মেহেরপুরে সল্প বিনিয়োগ ও অল্প সময়ে দেশি জাতের মুরগি পালন করে সাবলম্বি হচ্ছেন নারীরা। পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টির অন্যতম মাধ্যম দেশি প্রজাতির মুরগি পালন। সহজ ব্যাবস্থাপনা ও ভালো বাজার দরের কারণে দেশি মুরগী পালন জেলার বিভিন্ন গ্রামের নারীদের সৌখিন ও পছন্দের পেশায় পরিনত হয়েছে। এতে একদিকে যেমন পরিবারের মাংসের চাহিদা পুরুণ হচ্ছে অন্যদিকে বাড়তি আয়ের উৎস বলেও মনে করছেন গৃহিনীরা।
নারীদের পাশাপাশি বেকার যুবকেরাও এগিয়ে আসছে দেশীয় জাতের মুরগি পালনে। খামারী পর্যায়ে দেশি জাতের মুরগি পালন করে গ্রামের নারীদের সাবলম্বি করতে আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন । অনেকেই বাণিজ্যিক ভাবে পালন করেও লাভবান হচ্ছে। কারিগরি সহযোগিতায় কাজ করছে পলাশীপাড়া সমাজ কল্যাণ সমিতি নামের বেসরকারি সংস্থা।
জানা গেছে সারা দেশে সমন্বিত কৃষি ইউনিট ভুক্ত প্রাণিসম্পদ খাতের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে পিকেএসএফ ২০১৩-২০১৪ অর্থবছর থেকে দেশীয় প্রজাতির মুরগী পালন প্রকল্পটি চালু করে। মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে পলাশীপাড়া সমাজ কল্যাণ সমিতি (পিএসকেএস)। কর্মসূচির আওতায় গাংনী উপজেলাতে খামারীদের বিশেষ আবাসন নিশ্চিত করে দেশি মুরগি পালন বিষয়ক ১১৫ টি প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করে।
এছাড়াও খামারিদের মাঝে দেশি মুরগি পালনের প্রয়োজনীয় উপকরণ বিতরণের পাশাপাশি খামারিদের দেশি মুরগি পালন বিষয়ক প্রশিক্ষণ, খামার দিবস, পরামর্শ কেন্দ্র এবং ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্প বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছে পলাশীপাড়া সমাজ কল্যাণ সমিতি (পিএসকেএস)।
গাংনী উপজেলার তেরাইল গ্রাামের দেশি মুরগির খামারি মোছা: রেহেনা খাতুন জানান , তার স্বামী একজন গার্মেন্টস কর্মি। তিনি বাড়িতে বসে অলস সময় পার করছিলেন। পরে পলাশীপাড়া সমাজ কল্যান সমিতির সহায়তায় দেশীয় প্রজাতির মুরগি পালন শুরু করেন। প্রথমে ১০টি দেশীয় জাতের মুরগির বাচচা দিয়ে খামার শুরু করেছিলেন। এখন তাম খামাওে প্রায় দুই শতাধিক বড় মুরগি রয়েছে। পরিবারের মাংসের চাহিদা পরুণ করেও প্রতিমাসে প্রায় ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকার মুরগি বিক্রি করেন সংসারের সচ্ছলতা এনছেন। প্রতিবেশিদেও কাছে তিনি এখন মুনগি বিক্রি করেন সাড়ে ৫০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা কেজি।
গাংনীর গাড়াডোব গ্রামের ফরিদুলের স্ত্রী সুরাইয়া খাতুন জানান, গতানুগতিক সনাতন পদ্ধতিতে দেশি মুরগি পালন করে তিনি আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারছিলেন না; সনাতন পদ্ধতিতে বাচ্চা মৃতের হার অনেক বেশি। ব্রুডিং (৭-১০ দিন বয়সী মুরগির বাচ্চাকে তাপ প্রদান করা) ঠিকঠাক না হওয়ায় বাচ্চার শারীরিক বৃদ্ধি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পেত। এছাড়া বিভিন্ন সংক্রামক রোগ লেগেই থাকত। বিভিন্ন শিকারী প্রাণির আক্রমণে মুরগির বাচ্চা মৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশি। বিশেষ আবাসন নিশ্চিত করে দেশি মুরগির বাচ্চা লালন পালন করায় এবং রোগ প্রতিরোধে সময়মত টিকা প্রদান নিশ্চিত করায় মুরগির বাচ্চা মৃত্যুর হার নেমে এসেছে প্রায় শূণ্যের কোঠায়। এখন তার খামারে দেড় শতাধিক দেশীয় জাতের মুরগি রয়েছে।
তেরাইল গ্রামের গৃহবধু কাজলী জানান, পলাশীপাড়া সমাজ কল্যান সমিতির মাঠ কর্মিও পরামর্শে এবং পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের আর্থিসহায়তা হিসেবে আমাকে একটি সুন্দর মুরগির ঘর প্রদান করেছে। মুরগি পালনের জন্য দিয়েছে অন্যান্য অনুসঙ্গ। সঠিক পরিচর্যা প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহ করার ফলে মুরগির দৈহিক বৃদ্ধি ও ডিম প্রদানের হার বৃদ্ধি পেয়েছে।
সংস্থার প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা জানান,এই পদ্ধতিতে মুরগির মাধ্যমে ডিম ফুটানোর ক্ষেত্রে ডিমগুলো বিশেষ এক ধরণের হাজল বা ডিম ফুটানোর পাত্রে বসানো হয়। ফলে ডিমে তাপ দেবার সময় মা মুরগি খাবার ও পানি খাওয়ার জন্য ডিম থেকে উঠে যাবার প্রয়োজন হয় না। কারণ খাবারের পাত্র ও পানি মুরগির সামনেই রাখা থাকে। ফলে মা মুরগি যথাযথভাবে ডিমে তা দিতে পারে এতে ডিম ফুটে বাচ্চা উৎপাদনের হার বৃদ্ধি পায়।এ পদ্ধতিতে একজন খামারি অনায়াশে চোট্ট একটি ঘরে ৩০-৩৫ টি মুরগি পালন করতে পারে। যেহেতু দেশি মুরগি লালন খরচ অনেক কম সেহেতু একজন ছোট খামারী বাচ্চা উৎপাদন ও মুরগি বিক্রয় করে প্রতি মাসে ৮-৯ হাজার টাকা আয় করতে পারছেন বলেও জানান অনেক গৃহবধু
গাড়াডোব গ্রামের রাহেলা খাতুন জানান, বিশেষ আবাসন নিশ্চিত করার ফলে মুরগির বাচ্চার বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ হ্রাস পায় এবং শিকারী প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুকি কমে যায়। এছাড়াও এ পদ্ধতির কারণে মা মুরগি বাচ্চাদের থেকে দুরে থাকায় দ্রত ডিম পাড়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।
তেরাইল গ্রামের ইউপি সদস্য মাসুম পারভেজ জানান,দেশিয় জাতের মুরগি পালন একদিকে যেমন দরিদ্র মানুষ আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন অপরদিকে তাদের দৈনন্দিন পুষ্টি চাহিদাও পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছেন। স্থানীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তর হতে কারিগরি সহায়তা (যেমন: ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্পেইন আয়োজন করা, চিকিৎসা সহায়তা প্রভৃতি) পেলে এই সকল ক্ষুদ্র খামারীগণ উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে উঠবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারি প্রতিষ্ঠান পিএসকেএস-এর পরিচালক (কর্মসূচি) মোহাঃ কামরুজ্জামান জানান, বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ । এদেশের জনগনের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা প্রদান, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি কৃষক বা খামারির দক্ষতা উন্নয়নে পিএসকেএস পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর সহায়তায় কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায় করছে ।
এরই ধারাবাহিকতায় মেহেরপুরের গাংনী উপজেলাতে আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে । আমরা সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছি । দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মুরগির গুরুত্ব অপরিসীম। তুলনামূলক স্বল্প বিনিয়োগ এবং অল্প ভূমিতে বাস্তবায়নযোগ্য বিধায় জাতীয় অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্বসাধারণের আমিষের চাহিদা পূরণকল্পে দেশি মুরগির চাষ বৃদ্ধি করতে হবে । এতে একদিকে যেমন নিরাপদ মাংস উৎপাদন সম্ভব হবে পাশাপাশি কমবে অতি মাত্রায় পোল্ট্রি মুরগির উপর নির্ভরতা।
মেহেরপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মোঃ সাঈদুর রহমান জানান, জেলায় মাংসের চাহিদা ও পুষ্ঠিগুন বিবেচনায় দেশি মুরগির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে । জেলায় ব্রয়লার ও লেয়ারের খামার থাকলেও দেশি মুরগির খামার তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। তাই দেশিও মুরগির জাত উন্নয়ন ও বাজারের চাহিদা বিবেচনা করে প্রান্তিক পর্যায়ে দেশি মুরগির খামার আরও বৃদ্ধি করা উচিৎ। সরকারি সহায়তার পাশাপাশি সরকারের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের বেসরকারী সংস্থা (এনজিও) গুলোও প্রাণীসম্পদ উন্নয়নে নানা কর্মকান্ড পরিচালনা করে যাচ্ছে দেশের প্রাণীসম্পদ উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি এনজিও গুলোরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলেও জানান তিনি ।