিয়ে জমে থাকা প্রশ্নপীড়নের উপশম চেষ্টা প্রাসঙ্গিক হবে। কাজী নজরুল ইসলাম কেন আমাদের জাতীয় কবি? এমন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কোন বিবেচনাগুলো প্রাধান্য পেয়েছে তা ভাবা দরকার। কবি জন্মসূত্রে ভারতীয়। একজন ভারতীয় কীভাবে একটি স্বাধীন দেশের জাতীয় কবি হন। তর্কশর্তে ধরে নিলাম তাঁকে সম্মান জানিয়ে নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছে। যদিও তাঁর নাগরিকত্ব প্রক্রিয়া নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। অনেকে বলতে পারেন, তাঁর সংগীত কবিতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা, মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের গানওতো আমাদের প্রেরণার একটি প্রবাহ , প্রেরণা দিয়েছে সলিল চৌধুরী অসংখ্য গানও। তাহলে কোন বিবেচনায় নজরুল জাতীয় কবি? নজরুল সাহিত্যের কোন পর্ব আমাদের জাতীয় জীবনকে প্রভাবিত করে? হামদ নাত গজল পর্ব, শ্যামা সংগীত পর্ব, খৃস্টানদের জন লিখিত দীর্ঘ প্রার্থনা পর্ব, মানবতা পর্ব, নাস্তিক্যবাদী পর্ব? নাকি সামগ্রিক নজরুল আমাদের জাতীয় জীবনের প্রভাবক?
দাঁড়াবার জাতীয় ঐক্য পাটাতন তৈরি না করে জাতীয় কবি নির্বাচন রাজনৈতিক দুর্বলতা। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দানে কার লাভ হয়েছে জানা নেই, তবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নজরুল ইসলাম। যে নজরুল গাইতে পারেন, “মোর অন্তরের হেরা গুহায় আজো তোমার ডাক শোনা যায় ” সেই নজরুল দ্বিধাহীনভাবে গাইছেন, ” গাহ নাম অবিরাম কৃষ্ণনাম কৃষ্ণনাম মহাকাল যে নামের করেন প্রাণায়াম। “
আরোহ -অবরোহের উচ্ছলতায় কাজী নজরুলের সৃষ্টি কোনো বিশেষ গোত্রগাঁথা নয় বরং মানুষের অনুভূতি বয়ানের প্রতিনিধিত্ব করেছ। মানুষ নজরুল এখানে মূখ্য।
সেই সাথে আমরা জাতি হিসেবে নজরুলকে মানুষ নজরুল, রবীন্দ্রনাথকে মানুষ রবীন্দ্রনাথ ভাবতে পারছি কিনা সেটাও বিবেচ্য।
জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি এই সময়ের নানা সংকটের একটি। পরিবর্তনের প্রস্তাব প্রথম আসে’৭৫ এর ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ড পরবর্তী খন্দকার মোশতাক আহমেদের শাসনকালে, শাহ আজিজুর রহমানের প্রস্তাবনায় ১৯৭৯সালে জিয়াউর রহমান যখন রাষ্ট্রপতি। ২০০২ সালে জামায়াত নেতা গোলাম আযম ও আলি আহসান মুজাহিদের প্রস্তাবনায়। সবশেষ ২০২৪ এর ছাত্র – জনতার গণ অভ্যুত্থানে হাসিনার পতনের পর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি” গানটির বিকল্প ভাবছেন কয়েকটি পক্ষ – তারা সোনার বাংলার বিকল্প হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেন দীজেন্দ্রলাল রায়ের “ধন ধান্যে পুস্পে ভরা ” গীতিকার মনিরুজ্জামান মনিরের ” প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ ” আর মুহিব খানের “ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি সোনার চাইতে খাঁটি “। আরও কয়েকটির প্রস্তাবনাও শোনা যাচ্ছে। পরিবর্তনের পক্ষে তারা ইরাক জার্মানি পাকিস্তান নেপালের নজির টানছেন। আপাতচিন্তায় আমার সোনার বাংলা কেনো পরিবর্তিত হওয়া উচিত তার আলোচনাও চলছে। বলা হচ্ছে , যেহেতু বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের বহুপূর্বে বঙ্গভঙ্গ রদকে কেন্দ্র করে রচিত তাই এটি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে না। এবং এটিতে দুই বাংলার একত্র হবার ভয়ানক লক্ষণ রয়েছে। গানটিতে কোথাও বাংলাদেশ শব্দের ব্যবহার নেই আছে বাংলা শব্দের । সনাতনীরা তাদের দেবীকে যেমন “মা” বলে সম্বোধন করে থাকে। এখানেও ” মা তোর বদনখানি মলিন হলে” চরণটিতে সেরকমই পৌত্তলিকতার স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে।
এমন কিছু অসার অযৌক্তিক উদ্দেশ্যপীড়িত বয়ান হাজির করেছেন তারা, যা কুতর্ক ছাড়া কিছু নয়। দেশকে মা ডাকা আর মাতৃভূমি বলার মধ্যে কোনো ভিন্নতা আছে কি?
বঙ্গভঙ্গ বাঙালির অশ্রুকুমকুম দু:খগাঁথা। ধর্মজালে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তান ২৩ বছরের দু:শাসনে দু:স্বপ্নে বঙ্গভঙ্গের অভিশাপকেই কেবল উসকে দিয়েছে।
অনেকের দাবি বাংলাদেশের কোনো লেখক কবির লেখা গানই হোক জাতীয় সংগীত। তাদের জেনে রাখা উচিত বাংলাদেশ মানেই ১৯৭১ পরবর্তী বাংলাদেশ নয়। ৭১ একটি চূড়ান্ত আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। তারও অনেক আগে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ বিনির্মাণের কর্মসূচি। পলকে পলকে বাংলাদেশ তৈরির স্বপ্নকল্প, পর্বে পর্বে এসেছে বাঙালির গর্বদীপ্ত উদ্ভাসন।
আমরা কি ভুলে যাব পাল রাজাদের দৌরাত্মে ফুঁসে ওঠা চর্যাপদের বৌদ্ধভিক্ষু বাঙালি কবিদের? যারা শাসকের ভয়ে ছাড়েননি মাতৃভাষা বাংলাকে। আমরা কি ভুলে যাবো মুকুন্দরাম আলাওল বিদ্যাপতি আবদুল হাকিম সুভাষচন্দ্র বসু শেরে বাংলা ভাসানী জগদীশচন্দ্র বসু তিতুমীর শেখ মুজিব রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলকে? যারা আমাদের প্রেরণার বাতিঘর, চিন্তার মানচিত্রের কারিগর।
১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ২১ দফা, ৬ দফা বাঙালির চরিত্র গঠনের নীতিমালা, বাংলাদেশ তৈরির রূপকল্প।
প্রস্তাবিত যে তিনটি গানের কথা বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে সেগুলো দেখে নেয়া যাক। ” ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি সোনার চাইতে খাঁটি ” সামান্য নন্দন তাত্ত্বিক জ্ঞানসম্পন্ন যে কেউ ভীষণ হোঁচট খাবেন প্রথম লাইনেই। না আছে শব্দ চয়নের মুন্সিয়ানা, না আছে বাক্যবিন্যাসের নিজস্বতা। গানটিতে ব্যবহৃত সুজলা সুফলা শব্দদ্বয় বঙ্কিমচন্দ্র সৃষ্ট শব্দসৌকর্য। শুধু শব্দ নয় রয়েছে আলোচিত – সমালোচিত ব্যক্তিদের উপস্থিতি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত কর্মকাণ্ডের জন্য শেখ মুজিব সমালোচিত। জিয়াউর রহমানও তাঁর শাসনকাল নিয়ে সমালোচিত, প্রশ্নপীড়িত।
জাতীয় সংগীতে ব্যক্তি উপস্তিতি সমালোচনার জন্ম দেয়, ভবিষ্যতে আরো ব্যক্তি সন্নিবেশের দাবি ওঠার সম্ভাবনা তৈরি করে। সাধারণত ব্যক্তি উপস্তিতি ঘটানো হয়ে থাকে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বা গোষ্ঠীগত ভারসাম্য বিবেচনায়, যা ক্ষতিকর। এবার দেখা যাক “প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ ” গানটি। এটি দেশপ্রীতির এক শুদ্ধতম নমুনা, প্রবাহিত হয়েছে কথা ও সুরের অনন্য প্রস্রবণ। কিন্তু গানটিতে হৃদয়ের বিগলনের চেয়ে ফল্গুউচ্ছ্বাস প্রকাশ পেয়েছে বেশি। আমার সোনার বাংলা মানুষের হৃদকম্পের সাথে অনায়াসে মিশে যায়। প্রকৃতি নির্ভর জাতির বিশুদ্ধ বয়ান দেশমাতার প্রতি বিনম্র নিবেদনে নতজানু হয়। প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশে তা সম্ভব নয়।
তৃতীয় যে প্রস্তাবনা, “ধনধান্যে পুস্পে ভরা ” এটি একটি অহমিকা ঠাসা আগ্রাসী গান, “সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি” এই একটি লাইন বাঙালিকে দীর্ঘদিন তৃপ্তি যুগিয়ে এলেও আসলেই কি আমার দেশ সকল দেশের রাণী? প্রশ্ন থেকেই যায় তার সক্ষমতা নিয়ে। অতিরঞ্জন সত্ত্বেও গানটি গায়কী উচ্ছলতা তৈরি করে।
আমাদের জাতীয় সংগীত কেমন হবে তা নির্ধারিত হবে আমরা জাতি হিসেবে কোন অবস্থানে নিজেদের দেখতে চাই, কোন মাত্রায় নিজেদের নিয়ে যেতে চাই। প্রতিটি সভ্য জাতির থাকে ইতিহাস ঐতিহ্যে মিলিত গতিপ্রবাহী এক সুনির্দিষ্ট গন্তব্য যাত্রা। যখন আমাদের সকল ইতিহাস ঐতিহ্য জাতপাতের ঊর্ধ্বে রেখে সুন্দর আগামীর যাত্রায় সকলে সমস্বরে গেয়ে উঠবে , ” আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি “। কেবল তখনই জাতীয় সংগীত নয়, বাংলাদেশ হয়ে উঠবে জাতপাতহীন বিশ্বের প্রতিনিধি।
লেখক: শিক্ষক, কবি ও উপস্থাপক