অভিনেতা খালেকুজ্জামান আর নেই

মুক্তিযোদ্ধা ও অভিনেতা খালেকুজ্জামান মঙ্গলবার (২১ মার্চ) সকাল ৯টার দিকে নিজ বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তার বয়স হয়েছিলো ৭২ বছর।

তথ্য নিশ্চিত করেছে অভিনয় শিল্পী সংঘের সভাপতি আহসান হাবিব নাসিম। অভিনেতার জানাজা কুর্মিটোলার একটি মসজিদে বিকাল ৫টায় অনুষ্ঠিত হবে।

খালেকুজ্জামানের জন্ম বগুড়ার শান্তাহারে। বাবা ডা. শামসুজ্জামান ছিলেন রেলওয়ের মেডিক্যাল অফিসার এবং মা শায়েস্তা আক্তার জামান ছিলেন গৃহিনী।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য ও চারুকলা বিভাগের প্রথম মাস্টার্স ডিগ্রীধারীদের একজন তিনি। দেশ স্বাধীনের বেশ কয়েকবছর পর খালেকুজ্জামান ১৯৭৫ সালে বিটিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী হন। তার আগে ছাত্র জীবনের তিনি অসংখ্য মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেন।

উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন খালেকুজ্জামান। দেশ স্বাধীনের পর যুক্ত হন অভিনয়ে। তার অভিনীত প্রথম নাটক ‘সর্পভ্রমে রজ্জু’ বিটিভিতে প্রচার হয়েছিলো। ১৯৭৫ সালে তিনি বিটিভির তালিকাভূক্ত শিল্পী হন।

পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়িক কাজে অভিনয়ে খুব একটা নিয়মিত থাকতে পারেননি। তবে অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসার জন্য বারবার ছুটে এসেছেন এই অঙ্গনে। কাজ করেছেন বহুল জনপ্রিয় নাটক ‘বড় ছেলে’সহ এই সময়ের বহু নাটকে।

এছাড়া মুরাদ পারভেজের ‘বৃহন্নলা’, শিহাব শাহীনের ‘ছুঁয়ে দিলে মন’, অনম বিশ্বাসের ‘দেবী’ সিনেমায়ও দেখা গেছে এই অভিনেতাকে।




ফসলি জমিতে পুকুর খনন চুয়াডাঙ্গায় উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব

চুয়াডাঙ্গা জেলার বিভিন্ন গ্রাম এলাকায় পুকুর খননের মহোৎসব চলছে। এতে দিন দিন কমে আসছে আবাদি জমি। বিশেষ করে তিন ফসলি জমিতেও পুকুর খননের হিড়িক পড়ায় ফসল উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়তে যাচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি প্রদান দেশ। এ দেশে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষের পাশাপাশি ফলজ উৎপাদনে নির্ভরশীল।

চুয়াডাঙ্গা কৃষি ও সবজি চাষ নির্ভর একটি জেলা। চুয়াডাঙ্গায় উৎপাদিত খাদ্য ও সবজি জেলার চাহিদা মিটিয়ে জাতীয় খাদ্য ভাণ্ডারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। দীর্ঘ বছর ধরে জেলার অর্থনীতি সমৃদ্ধ করছে সবজি, ভুট্টা, মালটা, পেয়ারা, ড্রাগন সহ বিভিন্ন ধরনের চাষ।

তবে মাছ চাষ লাভজনক হওয়ায় মানুষের মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে পুকুর খননে। ফলে পাল্লা দিয়ে চুয়াডাঙ্গার প্রতিটি গ্রামেই আবাদি জমি, বসতবাড়ির পাশে পুকুর খনন চলছে। পাঙ্গাশ, মনোসেক্স, রুই, কাতলা ও সিলভারকার্প জাতীয় মাছ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন অনেক কৃষক। ফলে আবাদি জমিতে পুকুর খননের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতিমালা লঙ্ঘন করে অবাধে চলছে পুকুর খননের কাজ। বিশেষ করে এলাকায় যারা অনেক জমির মালিক কিংবা বিভিন্নভাবে প্রভাবশালী তারাই পুকুর খননের কাজ করছেন। যত্রতত্র পুকুর খননের কারণে কোনো কোনো এলাকায় জলাবদ্ধতারও সৃষ্টি হচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গা জেলার জমি হচ্ছে সবজি সহ বিভিন্ন ধরনের চাষের জন্য উপযোগি। এ জমি নষ্ট করে এক শ্রেণীর মাটি খাদক চক্র চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন ফসলি জমির মাটি কেটে বিক্রি করা হচ্ছে এলাকার ইটভাটা সহ বিভিন্ন স্থানে। এ কারণে এলাকার চাষ যোগ্য জমি হারাতে বসেছে।

সরজমিনে গ্রামটি ঘুরে দেখা গেছে, আবাদি জমির অধিকাংশ এখন মাটি খাদকদের দখলে। এ মাটি খাদকেরা চাষের জমি খনন করে পুকুর করছে। এদের মধ্যে একজন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়নের তিতুদহ ইউনিয়ন ও বেগমপুর ইউনিয়নের জিরো পয়েন্ট নুরুল্লাপুর ব্রীজের নিকট নুরুল্লাপুর গ্রামের আব্দুল সামাদের ছেলে মঙ্গল মিয়া আবাদি জমির মাটি খনন করে পুকুর করছে। গ্রামের কয়েকজন কৃষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পুকুর খননের চারপাশে আবাদি জমি রয়েছে। এ জমির পাশে একটি সরকারী খাল রয়েছে। এ কারণে চাষের জমির মধ্যে বর্ষা মৌসুমে আবাদি জমির পানি নিঃস্কাশনের জন্য ইতপূর্বে প্রতিবা করেও কোন প্রতিকার পায়নি। যে কারণে অনেক কৃষক তাদের আবাদি জমি পানির দরে লীজ দিয়েছে পুকুর মালিকদের নিকট। এরই মধ্যে ব্রীজের কোল ঘেঁষে আবাদি জমির মধ্যে করা হচ্ছে পুকুর খনন। এ যেন গোদের উপর বিশফোঁড়া। ফলে আবাদি জমিতে ইচ্ছেমতো পুকুর খননের কারণে সেই মাটি ইটভাটা সহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করায় সড়ক দিয়ে ট্রাক্টর যোগে মাটি বহন করা হচ্ছে। বহনকৃত মাটি ট্রাক্টর যোগে নেওয়ার সময় সড়কের উপরে ছিটকে পড়ে পিচের সড়ক মাটির কাঁচা রাস্তায় পরিণত হয়েছে। আর সামান্য বৃষ্টির পানি সড়কে পড়ে থাকা মাটি ভিজে তা কাঁদায় পরিণত হয়ে যানবাহন সহ কমলমতি শিশু শিক্ষার্থী সহ স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরা ও পথচারীদের চলাচলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

বিশেষ করে তিতুদহের নুরুল্লাপুর গ্রাম হতে গ্রিসনগর বাজার সহ পার্শ্ববর্তী সড়ক গুলো পিচের বদলে কাঁদার সড়কে পরিণত হয়েছে। সেই সাথে অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খননের ফলে পানি বের হওয়ার পথ হারিয়ে গেছে।

এ ইউনিয়নের আবাদি জমির প্রায় সবই দুই ফসলি ও তিন ফসলি। উর্বর ও সমতল এলাকা হওয়ায় সব ধরনের ফসল আবাদ হয়। এক্সকেভেটর মেশিন দিয়ে পুকুর খননের মচ্ছব চললেও যেন দেখার কেউ নেই। এমনটি অভিযোগ স্থানীয়দের।

সদর উপজেলার নুরুল্লাপুর গ্রামের বাসিন্দা ও গ্রীসনগর বাজারের ব্যাবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেন, পুকুর খনন করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। গ্রাম ও বাজারের অদূরে চাষের জমি কেটে গভীর গর্তের পুকুর খনন করা হয়েছে। এতে বর্ষাকালে আশপাশের জমি ও গাছপালা পুকুরে বিলীন হবে বলে আশংকা করছেন তারা। এ ব্যাপারে পুকুর খননের নামে তিন ফসলি জমিতে পুকুর খননে মাটি খাদকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারছিনা।

এ বিষয়ে পুকুর খননকারী জমির মালিক মঙ্গল মিয়ার কাছে পুকুর খনন ও সড়কে মাটি পড়ে কাঁদায় পরিণত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি পুকুর খনন করছিলাম এখন আর করছিনা। তবে কোন অনুমতি নেওয়া হয়নি। আর ট্রাক্টরে মাটি নেওয়ার সময় কিছু মাটি রাস্তার ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে যায়। সেই মাটি বৃষ্টির পানিতে কাঁদায় পরিণত হয়েছে। যার কারণে রাস্তায় কাঁদা হয়েছে। তবে আমি পুকুর কাটা বন্ধ করে দিয়েছি। এখন শুধুমাত্র পুকুরের চারপাশ বাঁধা হলেই হয়ে যাবে।




আলমডাঙ্গায় সনদ জালিয়াতি করে লাইব্রেরিয়ানের চাকরি !

আলমডাঙ্গা পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে গ্রন্থগারিক (লাইব্রেরিয়ান) শিক্ষক কুলছুম খাতুনের বিরুদ্ধে ভুয়া সনদে চাকুরির অভিযোগ উঠেছে। তিনি পাবনা জেলার সাথিয়া উপজেলার বাসিন্দা। গত ১৮ অক্টোবর ২০১০ সালে তিনি ৮ লাখ টাকা বিনিময়ে আলমডাঙ্গা পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ২০১৯ সালের ২৪ শে জানুয়ারি বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কতৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) যাচাইয়ে ওই গ্রন্থগারিক (লাইব্রেরিয়ান)’র শিক্ষিকার সনদ জালিয়াতি ধরা পড়ে। তবে অভিযুক্ত লাইব্রেরিয়ানের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি কতৃপক্ষ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আলমডাঙ্গা পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারিক (লাইব্রেরিয়ান) শিক্ষক পদে কুলছুম খাতুন ২০১০ সালের ৫ অক্টোবর নিয়োগ লাভ করেন। একই বছরের ১৮ অক্টোবর তিনি স্কুলে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ২০১০ সালেই তিনি এমপিওভুক্ত হন।

কিন্তু অবশেষে এটিআরসিএর জালে আটকে যায় ভুয়া সনদধারী ওই শিক্ষিকা। সরকারি সার্কুলার অনুযায়ী নিবন্ধন সনদ যাচাইয়ের জন্য প্রেরণ করা হলে এনটিআরএ যাচাই প্রতিবেদনে ওই শিক্ষিকার নিবন্ধন সদনটি জাল ও ভুয়া বলে এনটিআরসি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তার এইচএসসি ভুয়া সনদে উল্লেখ করা হয়েছে কুলছুম খাতুন পিতা কাইউম উদ্দীন খাঁন। এছাড়াও সনদে সাথিয়া ডিগ্রি কলেজ ব্যবহার করা হয়। যার রোল নম্বর ১২১৯৯৪ ও রেজিষ্টেশন নম্বর ৮৫৬৫৭৬/১৯৯৫-৯৬। উচ্চমাধ্যমিক ওয়েব-সাইটে যাচাইয়ের চেস্টা করা হলে ভুল নম্বর বলে ব্যর্থ রিপোর্ট দেয়।

এদিকে, জাল সনদে চাকরিরত গ্রন্থাগারিক শিক্ষিকা কুলছুম খাতুন এমপিওভুক্তির পর দীর্ঘ ১২ বছর অবৈধপন্থায় সরকারি বেতন-ভাতা ভোগ করছেন। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ভুয়া ওই শিক্ষিকা এখনো স্বপদে রয়েছেন বহাল-তবিয়তে। এছাড়াও তিনি গত ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ৬ মাসের মাতৃত্ব কালীন ছুটি নেন। সে গর্ভবতী না হয়েও ভুয়া মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে সরকারি সুযোগসুবিধা ভোগ করেন।

নাম না প্রকাশ শর্তে স্কুলের অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা দাবি করেন, বিগত দিন কুলছুম খাতুন প্রধান শিক্ষক মনিরুজ্জামানের নিকটতম আত্নীয় হবার সুবাদে নিয়োগ পায়। বিগত শিক্ষিকা কুলছুম নিজেকে সাবেক জামায়াতের আমির ও যুদ্ধাপরাধী মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামী মতিউর রহমান নিজামীর ভাগ্নে পরিচয় দেয়। প্রধান শিক্ষকের ঘনিষ্ঠ হবার কারণে সহকারি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাথে বিরুপ আচরণ করে প্রধান শিক্ষক মনিরুজ্জামান।

আলমডাঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মনিরুজ্জামান জানান, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত। তবে এনটিআরসির লিখিত নির্দেশনা না আসায় এখনো ভুয়া সনদধারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। নির্দেশনা হাতে পেলে সে মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান। অভিযুক্ত গ্রন্থাগারিক শিক্ষিকা কুলছুম খাতুনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সম্ভব হয়নি।

এবিষয়ে আলমডাঙ্গা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ফজলুল হক জানান, কিছুদিন পূর্বে আমি দায়িত্ব গ্রহন করেছি। ভুয়া সনদে নিয়োগের বিষয়ে জানি না। এখন পর্যন্ত কোন অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলেই তদন্তের মাধ্যমে আসল রহস্য জানা সম্ভব হবে।




সামান্য বৃষ্টিতেই হরিণাকুণ্ডু সড়কের বেহালদশা, জনদুর্ভোগ চরমে

ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার বিভিন্ন পাকা সড়কে ইটভাটায় ব্যবহৃত ট্রাক থেকে মাটি পড়ে থাকা মাটি বৃষ্টির পানিতে কাদায় পরিণত হয়ে বেহাল দশায় পরিনত হয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছে মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল চালক ও স্থানীয় পথচারিরা। কাদার কারণে সড়ক দিয়ে যানবাহন তো দূরের কথা, হেঁটেও চলাচল করা দুস্কর হয়ে পড়েছে। যেকোন সময় বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ঝিনাইদহ-হরিণাকুণ্ডুর প্রধান সড়কের কোথাও কোথাও, উপজেলার সড়াতলা থেকে মানদীয়া বাজার, আমতলা হয়ে চাদপুর ইউনিয়নের জিন্দার মোড় পর্যন্ত সড়ক কাঁদাপানিতে একাকার। এই কাঁদার কারণে যান চলাচলে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। পথচারীরা খালি পায়েও সড়কে চলাচল করতে পারছে না। বিশেষত দুর্ভোগের মুখে পড়েছেন মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেল চালকেরা। দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে তারা মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন। দুরদুরান্তের যাত্রিদের সড়কের পাশে বসবাসকারী ও ব্যবসায়ীদের পড়তে হয়েছে চরম ভোগান্তিতে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বছরের পর বছর ধরে ফসলী জমির মাটি কেটে কতিপয় ইটভাটার অবৈধ ট্রাক্টর,লাটাহাম্বা, ট্রলি পাকা রাস্তা দিয়ে নিয়মিত চলাচলের কারনে এই কাঁদার সৃষ্টি হয়েছে। ইটভাটার ট্রাক্টরের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত বহন করা মাটি সড়কে পড়ে। বেশ কিছুদিন ধরে ধুলায় টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছিল। এখন বৃষ্টি হওয়াতে পাকা রাস্তাগুলো কাদাময় হয়ে পড়েছে। চলাচলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে বেড়েছে দুর্ভোগ।

রাস্তায় চলাচল করা মটরসাইকেল আরোহী আমর বীন মারুফ জানান, ইটভাটার কাজে নিয়োজিত মাটিবাহী যানবাহন থেকে রাস্তায় পড়ে যাওয়া মাটি রোদের সময় রাস্তায় শুকিয়ে ধুলা আর বর্ষায় কাদা হয়ে থাকে। দেখে বোঝার উপায় থাকে না এটা কার্পেটিং রাস্তা। এতে বছর জুড়েই এই সড়কে চলাচল করতে পোহাতে হয় ভোগান্তি।

তবে জনগুরুত্বপূর্ণ এই সড়কগুলোতে যদি এখনই কোন ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, যেকোন সময় বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এবং কিছুদিনের মধ্যেই এই রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। বিশেষ করে আগামী বর্ষা মৌসুম তো আছেই। এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

এ বিষয়ে হরিণাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুষ্মিতা সাহা বলেন, ঝিনাইদহ থেকে হরিণাকুণ্ডু প্রধান সড়ক এখন অনেকটা পরিষ্কার, উপজেলার অন্যান্য রাস্তা পরিস্কার করার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে, না হলে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।




নিয়োগ দেবে দেবে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স

জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স। প্রতিষ্ঠানটি ফ্লাইট অপারেশন অফিসার’ পদে নিয়োগ দেবে। আগ্রহী যোগ্য প্রার্থীরা অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন।

পদের নাম

ফ্লাইট অপারেশন অফিসার।

শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা

প্রার্থীকে মেট্রোলোজি, ফিজিক্স বা ম্যাথমেটিক্স বিষয়ে বিএসসি পাস হতে হবে। প্রার্থীর এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫ এবং স্নাতক এ কমপক্ষে জিপিএ ৩ পয়েন্ট থাকতে হবে। সমস্যা সমাধানে দক্ষতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা এবং চাপ সামলে কাজের আগ্রহ থাকতে হবে। প্রার্থীর কম্পিউটার জ্ঞান এবং বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় সাবলীল হতে হবে। প্রার্থীর বয়সসীমা ২৮ বছর।

কর্মস্থল

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট, ঢাকা।

বেতন

৩০-৫০ হাজার। কোম্পানির নীতিমালা অনুযায়ী অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হবে।

আবেদন প্রক্রিয়া

প্রার্থীরা বিডিজবস অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন।

আবেদনের শেষ তারিখ

২৬ মার্চ, ২০২৩।

সূত্র বিডিজবস।




মেহেরপুরে উন্নয়নের ওয়াকওয়ে; ভৈরব পাড়ে চাপা কান্না

মেহেরপুর ভৈরব নদ পুন:খনন ২য় পর্যায়ের প্রকল্পের আওতায় ওয়াকওয়ে নির্মাণ প্রকল্পে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। একই সঙ্গে ওয়াকওয়ে নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত জমির মালিকদের চাপাকান্নায় এলাকার বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।

মেহেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সৌন্দর্য বর্ধণের লক্ষে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার সহগলপুর থেকে সদর উপজেলা হয়ে মুজিবনগরের কিছু অংশ পর্যন্তÍ ভৈরব নদের দুই পাশে ১৬.৮ কিলোমিটার ওয়াকওয়ের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। এতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১০ কোটি ৬০ লাখ টাকা। যে কাজটি পেয়েছে কুষ্টিয়ার সৈকত এন্টার প্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। তাদের কাজটি দেখভাল করছেন মেহেরপুরের আর আর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রাহিনুরজামান পোলেনসহ চারজনের একটি গ্রুপ।

গতকাল সোমবার ভৈরব নদের ওয়াকওয়ের কাজ পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা নিয়ে নদের তীরবর্তি মানুষের চাপা কান্না। না পারছে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে, না পারছে জমি হারানোর ব্যথা সইতে। যাদবপুর গ্রামের প্রায় ২০ থেকে ২৫ জনের মালিকানা জমি ওয়াকওয়ের জন্য হারাতে হচ্ছে। তারা কোথাও কোন সদুত্তর পাচ্ছেন না।

অপরদিকে, ওয়াকওয়ে নির্মাণ কাজ পরিদর্শনে দেখা গেছে, গাথুনিতে লোকাল বালি ব্যবহার করা হচ্ছে। যা ফিলিংয়ের কাজে ব্যবহার করার কথা। ১:৪ অনুপাতে সিমেন্ট ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও স্থানীয়রা জানান, ১:১০ ভাগেও সিমেন্ট দেওয়া হচ্ছে না। ফলে নির্মাণকাজ স্থায়ী হবে না বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। গাংনী উপজেলার সহগলপুর থেকে সদর উপজেলার কুলবাড়িয়া পর্যন্ত যে অংশে ওয়াকওয়ে করা হয়েছে তানিয়েও স্থানীয়দের অভিযোগ রয়েছে। ওয়াকওয়ে কোন লেভেল করা হয়নি। উন্নয়নের নামে শুধু সরকারের টাকা নষ্ট হচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের ভয়ে কিছুই বলা যাচ্ছে না। বলেও কিছু হচ্ছে না বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন।

যাদবপুর গ্রামের আব্দুল আজিজ বলেন, তিনি ২০১৩ সালে ১৮ কাঠা জমি কিনেছেন। যা সিএস, এসএ ও আরএস রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত আছে। ওই জমিতে বিভিন্ন ফলের বাগান ছিলো। ওয়াকওয়ে করার জন্য আমার বাগান কেটে জমি নিয়ে নেওয়া হয়েছে। জমি নেওয়ার আগে কোন ধরণের নোটিশও দেওয়া হয়নি। কিছু বলতে গেলে পোলেন মাস্তান বাজে ভাষায় গালিগালাজ করে এবং হুমকি দেয়।

একই গ্রামের নাসির উদ্দিন বলেন, তার ১একর ১৩ শতকসহ ৭ ভাইয়ের ৩ একর ৩২ শতক জমি ওয়াকওয়ের জন্য নিয়ে নেওয়া হয়েছে। ওয়াকওয়ের কাজ শুরুর আগে জেলা প্রশাসকের কাছে কাজ বন্ধ রাখার জন্য আবেদন করেও কোন ফল পাননি বলে অভিযোগ করেন।
তিনি আরো বলেন, ভৈরবের উপর দিয়ে রাস্তা করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড, কাজ করার আগে জরিপ করলো না কেন। পরে একদিন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী, ইউএনও, এসি ল্যাণ্ড এসে ঠিকাদারদের বললেন ওয়াকওয়েটা একটু নিচ দিয়ে করতে, কিন্তু ঠিকাদাররা কথা না শুনে উপরদিয়ে করে আমাদের জমি দখল করে নিয়েছে। কিছু বলতে গেলে ঠিকাদার পোলেনসহ তার লোকজন তেড়ে তেড়ে মারতে আসে।

মেহেরপুরে উন্নয়নের ওয়াকওয়ে; ভৈরব পাড়ে চাপা কান্নামেহেরপুর শহরে ঘাটপাড়ার রাফিউল ইসলাম বলেন, তাদের সাড়ে তিন বিঘা জমির মধ্যে প্রায় এক বিঘা জমি ওয়াকওয়ের জন্য নিয়ে নেওয়া হয়েছে। পৌর এলাকার জমি অনেক টাকা দিয়ে আমাদের বাপ-দাদারা কিনেছেন। এখন সেই জমি উন্নয়নের নামে ওয়াকওয়ের জন্য দিয়ে দিতে হচ্ছে। এভাবে অনেকের জমি এতে চলে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্থরা পৌর মেয়রের কাছে আবেদন করলে মেয়রের হস্তক্ষেপে শহরের অংশে কাজ বন্ধ রয়েছে।

গাংনী উপজেলার সহগলপুর গ্রামের নাসিম আহমেদ বলেন, ওয়াকওয়ে খুব বাজেভাবে কাজ করা হয়েছে। রাস্তার কোন লেভেল করা হয়নি। ফলে খুব দ্রুত ওই রাস্তা নষ্ট হয়ে যাবে। উন্নয়নের নামে সরকারের টাকা নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই হয়নি।

ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সৈকত এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন ওয়াকওয়ের কোন কাজ চলছে বলে স্বীকার করতে চাচ্ছিলেন না। পরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজের কথা বললে তিনি জানান, মামনু, পোলেনসহ কয়েকজন দেখা শুনা করছেন। অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ফোনে কথা না সরাসরি দেখা করে কথা জানাবেন বলে জানান।

মেহেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হান্নান প্রধান বলেন, পানি আইন ২০১৩ অনুযায়ী নদের কিনারা থেকে ১০ মিটার (৩৩ ফুট) পর্যন্ত জমি নদের অর্থাৎ খাস খতিয়ান হয়ে যাবে। ওই জমি অন্য যে কারো নামে, এমনি যে কোন রেকর্ড থাকলেও সেটি নদী বা নদের মালিকানায় আসবে। তবে ভৈরব নদের পাড়ে যেগুলো এমন আছে সেগুলো এতদিনে সংশোধন হওয়া দরকার ছিলো।

ওয়াকওয়ে নির্মানের বিষয়ে তিনি বলেন, সিডিউল অনুযায়ী যে মানের নির্মাণসামগ্রী এবং যেভাবে নির্মান করার কথা বলা হয়েছে সেভাবেই কাজ দেখে নেওয়া হবে। এর ব্যত্যয় মেনে নেওয়া হবে না।




মেহেরপুর জেলা প্রশাসকের প্রেস ব্রিফিং

মেহেরপুর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আশ্রয়ন-২ প্রকল্পে গৃহ হস্তান্তর কার্যক্রমের উদ্বোধন, সম্প্রীতি অনুষ্ঠিত আমদহ ইউনিয়ন পরিষদের সাধারণ নির্বাচন, মহান স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস উদযাপনের প্রস্তুতি, আসন্ন রমজান উপলক্ষে বাজার স্থিতিশীল রাখা সংক্রান্ত বিষয়ে প্রেস ব্রিফিং এর আয়োজন করা হয়।

সোমবার বিকেলে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এই প্রেস ব্রিফিং এর আয়োজন করা হয়।

ডিসি বলেন, মুজিববর্ষ উপলক্ষে ভূমিহীন ও গৃহহীন মুক্ত ঘোষনার অংশ হিসেবে মেহেরপুর জেলায় সর্বমোট ১১৭টি গৃহ ( মেহেরপুর সদর উপজেলায় ৬১টি , গাংনী উপজেলায় ৪৭টি ও মুজিবনগর উপজেলায় ৯টি ) হস্তান্তর করা হচ্ছে। ৪টি পর্যায়ে মেহেরপুর জেলায় এখনও পর্যন্ত নির্মিত গৃহের সংখ্যা সর্বমোট ৩৯৯টি ( মেহেরপুর সদর উপজেলায় ১৯২টি , গাংনী উপজেলায় ১৬৫টি ও মুজিবনগর উপজেলায় ৪২টি )।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন মেহেরপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ ওবায়দুল্লাহ, মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার অনিমেষ বিশ্বাস, মেহেরপুর সদর উপজেলা ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ আব্দুল্লাহ আল বাকী, ।

সাংবাদিকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মেহেরপুর জেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি তোজাম্মেল আযম, সাধারণ সম্পাদক মাহবুব চান্দু, মেহেরপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফারুক হোসেন, বাসসের সাংবাদিক দিলরুবা খাতুন, দৈনিক ভোরের কাগজ সাংবাদিক মর্তুজা ফারুক রূপকসহ মেহেরপুর জেলা প্রেসক্লাবের বিভিন্ন সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।




মুজিবনগরে ৩ দিনের কৃষি মেলা শেষ এক দিনেই!

টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ির আয়োজনে,১৮ ই মার্চ শনিবার মুজিবনগরে আম্রকাননে ৩ দিনব্যাপী কৃষক সমাবেশ ও কৃষি মেলার উদ্বোধন করা হয়। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ও মেহেরপুর ১ আসনের সাংসদ ফরহাদ হোসেন প্রধান অতিথি থেকে মেলার উদ্বোধন করেন ।

উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে জানানো হয় ১৮ মার্চ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত মেলা ও কন্দাল ফসল প্রদর্শনী করা হবে।বিভিন্ন সংবাদ পত্র,অনলাইন পোর্টালে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রকাশিত সংবাদে ৩ দিন মেলা হবে সে তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া ব্যানারেও সে তথ্য দেওয়া ছিল। কিন্তু ১৮ মার্চ উদ্বোধনের পর আমন্ত্রিত অতিথি বৃন্দ চলে যাওয়ার সাথে সাথে মেলার স্টলসহ সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দেই উপজেলা কৃষি বিভাগ।
কি কারণে বন্ধ হলো এমন কথা জানতে চাইলে মেহেরপুর সদর উপজেলা কৃষি বিভাগ এবং মুজিবনগর কৃষি বিভাগ থেকে তেমন কোন সদুত্তর দিতে পারিনি। কৃষি বিভাগের দাবি উর্ধতন কতৃপক্ষের আদেশেই মেলা বন্ধ করা হয়ছে।
কোন ঘোষনা ছাড়াই হটাৎ মেলা বন্ধ হওয়া ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এলাকার কৃষকরা। যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে সরকার সে উদ্দেশ্য সফল হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে জনমনে।

মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ান, মানিকনগর, ভবেরপাড়ার বেশ কয়েকজন কৃষক জানান, উদ্বোধনের দিন শুনলাম তিনদিন থাকবে। কিন্তু গত রবিবার সকালে মেলা স্থলে গিয়ে কোন কিছুই দেখা যায়নি। কন্দাল ফসলের চাষ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের বর্ধিত জনগোষ্টির খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং পুষ্টিমান উন্নয়ন করা। প্রকল্প এলাকায় কন্দাল ফসলের আবাদ বাড়ানো, বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত আলু, মিষ্টি আলু, গুলকচু, মুখীকচু, লতিকচু, কাসাভা ও গাছ আলুর প্রমানিতজাতগুলো সম্প্রসারণ করা। এছাড়াও সুবিধাবঞ্চিত ও সিডর-আক্রান্ত এলাকায় প্রশিক্ষন, উদ্বুদ্বকরণ, প্রদর্শনী কার্যক্রমরে মাধ্যমে দক্ষ জনবল সৃষ্টি করা। উন্নত জাতের মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন, বীজ সংরক্ষন ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং বিদেশে কন্দাল ফসল রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা এই প্রবল্পের উদ্দেশ্য। কিন্তু মুজিবনগরের আম্রকাননে কৃষিমেলার হটাৎবন্ধ হওয়ায় এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য সফল হবে কিনা এমন প্রশ্ন অনেকের।

কন্দাল ফসল চাষের উপযোগী মাটি, জলবায়ু ও চাষের চাহিদার ওপর ভিত্তিতে দেশের আট বিভাগের ৬০ জেলার ১৫০ টি উপজেলাকে এই প্রকল্পের এলাকা নির্বাচন করা হয়েছে। তার মধ্যে মুজিবনগর একটি।

মেহেরপুর কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ি এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫৬ কোটি ৩১ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় ৬ হাজার ৯শ ৮১ ব্যাচ কর্মকর্তা-কর্মচারি, কৃষক, স্টেকহোল্ডার প্রশিক্ষন দেয়া, ২ হাজার ৮৪৪টি কৃষক মাঠ দিবস, ৪৫০ ব্যাচ উদ্বুদ্ধকরণ ভ্রমণ এবং ৩০০টি কৃষিমেলার আয়োজন করার কথা। আগামী ডিসেম্বরে এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে।

মেহেরপুর সদর উপজেলা কৃষি অফিসার এবং মুজিবনগর উপজেলার অতিরিক্ত দায়িত্ব থাকা কৃষি অফিসার আলমগীর হোসেন জানান, সবার সাথে আলোচনা করা হয়েছে যেহেতু প্রতিমন্ত্রী মহোদয় থাকবেন বড় প্রোগ্রাম খরচ অনেক বেশি তাই একদিনে শেষ করা হয়েছে।
মেলা বন্ধের জন্য প্রকল্প পরিচালকের অনুমতি নেওয়া হয়েছে। অথচ মেলায় ডেকোরেশনকারী ডেকোরেটরের মালিক শাহিন আলী বলেন, আমার সাথে কৃষি অফিসারের একদিনের চুক্তি ছিল। তাই উদ্বোধনের দিনই সব ভেঙে ফেলা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কৃষি অফিসের এক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বলেন, উর্ধতন কতৃপক্ষের নিদের্শেই মেলা বন্ধ করা হয়েছে।

কন্দাল ফসল উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মোখলেছুর রহমান মোবাইল ফোনে জানান, মেলা তো তিনদিন হওয়ার কথা। সময়ের আগের মেলা বন্ধ হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তারপরও আমি উপজেলা কৃষি অফিসারের সাথে কথা বলে বিষয়টি দেখছি।




আধুনিক কৃষিতে গতি পেয়েছে অর্থনীতি

ঝড়, জলোচ্ছাস বন্যা, শীত, খরা, তাপদাহসহ জলবায়ূ পরিবর্তণের ধাক্কা সামলিয়ে কৃষি বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এসেছে বিস্ময়কর সাফল্য ও অভাবনীয় পরিবর্তণ। একসময় বলা হতো দুধে-ভাতে বাঙালি কিম্বা মাছে ভাতে বাঙালি। এখন দুধে-ভাতে কিম্বা মাছে-ভাতে বাঙালি সীমিত নয়। পুষ্টিতে বাঙালি হিসেবে এদেশে বিশ^ দরবারে প্রশংসিত হচ্ছে ও পরিচিত লাভ করেছে। মেহেরপুরের কৃষিও পরিবর্তণ হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে মেহেরপুরের কৃষক।

মেহেরপুর কৃষিনির্ভর জেলা। যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা চিরন্তন গ্রামীণ কৃষি এবং কৃষিনির্ভর জীবন ও সংস্কৃতি বিলুপ্তি হয়ে যাচ্ছে । গত দেড়যুগে অলাভবান সব আবাদই হারিয়ে গেছে। যেসব আবাদ হচ্ছে সেগুলো বানিজ্যিক ভিত্তিতে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা রবিশষ্য এখন পারিবারিক প্রয়োজনে সখের বশে কেউ কেউ আবাদ করে। জেলায় রবীশষ্য চাষের জমিতে খেসারী, যব, তিসি, ছোলা, ভুরু, শেয়ালল্যাজা, কদু ইত্যাদি চাষ একেবারেই বিলুপ্ত। বানিজ্যিক ভিত্তিতে এখন সমতল জমিতে আবাদ হচ্ছে ড্রাগন, কমলা লেবু, নেওয়া আতা, গ্যান্ডারী, আম, পেঁপে, কলা ইত্যাদি। খাল বিলে চাষ হচ্ছে মাছের।ফলে ডোবা নালাতে আর দেশি জাতের মাছ উৎপাদন হচ্ছে না। যেসব জমিতে আউশ ও রবীশষ্য চাষ হতো সেসব জমিতে এখন জেনেটিক বীজে ইরি আউশ আমন ধান চাষ হচ্ছে। প্রকৃতিও বদলে গেছে।

একযুগ আগেও এই সময় খাল বিল পানিতে ডুবে থাকতো। এখন প্রকৃতি বিপর্যয় কারণে খাল বিলের তলদেশে রবীশষ্য চাষ হয়। মেহেরপুরের গাংনীর ষোলটাকা ও মেহেরপুর সদরের ঝাউবাড়িয়া গ্রামে কৃষি চাষ ছেড়ে মাছচাষ বেড়েছে। ওই গ্রামদুটিতে প্রায় ১৫শ পুকুরে মাছের চাষ হয়। প্রতিবছরই সেখানে মাছ চাষের জন্য পুকুর খনন করা হচ্ছে। অনেকে বাড়ি সংলগ্ন পুকুর খনন করেছে। কৃষির এমন পরিবর্তনে গত দেড়যুগে মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে চরমে। মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে কেন্দ্র করে প্রান্তিক জনপদের গ্রামে গ্রামে সম্প্রসারিত হয়েছে বাণিজ্যিক কৃষি। গ্রামবাংলার ঘর-গৃহস্থালি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পারিবারিকভাবে হাঁস-মুরগি পালনের সংস্কৃতি। আর পুকুরে পানির ওপরে মুরগি এবং পানিতে চলছে মাছ চাষ।

গ্রামবাংলায় যেখানে সিংহভাগ পরিবারে ছিলো হালচাষের গরু। হাল বিক্রি করেই চলতো অনেক পরিবারের জীবন মান। দুইযুগ আগেও গ্রামীণ ও শহুরে জোতদার পরিবারে ছিলো রাখাল, কৃষান। এখন কোন পরিবারে মেলেনা হালের গরু। রাখাল কৃষাণ এখন ইতিহাসের পাতায়। মূলত অর্থনেতিক কারণে দ্রুত বদলে গেছে গ্রামীণ কৃষি। শিক্ষিত বেকার ও প্রবাস ফেরৎ যুবক সম্প্রদায় ধানী জমিতে সমন্বিত মাছচাষ, মুরগি, গবাদিপশুর খামার, এবং ফল চাষের প্রকল্প চালু করছে। প্রতিটি গ্রামের মাঠেই হাজার হাজার হেক্টর জমিতে গড়ে উঠেছে আম, লিচু, কলা, মাল্টা, কুল, পেয়ারা ইত্যাদির বাগান। লাভজনক হবার কারণে সমতল ধানি জমিতে পুকুরও করছেন অনেকেই। মৌসুমী ফল চাষ এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে কি পরিমাণ চাষের জমিতে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে তার সঠিক তথ্য কৃষি বিভাগের হাতে নেই।

ক্রমাগত জমির হাত বদল হয়ে পেশাজীবী, ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাওয়া, প্রধান ফসল ধানের পরিবর্তে ফলের বাগান বৃদ্ধি পাওয়া, ফসলি জমিতে শিল্প কারখানাসহ ইটভাটা গড়ে ওঠার কারণে জেলার কৃষি ক্ষেত্রে সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়ার আশংকা উড়িয়ে দিচ্ছে কৃষি কর্মকর্তারা।

গাংনীর ষোলটাকা গ্রামের দেলবার হোসেন জানান- তিনি গ্রামে ৮টি পুকুরে মাছের চাষ করেন। প্রতিটি পুকুর প্রায় এক একর করে। প্রতিদিন মাছের খাবার লাগে ৫০ হাজার টাকার। প্রতিটি পুকুরে বছরে গড়ে ৭০ লাখ টাকার মাছ উৎপাদন হয়। মাছের খাবারের জন্য তিনি একটি মিল স্থাপন করেছেন।

মেহেরপুর জেলা শহরে প্রাচিন একটি পাড়া। বেড়পাড়া নামে পরিচিত বিশাল এই পাড়ায় শতাধিক পরিবারের বাস। ৭০ দশক পর্যন্ত তিনটি পরিবার ছাড়া কোন পরিবারের স্কুলমুখি ছেলে মেয়ে ছিলোনা। এখন সিংহভাগ পরিবারের ছেলে মেয়ে স্কুলমুখি। সবগুলো পরিবারেই ছিল দেশি হাঁস-মুরগি, হালের বলদ। ব্লাকবেঙ্গল ছাগল পালন ছিলো প্রতিটি পরিবারে। কৃষিচাষের সাথে জড়িত ছিলো এসব পরিবারগুলো। গত আড়ায় যুগের ব্যবধানে বর্তমানে আমন ধান চাষ করে এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া মুশকিল। একমাত্র হালের বলদ টিকে আছে দেলবার হোসেনের (দেল) বাড়িতে। আরসব বাড়ি থেকে বিদায় হয়েছে হালের গরু। এখন বানিজ্যিক ভিত্তিতে পরিবারগুলো দুটি একটি করে গবাদিপশু পালন আর মাঠের জমিতে বাণিজ্যিকভাবে কলা, আমড়া, আম, পেয়ারা, বনজ গাছ এবং সমন্বিত মাছ-মুরগি চাষ নিয়ে আছে। গৃহপালিত হাঁস-মুরগিও উচ্ছেদ হয়ে গেছে প্রায় সব পরিবার থেকে। দেল হোসেন জানান- আগে তিনি নিজের জমির চাষ আর হাল বিক্রি করে জীবীকা নির্বাহ করতেন। আধুনিক প্রযুক্তির কারণে হাল চাষ চাহিদা হারিয়েছে। গরু-মহিষ দিয়ে ধান চাষ এবং মাড়াইয়ের কাজ হতো। সেটাও বন্ধ। এখন জমি চাষ এবং ধান মাড়াইয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে যন্ত্র প্রযুক্তি। বিয়ে সাদিতে গরুর গাড়ি ছিলো যাতায়াতের পরিবহন। এখন প্রাইভেট কার। তাই হালের গরু উঠে গেলেও দেল নিজের জমি চাষের জন্য এখনও গরু পালন করেন।

পাড়ার মরহুম কালু মণ্ডল, মরহুম ফজলুর রহমানের গোয়াল ভরা গরু ছিলো। পারিবারিক দুধের চাহিদা মেটাতে ছিলো গাভি গরু । ছিলো রাখাল ও কৃষান। তাদের বাড়ির পাশে নিজেদের এবং পাড়ার মানুষের জমির ফসল মাড়ার জন্য খোলা ছিলো। জমি থেকে ধান কেটে এনে আঁটি বেঁধে ওই খোলাতে সাজিয়ে রাখা হতো। পরে হতো ধান ও রবীশষ্য মাড়াইয়ের কাজ। পাড়ার বাড়ি থেকে গরুর দল জুড়ে মলন মাগা হতো। ভর দুপুরে এই ফসল মাড়ায়কালে খোলার আশপাশে কেউবা গুড়ের তিলের খাজা, খুরমা, জিলেপি ইত্যাদি তৈরী করে এনে বসে থাকতেন। ধান, গম, মসুর, ছোলা ইতাদির বিনিময় হতো ওইসব মিষ্টান্নর সাথে। শীতের সময় ফজরের আজান থেকে উঠানের পাশে টিনের তৈরি বিশাল কড়াইয়ে হতো ধান সিদ্ধ করার কাজ। সিদ্ধ সেই ধান শুকিয়ে বাড়ির ঢেঁকিতে ছেটে চাল সংরক্ষণ করা হতো। এখন উঠান, ফসল মাড়ায়ের খোলা, গোয়াল ঘর নেই। ধানের জমি যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাতে আর কোনো আমন ধান চাষ নেই। চলে গেছে ইরিচাষ আর ফলবান বাগানের অধীনে। একসময় যারা জোতদার ছিলেন। বাড়িতে রাখাল কৃষান রেখে চাষাবাদ করতেন। তাদের শতকরা ৯০ ভাগ এখন জমি বর্গা দিয়েছেন। ভূমিহীন পরিবারগুলো এখন অন্যের জমি বর্গা নিয়ে বর্গাচাষী হয়েছেন।

কৃষক বছরের পর বছর ধানের দাম পাচ্ছে না। দাম না পেয়ে জমিতে ফলজাতীয় বাগান করছেন। এখানে কোনও ঝুঁকি নেই। যেমন আমের মুকুল আসার আগেই বাগান বিক্রি করে নগদ টাকা পাওয়া যায়। সার বিষ পানিসহ সকল পরিচর্যা যিনি বাগান চুক্তিতে কেনেন তার দায়িত্বে থাকে। ফলে বাগান নিয়ে বাড়তি কোনও ভেজাল করতে হয় না।

জেলায় সরকারি হিসেব মতে ১৪,৬২০০ পরিবার জেলার মোট কৃষক। ১,৫৫,৪৬৬ হেক্টর ফসলী জমি। জেলার খাদ্যচাহিদা আছে ১,৩৯,৮৫৩ মেট্রিক টন। উৎপাদিত হয় ২,৬৬,৬৯২ মেট্রিক টন। ১২৬৮৩৯ মেট্রিকটন উদ্বৃত্ত খাদ্য জাতীয় খাদ্যভান্ডারে অবদান রাখছে। এ তথ্যের বাইরে জেলায় কি পরিমাণ জমিতে গত একযুগে ফলের বাগান, ইটভাটা, পুকুর খনন, ইমারত নির্মাণ হয়েছে সে তথ্য নেই জেলা কৃষিবিভাগের কাছে।

মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শঙ্কর কুমার মজুমদার বলেন- কৃষক এখন অনেক সচেতন। কোন চাষে লাভবান হবে ভাবনা থেকেই চাষ পরিবর্তন করছে। তবে মেহেরপুর জেলার মাটি দেশের অন্যজেলার থেকে আলাদা। এই জেলার মাটিতে সব ধরনের ফসল উৎপাদন হয়। ফলের চাষ বৃদ্ধি পাওয়াতে জেলার চাহিদা মিটিয়েও জেলার বাইরে বাজারজাত করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছে।

মেহেরপুরের উর্বর জমি, আমাদের অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদ, আমাদের পরিশ্রমী মানুষ, আমাদের গবেষণা সম্প্রসারণ কাজে সম্প্রসারণ কাজে সমন্বয় করলে মেহেরপুরের কৃষি জাতীয় খাদ্যভান্ডারে আরও অবদান রাখতে পারবে।




ধাতুসুধায় লালনপাঠ

মূলকথা
ঋষিমতে শব্দ পরাশক্তি বিশেষ। মানবিক বিভিন্ন চেতনা বর্ণকে আশ্রয় করে শব্দে রূপান্তরিত হয়। তাই শব্দ ও চেতনা একে অপরের পরিপূরক। কারও শব্দসংস্কৃতি থেকে তার চেতনা পরিমাপ করা যেতে পারে। শব্দ সংস্কৃত হয় তার অখণ্ড রূপ থেকে; আবার এই অখণ্ডতা বা সম্পূর্ণতা নির্মিত হয় মূলানুগ হলে। গোটা ভাব বা বস্তুকে যা দিয়ে ধরে রাখা যায় সেটাই তার মূল বা ধাতু। দেহ নানাপ্রকার প্রাণরস ধারণ করে টিকে থাকে, সেগুলোই দেহের ধাতু। ঠিক তেমনই শব্দ একটি ভাব বা চেতনার কাঠামো যা ধাতুকে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে। শব্দের গোটা ছবি দেখতে হলে ধাতুবিচার খুবই জরুরি। ধাতু বা মূলের বাইরে থেকে শব্দকে দেখা অনেকটা কুয়াশার ভেতর কিছু অস্পষ্ট দেখার মতো।

এই দৃষ্টিভঙ্গিতে শব্দার্থবোধ অনমনীয়, ভঙ্গুর, সঙ্কীর্ণ, অবৈজ্ঞানিক ও অসম্পূর্ণ হতে বাধ্য। যেমন দেহ ও শরীরÑএই দুটো শব্দ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। আমরা প্রায়শ দেহকে শরীর আবার শরীরকে দেহের সঙ্গে সমার্থক করে একাকার করে ফেলি। স্থূল বা প্রতীকী অর্থে তা সঠিক বটে। তবে মূল বা ধাতুবিচাওে দেহ কিন্তু শরীর নয়, শরীরও দেহ নয়। দেহ শব্দকাঠামোর ভেতরে দিহ্ ধাতু উপস্থিত। এর অর্থ বৃদ্ধি, প্রসারণ; জীবসত্তা ভ্রƒণাবস্থা থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ততক্ষণ সেটা দেহ নামধারী।

জৈবিক নিয়মে এই বাড়ন্তভাব আবার উল্টোদিকে ধায় অর্থাৎ ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে; কায়াসত্তার এই ক্ষয়ে-যাওয়া-দশার নাম শরীর। শৃ বা শর ধাতুযোগে শরীর শব্দটি সাধিত। এর অর্থ হিংসা, বধ, পীড়ন। দেহের সীমানা পেরিয়ে জীবসত্তা শরীরের চৌহদ্দিতে ঢুকলে শর দ্বারা আক্রান্ত হয়। শরের একটি অর্থ তীর। তীরের কাজ বিদ্ধ করা। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, হতাশা, অবসাদ, ক্লান্তি ইত্যাদির নাম মানসিক শর। উচ্চ রক্তচাপ, বহুমূত্র, কর্কট (ক্যান্সার), বাত প্রভৃতি হল কায়িক শর। অসংখ্য নমুনা থেকে মাত্র দুটো নমুনার ধাতুবিচার করে দেখা গেল শব্দ নিছক শব্দ নয়, এর পরিধি অনেক বিস্তৃত ও তলগামী।

লালন সাঁইজির পদাবলী বাংলা তথা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে একটি বিরাট সম্পদ। তাঁর পদ বিভিন্ন সাধক ও সারস্বত সমাজ মূল্যায়ন করেছেন। এই অধম তাঁর পদগুলো ধাতুবিচারে দর্শন করার সযত্ন প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। “ইটিমোলজি” (শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণায়ক শাস্ত্র) আমার একটি সর্বাত্মক অনুসন্ধানের বিষয়। দীর্ঘ প্রায় দু-দশক এই সন্ধানক্ষেত্রে চষে বেড়াচ্ছি। এতে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ভাষার শব্দের আন্তরিক ঐশ্বর্য আমার চোখে পড়ছে। দশকজোড়ের অভিজ্ঞতায় এই বিশ্বাস জন্মেছে মূলবিচারে শব্দের স্বরূপ যেভাবে উন্মোচিত হয় অন্য কোনো উপায়ে তার রূপ সেভাবে ফোটে না।

এ প্রসঙ্গে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করা যেতে পারে। শাস্ত্রালোচনায় অনেক সময় তিনি তাঁর ভক্তদেরকে বিশেষ বিশেষ শব্দের তাৎপর্য বোঝাতেন মূল বা ধাতুবিচার করে। মরমী সাধক লালন ফকিরের পদও মরমী যা মর্ম (ধাতু) থেকে অনুভব করতে হয়। লোকপ্রিয় কথা লোকজ সুরে পরিবেশিত হয় বলে সাধারণ লোক সরফের কথা ও সুরের চটকে মুগ্ধ হন। ভেতরের বার্তা তাদের কাছে হয় ভাসাভাসা থাকে নতুবা একেবারেই বোধগম্য হয় না। তাই এই পদ অনেক সময় সম্পদ না হয়ে বিপদ তৈরি করে।

এই সম্পন্নপদকে কৌতূহলী পাঠকের দরবারে পদস্থ করতে আমি ধাতুসুধার আশ্রয় নিয়েছি যা “ধাতুসুধায় লালনপাঠ” শিরোনামে উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে। এতে তাঁর পদাবলীর প্রত্যেকটি চরণ ও পারিভাষিক শব্দাবলী মূল থেকে অর্থাৎ ধাতুবিচারের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

           ১। ‘বলি মা তোর চরণ ধরে’

আর আমারে মারিস নে মা
বলি মা তোর চরণ ধরে ননী চুরি আর করব না।।

ননীর জন্যে আজ আমারে মারলি গো মা বেঁধে ধরে
দয়া নাই মা তোর অন্তরে স্বল্পেতে গেলো জানা।।

পরে মারে পরের ছেলে কেঁদে যেয়ে মাকে বলে
মা জননী নিঠুর হলে কে বোঝে শিশুর বেদনা।।

ছেড়ে দে মা হাতের বাঁধন যে দিকে যায় দুই নয়ন
পরের মাকে ডাকব এখন লালন তোর গৃহে আর থাকব না।।

‘আর আমারে মারিস নে মা
বলি মা তোর চরণ ধরে
ননী চুরি আর করব না।’
পদাবলীতে বর্ণিত শব্দমালা থেকে প্রথমে মা শব্দটি নিয়ে আলোচনা করা যাক। এখানে ‘মা’-কে মায়াবা প্রকৃতিস্বরূপ বিবেচনা করে এগোলে বাণীর অর্থ দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। আমরা জানি সংসারে মায়ার কারণে জীব মোহগ্রস্ত থাকে। মলিনতা তাকে ঘিরে ধরে; তার নবরূপে উত্তরণের সম্ভাবনা রুদ্ধ হয়। পুরুষÑপ্রকৃতির নিত্যলীলায় প্রকৃতি বা মায়ার যে লীলা তাকেই মায়ার মার হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। মায়ার উপদ্রব বা অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়ার আকুতি সাঁইজির বয়ানে এভাবে উঠে এসেছেÑ ‘আর আমারে মারিস নে মা।’ এবার ‘ননী চুরি’র বিষয়টি দেখা যাক। ননী চুরি থেকে ননী শব্দটির মর্ম উদ্ধার করি। নবনীত>নবনীঅ>ননীÑ মূলত ননী শব্দটি নবনীত থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে ননীতে এসেছে। নবনীত অর্থাৎ নূতন অবস্থায় উন্নীত হওয়া; দুধের ভেতর থেকে জল নিষ্কাশন করলে তা ননী পর্যায়ে পৌঁছোয়। এটা দুধের একটি নতুন সত্তায় উত্তরণ ঘটা। ঠিক একইভাবে জাগতিক বন্ধনে আবদ্ধ জীব জলমেশানো দুধের মতো ভেজাল বা দূষিত। এই মায়ার পাশ কাটিয়ে জীব মুক্ত হতে সমর্থ হলে তার উত্তরণ ঘটে; আর এটি একটি নূতন বা নবরূপে উন্নীত হওয়া যাকে সাঁইজি ননী হওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন।

জাগতিক মায়া ষড়রিপুর জালে জীবকে আটকে রাখতে চায়; কেউ কেউ এই জাল ছিন্ন করে বের হওয়ার চেষ্টা করে। আর ঠিক তখনই মায়া সংহার-মূর্তি ধারণ করে মারমুখী হয়ে ওঠে। তবে এখানে ‘ননী চুরি আর করব না’ কিন্তু মায়ার সঙ্গে আপোষকামিতা নয়। ভাবখানা এমন যেন তোমাকে ভজনা বা আরাধনা করেই সাধনের গোপন কর্মটি সম্পন্ন করব। এ প্রসঙ্গে সাধক রামকৃষ্ণের অতুল্য উপমার উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁর মতে লক্ষ্মণÑসীতাÑরাম একই পথে চলছে অথচ লক্ষ্মণ রামকে দেখতে পাচ্ছে না সীতার কারণে। মায়ারূপী সীতা মাঝখানে থাকায় জীবরূপী লক্ষ্মণ পরম রামকে দর্শন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। মায়াবেড়ি ভেঙে বের হওয়ার শাস্তি সাঁইজির বাণীতে এভাবে ধরা পড়েছেÑ ‘ননীর জন্যে আজ আমারে মারলি গো মা বেঁধে ধরে।’
এর পরের চরণ দুটিÑ
‘দয়া নাই মা তোর অন্তরে
স্বল্পেতে গেল জানা।’
মায়া তোর ভেতর দয়া নেইÑএ কথাটিকে সাঁইজি বলেছেনÑ ‘দয়া নাই মা তোর অন্তরে।’ বস্তুত দয়া ও মায়া একসঙ্গে থাকতে পারেনা; কারণ এরা একে অন্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। সর্বভূতে উপকার সাধনের নাম দয়া অর্থাৎ এটি একটি সার্বজনীন করণ ও সাধন, পক্ষান্তরে মায়া একান্তই মমতার সমার্থক যা শুধু নিজের ক্ষুদ্র গণ্ডিতেই তার চলনকে সীমিত রাখে। আর এই দয়া ও মায়ার ফারাক জানা যায় ফারুক হলে, যা আবার সূক্ষ্মজ্ঞান বা বোধি নির্দেশক। এই সূক্ষ্মতার হিসেব নিকেশকে সাঁইজি বললেনÑ ‘স্বল্পেতে গেল জানা।’

‘পরে মারে পরেরছেলে
কেঁদে যেয়ে মাকে বলে।’
এখানে ‘পর’ ও ‘ছেলে’ শব্দদ্বয়ের ভেদ উন্মোচন হওয়া আবশ্যক। ‘পর’ এখানে ‘পরম’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। লালন সাঁইজি তাঁর একটি পদে সরাসরি ‘পর’ অর্থে ‘পরম’-কে নির্দেশ করেছেন। ‘আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে’-এই পদাবলীর আভোগাংশে ‘লালন বলে পর বলতে পরওয়ার’-চরণটিই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। এই সূত্রে ‘পরের ছেলে’-বাগি¦ধির অর্থ দাঁড়ায় পরমের সন্তান। সন্তান অর্থ বিস্তার; আদি(পুরুষ) তার শক্তি নিয়ে অর্থাৎ আদ্যাশক্তিতে মহাজগতে আবির্ভূতÑএটাই মূলত পরমের সন্তান বা ছেলে।

‘মা জননী নিঠুর হলে
কে বোঝে শিশুর বেদনা।’
জননীর মধ্যে জনন বা সৃজন রয়েছে; সুতরাং ‘মা জননী’ শব্দযুগলের অর্থ মায়া সৃষ্টিকারী সত্তা; এই সত্তার অভেদ্য বলয় অত্যন্ত কঠিন বা নিষ্ঠুর। মায়ার ঘেরায় বাসকারী মূঢ়জন দয়া, কোমলতা, নবীনতা যা কিনা শিশুসত্তার গুণাবলী সে সম্পর্কে সংবেদনশীল থাকে না। আর এই অবস্থাকে সাঁইজি বাণীবদ্ধ করেছেন এভাবেÑ‘মা জননী নিঠুর হলে কে বোঝে শিশুর বেদনা।
‘ছেড়ে দে মা হাতের বাঁধন
যেদিকে যায় এই দুই নয়ন।’
উপর্যুক্ত দুটি চরণে মায়া বা মুগ্ধতার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার মিনতি প্রকাশিত হয়েছে।
‘পরের মা কে ডাকবে এখন লালন
তোর গৃহে আর রবে না।’
পদাবলীর সর্বশেষ দুটি পঙক্তিতে পরের মা অর্থাৎ পরম মা (পরম মান) অন্য কথায় পরমপ্রকৃতিকে আশ্রয় করে সাঁইজি মায়ার গৃহ ত্যাগ করার সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন। জগৎসংসারের ভগ্নাংশ মান (মায়া) থেকে বেরিয়ে মহাজাগতিক পূর্ণমান (পরের মা)-এ পৌঁছানোর জন্য ননী চুরির অপরিহার্যতাই এই পদাবলীর মূল প্রতিপাদ্য।

২। সত্য বল সুপথে চল
সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন
সত্য সুপথ না চিনিলে পাবি নে মানুষের দরশন।।

খরিদদার মহাজন যেজন বাটখারাতে কম তারে কসুর করবে যম
গদিয়াল মহাজন যেজন বসে কেনে প্রেমরতন।।

পরের দ্রব্য পরের নারী হরণ করো না পারে যেতে পারবে না
যতবার করিবে হরণ ততবার হবে জনম।।

লালন ফকির আসলে মিথ্যে ঘুরে বেড়ায় তীর্থে তীর্থে
সই হলো না একমন দিতে আসলেতে তার প’লো কম।।

‘সত্য বল সুপথে চল
ওরে আমার মন
সত্য সুপথ না চিনিলে
পাবি নে মানুষের দরশন।’
উদ্ধৃত বাণীগুচ্ছের বক্তব্য বেশ সাদামাটা হলেও মানুষ শব্দটির মর্মার্থ অনুসন্ধান জরুরি। প্রতিটি ব্যক্তি মনের অধিকারী। ঐ মনের মধ্যে মানুষের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় সত্য উচ্চারণে এবং সুপথ গমনে। অর্থাৎ সত্যই ‘বল’ মিথ্যা দুর্বল, আবার সুপথই হল ‘চল’ বিপথ অচল। ‘মানুষ’ এখানে পুরুষের সমার্থক। মহাজগতের পুরা(পূর্ণ) ও পুরু সত্তাই মূলত পুরুষ দ্যোতক। জীবাত্মক মন নিত্য চেতনায় (সত্য) বিচরণ করলে পূর্ণতার মানে উঠে আসে তখন এই মন ঐ মানুষ (পুরুষ)-কে দেখতে পায়। যা লালনভাষ্যে এভাবে ধরা দেয়Ñ
‘সত্য সুপথ না চিনিলে
পাবি নে মানুষের দরশন।’

‘খরিদদার মহাজন যেজন
বাটখারাতে কম
তাদের কসুর করবে যম;
গদিয়াল মহাজন যেজন
বসে কেনে প্রেমরতন।’
পদাবলীর এই অংশে খরিদদার মহাজন ও গদিয়াল মহাজন অর্থে দুটি পক্ষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লিখিত যুগল পক্ষের একটি অপূর্ণতা বা ঘাটতি সূচক (খরিদদার মহাজন) অন্যটি পূর্ণতাব্যঞ্জক (গদিয়াল মহাজন)। সাধারণ জীবসত্তার মান ‘একমন’-এর থেকে ঊন বা হীন তাই তা ওজনে (বাটখারা) কম। মানসম্মত (একমণ) ওজন থেকে কমতির ফলে জীবসত্তা ত্রুটিপূর্ণ (কসুর) হয়ে খণ্ডিত (যম) হয়। সোজা কথায় একমন (বাহ্যিক ওজনের একক এবং অভ্যন্তরীণ অখণ্ডতার একক) থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দরুণ অদ্বৈত থেকে দ্বৈততার দিকে যে যাত্রা তাকেই সাঁইজি ‘তাদের কসুর করবে যম’ বলে অভিহিত করেছেন। পক্ষান্তরে যেজন পূর্ণমান (গদিয়াল) অর্জন করে সেই মানুষ (পুরুষ) এর সঙ্গে অভিন্ন হয়েছেন তিনি থিতু হয়ে মনের মানুষের সঙ্গে রমণ (প্রেমরতন) করতে সক্ষম হন। প্রেমারতির এই দিকটি লক্ষ্য করে লালন গেয়ে ওঠেনÑ ‘গদিয়াল মহাজন যে জন বসে কেনে প্রেমরতন।’

‘পরের দ্রব্য পরের নারী
হরণ করো না
পারে যেতে পারবে না।’
এখানে পরের দ্রব্য, পরের নারী ও পারÑএই তিনটি শব্দের মূলানুগ বিচারে মৌলিক বার্তার উন্মোচন হতে পারে। শুরুতে ‘দ্রব্য’ শব্দটির ধাতুবিচার: কোনো বস্তুকে দ্রব্যবাচক হতে গেলে তার ভেতর দ্রুতি বা গতি থাকতে হয়; বস্তু রসাত্মক হলে গতি হয় নিশ্চিত। তার মানে দ্রব্য, দ্রবণ একই ধাতুগোষ্ঠীর সদস্য। মহাজগতে যে রসের কারবার চলছে তা বিভিন্ন দ্রব্যে সন্নিবেশিত রয়েছে। প্রতিটি মানুষ এক একটি বিশাল রসের আধার। এই রসায়নের খবর পেতে হলে রস ধারণ বা সাধন অবশ্যকর্তব্য। যে রস ধারণ করলে মানুষ বীর(পুরুষ), বলবান হয় তা-ই পরম দ্রব্য (পরের দ্রব্য) প্রধান সাধনবস্তু।

এবারে পরের নারী। নারী শব্দটি ‘নর’ এর সঙ্গে ‘ঈ’ প্রত্যয়যোগে নিষ্পন্ন। নর একা চলতে পারে না তাকে কিছু ধরতে হয় যাকে আমরা নরের ধর্ম বলতে পারি। অর্থাৎ নরের ধর্মই নারী; সুতরাং পরম নরধর্মকে পরের নারী বলা যায়। যা আসলে পরমাপ্রকৃতির নামান্তর।

এখন ‘পার’-এর পালা। জগৎসংসারে এসে মানুষ নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকতে পারে না; কর্ম করার অর্থই হল মোহপাশে আটকে যাওয়া; তবে কি কর্মবিমুখ হতে হবে? ঠিক তা নয়Ñ সংসারসমুদ্রে কর্মের সততা অসততা বিচার করে অর্থাৎ কর্মসম্পাদনের ভেতর দিয়ে তীরে পৌঁছুতে হবে। এর নাম কর্মসমাপ্তি যা বোঝাতে সাঁইজি ‘পার’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। তাহলে ‘পরের দ্রব্য পরের নারী হরণ করো না/পারে যেতে পারবে না।’ চরণযুগলের ভাষ্য দাঁড়ায়Ñ পরম সাধন বস্তু ও পরমা প্রকৃতিকে লুণ্ঠন করে কর্মসম্পাদন অসম্ভব।
‘যতবার করিবে হরণ
ততবার হবে জনম।’
গর্ভ থেকে যোনিপথে নিঃসরণের নাম জনম। সুতরাং যতক্ষণ কর্ম অসম্পাদিত থাকবে ততক্ষণ জীব বিভিন্ন যোনিতে পরিভ্রমণ করবে।
‘লালন ফকির আসলে মিথ্যে
ঘুরে বেড়ায় তীর্থে তীর্থে।’

পদাবলীর ভণিতাংশে সাঁইজি আমজনতার দরবারে নেমে এসে ভনেÑ লালন ফকির আসলে মিথ্যে; এখানে ‘আসল’ শব্দের আসলত্ব খোঁজা যাক। আসল বা খাঁটি বস্তুটি হল ‘একমন’ (যার ব্যাখ্যা আগে দেওয়া হয়েছে)। দুটো সত্তার (জীব ও পরম) এক বা অভিন্ন হওয়াটাই হল আসল। আর এই আসলের জায়গা থেকে সাধারণের কাতারে নেমে আসা লালন মিথ্যে বা নকল। পদাবলীর অনেক ভণিতায় সাঁইজি তাঁর ভূমিকাকে সাধারণীকরণ করে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন।
‘ঘুরে বেড়ায় তীর্থে তীর্থে’

এক হতে ব্যর্থ হওয়ায় বিচ্ছিন্নতার ফলে জীবসত্তা ভ্রমের মধ্যে থাকায় তার ভ্রমণ চলছেই। এটিকেই তিনি ‘ঘুরে বেড়ায় তীর্থে তীর্থে’Ñবলে পদবদ্ধ করেছেন। তীর বা কর্মসম্পাদনে থিতু হওয়াটাই মূলত তীর্থ।
যখন ওজনের একক একমণ ও অদ্বৈতের একক একমন সই বা শুদ্ধ হয় না তখন একমণে/মনে ঘাটতি থেকে যায় যেটিকে লালন ছন্দোবদ্ধ করেছেন এভাবেÑ ‘সই হলো না একমন দিতে/আসলে তার প’লো কম।’

৩। তিন পাগলে হলো মেলা
তিন পাগলে হলো মেলা নদেয় এসে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।।

একটা পাগলামি করে জাত দেয় সে অজাতেরে দৌড়ে গিয়ে
আবার হরি বলে পড়ছে লুটে ধুলোর মাঝে।।

একটা নারকেলের মালা তাতে জল তোলাফেলা করঙ্গ সে
পাগলের সাথে যাবি পাগল হবি বুঝবি শেষে।।

পাগলের নামটি এমন বলিতে অধীন লালন হয় তরাসে
ও সে চৈতে নিতে অদ্বয় পাগল নাম ধরে যে।।

‘তিন পাগলে হলো মেলা নদেয় এসে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।’
উল্লিখিত শব্দমালার তিন পাগল ও ‘নদে’ শব্দজোড়ের রহস্য উদ্ঘাটন হলে এর ভেতরের অর্থ আমাদের বোধগম্য হবে। ‘নদে’: এটিকে অনেকেই একটি স্থাননাম হিসেবে অনুবাদ করে থাকে। মধ্যযুগে শ্রীচৈতন্যসহ তিন আত্মতত্ত্ববিদের নদীয়া ভূখন্ডে যে মিলন মেলা রচিত হয়েছিল তাকে কেউ কেউ ‘তিন পাগলে হলো মেলা নদেয় এসে’-বলে অভিহিত করে থাকেন। এই অভিমত মেনে নিলে সাঁইজির পদনিহিত বার্তা একটি বিশেষ স্থান-কাল পাত্রে আবদ্ধ হয়ে যায়। একজন কালোত্তীর্ণ পুরুষের বাণী কখনও সীমিত স্থানকালে বন্দি হতে পারে না। তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী সনাতন ও শাশ্বত হওয়াই স্বাভাবিক। এই পদাবলীর অন্তিমে সাঁইজি তিন পাগলের নামগুলি সুস্পষ্ট ঘোষণা করে তাদের সার্বজনীন স্বরূপ নিশ্চিত করেছেন। সুতরাং এই নদ যে ভৌগোলিক নদীয়া নয় তা সুনিশ্চিত। এখানে প্রবাহ অর্থে ‘নদ’কে বোঝানো হয়েছে। মানবদেহে ঈড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না নাড়ির ধারা প্রবাহিত। তাদের সম্মিলিত ধারা মিলেছে কুলকুণ্ডুুলিনীতেÑএটাকে সাঁইজি ‘তিন পাগলে হলো মেলা নদেয় এসে’Ñবলে বর্ণনা করেছেন। ‘তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে’Ñ এটি হল একধরণের প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারী। ঈড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না নাড়ীত্রয়ের সাধন অসম্পূর্ণ থাকলে দেহ সংস্কার হয় না, বিকারগ্রস্ত থাকে। এই বিকৃত মানসিকতায় পরমপ্রেমে আত্মহারা পাগলের কাছে ভেড়াটা ঠিক নয়।
‘একটা পাগলামি করে
জাত দেয় সে অজাতেরে দৌড়ে গিয়ে।’
পাগলের ‘আমি’(ঝবষভ)-র মধ্যে যে ভাব তার নাম পাগলামি। লালনঘোষিত পাগলত্রয়- চৈতে, নিতেই, অদ্বয়Ñএটা মূলত উপনিষদের সৎ-চিৎ-আনন্দ বা সচ্চিদানন্দ সত্তা। চিৎস্বরূপ সত্তা চৈতে, নিতাই হল নিত্যানন্দ এবং অভেদ দ্বৈততাহীন ব্রহ্ম সত্তাই হল সাঁইজি নির্দেশিত অদ্বয়। আবার সাঁইজির এই তিন পাগল রামকৃষ্ণের ভাবসঙ্গীতে মূর্ত হয়েছে এভাবেÑ
‘বামে অদ্বৈত আর দক্ষিণে নিতাই
তার মাঝে নাচে আমার চৈতন্য গোঁসাই।’
উক্ত ভাষ্যের আলোকে এটা সুনির্ণীত যে ‘চৈতে-নিতে-অদ্বয়’ এই ত্রয়ীসত্তা একে অপরের পরিপূরক। নিত্য চেতনায় একাকার হলে মানুষের উত্তরণ অর্থাৎ দ্বিতীয় জন্ম বা দ্বিজপ্রাপ্তি ঘটে। এটাকে সাঁইজি ‘জাত দেয় সে অজাতেরে’-বলে পদায়ন করেছেন।
‘আবার হরি বলে পড়ছে
লুটে ধুলোর মাঝে।’
চৈতে, নিতে, অদ্বয়-এর যে কোন একটি আহরিত হলে মানুষ হরিদশায় পৌঁছে যায়। তখন নমঃ নমঃ ভঙ্গি তার নিত্যসঙ্গী। নিজেকে মনে হয় মহাপ্রভুর একান্ত দাস। নিবেদন তার অস্থিমজ্জায়।

‘একটা নারকেলের মালা
তাতে জল তোলাফেলা করঙ্গ সে।’
নারকেলের মালাই হল করঙ্গ। এটি সাঁইজির একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দভেদ। মাথার খুলি, শরীরাস্থি, দেহ ইত্যাদি অর্থে শব্দটির প্রচলন আছে। করঙ্গ ও কমণ্ডলু সমার্থক। সন্ন্যাসী বা ব্রহ্মচারীর ব্যবহৃত কাঠ বা মাটি দিয়ে তৈরি জলপাত্রকে কমণ্ডলু বলে। তাহলে দেখা যাচ্ছে নারকেলের মালাÑকরঙ্গÑকমণ্ডলু একই দ্রব্যসামগ্রী। কমণ্ডলুর মধ্যে যে মুণ্ড্ আছে তার ধাতুগত অর্থ হল হর্ষ বা আমোদ। ‘নারকেলের মালাতে জল তোলাফেলার’-আগমিক অর্থ সাধক দেহের বীররসের প্রবাহ শক্তি কুলকুণ্ডলিনীর মাধ্যমে জাগিয়ে তুলে মুণ্ডু অর্থাৎ মস্তিষ্কেও সহস্রারে চালনা করে প্রসাদ লাভ করতে পারে। অন্যদিকে রসের স্খলনে অবসাদগ্রস্ত হতে পারে। তবে এ সাধনকর্মের ভেদ বুঝতে হলে চৈতে-নিতে-অদ্বয় পাগলের সঙ্গী হতে হবে। অন্যকথায় সচ্চিদানন্দ বিহার জরুরি। যাকে সাধক লালনÑ ‘পাগলের সঙ্গে যাবি/পাগল হবি বুঝবি শেষে’ অভিধায় ভূষিত করেছেন।

‘পাগলের নামটি এমন
বলিতে অধীন লালন হয় তরাসে।’
ভণিতায় যথারীতি খাস লালন আমদরবারে আত্মতত্ত্বের খবর দিতে ভয় পাচ্ছে। এই ভীত হবার কারণটি পূর্বেই আলোচিত হয়েছে।