মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি : প্রসঙ্গ বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি : প্রসঙ্গ বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন
মজিবর রহমান
একটি বিষয় বাংলাদেশে বেশ জোরেশোরেই আলোচনা হচ্ছে। সেটা হলো বাংলাদেশের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি। আমি ভেবেছিলাম এটা কেবল শহুরে শিক্ষিত মানুষের আলোচনার বিষয়। বিশেষ করে রাজনীতি সচেতন মানুষজন এসব নিয়ে আলোচনা করছেন। কিন্তু আমার ধারণা ভূল প্রমাণ করলেন গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ। কয়েকদিন আগে গ্রামের একটা চা স্টলে বসেছিলাম চা পানের জন্য। আমার সমবয়সী একজন আমাকে প্রশ্ন করে বসলেন- আমেরিকার ভিসাানীতি কী পারবে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে? আমি নিজে যে জবাবটা জানি অথবা যে জবাবটা দিতাম সেটা না দিয়ে উল্টো তাকেই জিজ্ঞেস করলাম তোমার কী মনে হয়? তিনি কোন ভাবনা চিন্তা ছাড়াই দৃঢ়তার সাথে জবাব দিলেন- পারবে। আমি বিস্ময়ভরা দৃষ্টে তার দিকে তালকালাম। আমি কিছু বলার আগেই তিনি বলতে লাগলেন সরকারি এবং বিরোধীদলগুলোর বড় বড় নেতাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে একটা ভালো নির্বাচন না করে তাদের কোন উপায় নেই। আবার তাকে প্রশ্ন করলাম উপায় নেই মানে কী? জবাবে তিনি যা বললেন তাতে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠলো। সে বললো- স্বার্থ। নিজেদের স্বার্থে সরকারি এবং বিরোধীদলগুলো একটা ভালো নির্বাচনের দিকে এগুবে। না হলো তো তাদের স্বপ্নের দেশের দরজা বন্ধ হযে যেতে পারে। ঘুষ-দূর্নীতি করে কামানো টাকার নিরাপত্তা ও সে টাকা দিয়ে ভোগ-বিলাস করবে কোথায়? তাছাড়া প্রয়োজনে পালানোর পথটাও তো পরিস্কার থাকা চাই। গ্রামের একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের এরকম বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা আমাকে মুগ্ধ করেছে। হতে পারে হাজারো মানুষের চিন্তার প্রতিফলন এটা। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি আমরা কী এরকম রাজনীতি কিংবা রাজনীতিবিদ চেয়েছিলাম? যাদের ওপর জনগণ আস্থা রাখতে কিংবা বিশ^াস করতে পারছে না। অথচ এই সাধারণ মানুষই তো একদিন রাজনীতিবিদদের কথায়, তাঁদের ওপর আস্থা ও বিশ^াস রেখে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যত্থান, ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০’র গণআন্দোলনে স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ করে।
যাক, ফিরে আসি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত নতুন ভিসানীতির ব্যাপারে। গত ২৪ মে ২০২৩ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বেহাল দশা, নির্বাচন প্রক্রিয়া, মানবাধিকার পরিস্থিতি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার ইত্যাদির বাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের আপত্তির কথা আমাদের সবারই মোটামুটি জানা। এখন যে কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন এই ভিসানীতি তো নিষেধাজ্ঞা নয়। তবে এটা নিয়ে কেন এতো মাতামাতি, এতো চুলচেরা বিশ্লেষণ কেনই বা এতো ভীতি? আমরা র্যাবের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞার কথা কথা জানি। এটা র্যাব ছাড়া অন্যকোন সংস্থার ওপর প্রভাব পড়েনি। কিন্তু এই ভিসানীতি নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে পারে এরকম নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সকলেই পড়তে পারেন। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ, বিচারিক এমনকি সামাজিক নেতৃত্বের যে কেউই এর আওতায় চলে আসতে পারে। তার মানে নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট কেউই এই প্রক্রিয়ার বাইরে না। এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যরাও এর আওতায় পড়তে পারেন। কাজেই এর প্রভাব নিষোধাজ্ঞার চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। স্বভাবতই এ প্রশ্ন আসতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা কী এমন গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যে সেটা পেতেই হবে? হয়তো সাধারণ মানুষের জন্য এটা তেমন গুরুত্ব বহন করে না। কারণ সেখানে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য নেই, সম্পদ নেই, তাদের ছেলেমেয়েরা সেখানে পড়াশুনা করে না। তারা এদেশে নিজেদেরকে অনিরাপদ ভাবেন না। দেশের প্রতি তাদের ভালোবাসারও কোন কমতি নেই। কাজেই তাদের কাছে এর তেমন একটা গুরুত্বও নেই। কিন্তু রাজনীতিবিদ, আমলা এদের কাছে এটা মহামূল্যবান। এটা ছাড়া তাদের চলবে না। কারণ এদেশে তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা হয় না, তাদের অনৈতিকভাবে উপার্জিত সম্পদ নিরাপদ নয়। কাজেই যে কোন মূল্যে তাদের এর আওতার বাইরে থাকতেই হবে।
সরকারি ও বিরোধীদলের বাঘা বাঘা নেতারা সব তাদের মতামত দিয়ে যাচ্ছেন। যদিও কোন দল তাদের দলীয় অবস্থানটা এখনো পরিস্কার করেননি। তবে সরকারিদলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলছেন এই বিরোধী শিবিরকে চাপে ফেলবে। কারণ তারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে, কিংবা নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে জ¦ালাও পোড়াওয়ের রাজনীতি করতে পারবেন না। আর করলেই সুষ্ঠ অবাধ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হয়েছে মর্মে ভিসানীতির খড়গ তাদের ওপর পড়তে পারে। সরকারিদলের নেতারা মনে করছেন এতে তারা সুবিধা পেতে পারেন। আবার বিরোধী শিবির বলছেন এটা সরকার ও সরকারিদলকে চাপে ফেলবে। একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেয়া ছাড়া তাদের কোন পথ খোলা নেই। বিরোধীদের প্রতি কঠোর অবস্থান নেয়া মানে একটা অস্থীতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হওয়া। যা সবার গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচনের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর তা হলেই নতুন ভিসানীতির মারপ্যাঁচে পড়ে যেতে পারেন।
তাদের এ ধরনের বক্তব্য জনগণকে আশাবাদী করে তুলছে নিশ্চয়ই? নতুন ভিসানীতির খড়গ যেন নিজেদের ওপর না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে গিয়ে উভয় পক্ষই নমনীয় আচরণ করবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে উভয় শিবির নিজেদের জন্য, নিজেদের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের দরজা খোলা রাখার স্বার্থে ভিন্নভাবে হলেও একটা ঐক্যমত্যে পৌঁছে অবাধ, সুষ্ঠ ও সবার গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের দরজা খোলা রাখার জন্য হলেও জনগণের চাওয়া অনুযায়ী যদি একটা ভালো নির্বাচন হয়, যদি জনগণ তাদের নিজেদের ভোটাধিকার ফিরে পায় তাহলে সেটাই বা মন্দ কী?