অনলাইন জুয়ার বাংলাদেশের সেকেন্ড ম্যান মোস্তাক নাহিদ অনিককে (২২) ও তার দুই সহযোগীকে আটক করেছে পুলিশ।
গত শনিবার দুপুরে রাজধানীর মিরপুর-২ এলাকার একটি ফ্ল্যাট থেকে অনিক ও হাসিবকে আটক করে মেহেরপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এবং মুজিবনগরের দারিয়াপুর থেকে রিমেট নামের একজনকে মুজিবনগর থানা পুলিশের একটি অভিযানিক দল।
আটকরা হলেন-অনলাইন জুয়ার দূর্গ খ্যাত মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুর গ্রামের অনলাইন জুয়ার অন্যতম হোতা মাদার আলীর ছেলে মোস্তাক নাহিদ অনিক (২২), কোমরপুর গ্রামের মোস্তাকিন আলীর ছেলে মেহেদী হাসিব (২২), দারিয়াপুর গ্রামের মনিরুল ইসলামের ছেলে মুশফিকুর রহমান রিমেট (২৩)। গতকাল রবিবার বিকালে তাদের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট মুজিবনগরের আদালতে হাজির করা হলে হাসিব ও রিমেট ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী প্রদান করে। আদালতের বিজ্ঞ বিচারক তাদের জবানবন্দী গ্রহণ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
পুলিশ জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মেহেরপুর ডিবির এস আই আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে রাজধানীর মিরপুর-২ এলাকার একটি আবাসিক ভবনে অভিযান চালায় পুলিশ। সেখানে অনিকের কাছে থেকে দুটি এবং হাসিবের কাছে থেকে একটি অনলাইন জুয়ার চ্যানেলসহ হাতেনাতে তাদের গ্রেফতার করা হয়। অনিকের কাছে দুটি অনলাইন চ্যানেলের মধ্যে একটি তার নামে এবং অপরটি তার পিতা মাদারের নামে রয়েছে। প্রতিটি চ্যানেলে গড়ে প্রতিদিন আয় হয় ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা। পুলিশ আরো জানায়, মোস্তাক নাহিদ অনিক বাংলাদেশের অনলাইন জুয়া কার্যক্রমের সেকেণ্ড ম্যান হিসেবে সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে আসছিলো। অনিক ওয়ান এক বেট, মেল বেট ও লাইন বেটের সকল চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ করেন। তার কাছে থেকে অনিক নাগাদ, লিনিয়া মাদার নামের দুটি মূল চ্যানেল, এবং হাসিবের কাছে থেকে সাজিব বিকাশ নামের একটি চ্যানেল সহ ব্যবহৃত মোবাইল ও সিম উদ্ধার করেছে।
বিশ^স্ত একটি সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ তারা জানিয়েছে মেহেরপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে ২০টি চ্যানেল দেওয়া আছে। যেগুলো সিম সরবরাহ করে তার অনিকের পিতা মাদার আলী। আর এগুলো সব নিয়ন্ত্রণ করে অনিক নিজে।
সূত্রে আরো জানা গেছে, রাশিয়া থেকে বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার পুরো কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে টম (ছদ্মনাম) নামের এক ব্যক্তি। অনিক বাংলাদেশের সেকেণ্ড ম্যান হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। অনিকের অনুমোদন ছাড়া কাউকে এ চ্যানেল দেওয়া হয় না। এর জন্য অনিক পেয়ে থাকেন চ্যানেলের ৮ শতাংশ এবং টম পান ১৫ শতাংশ। এভাবে মেহেপুরের দুই শতাধিক তরুণ ও বিভিন্ন বয়সের মানুষকে তারা অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িয়েছে। যার অন্যতম দূর্গ মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুর। এখনো তাদের এসকল চ্যানেল পরিচালনা করছে সমরাজ, উজ্জল, সোহাগ খুড়া, জঙ্গল, লাল মিয়াসহ প্রায় ২০ জন এজেন্ট। এছাড়া বেশ কয়েকজন চ্যানেলের জন্য টাকা জমা দিলেও অনিকের কারণে তারা চ্যানেল পায়নি। যা থেকে অনিক ও টম কয়েক কোটি অবৈধ আয় করেছে।
স্থানীয়রা জানান, মাদার আলী সবসময় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আমাম হোসেন মিলুর ছত্রছায়ায় থেকে এ ধরণের কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে আসছে। যা বিভিন্ন সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা গেছে। আগামীতে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদ নেওয়ার চেষ্টাও করে চলেছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে মেহেরপুর কয়েকজন সাংবাদিককে মাসোহারা দিয়ে ম্যানেজ করার অভিযোগও এক অনলাইন এজেন্টের স্বীকারোক্তীকে উঠে এসেছে। সদর উপজেলার পিরোজপুরে মাদার আলীর শশুরবাড়ি এলাকায় একজনকে চার বিঘা জমি নিয়ে চারটি চারটি চ্যানেল দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
মেহেরপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সার্কেল) আজমল হোসেন বলেন, আটক আসামিদের মধ্যে অনিক অনলাইন জুয়ার কার্যক্রমে মেহেরপুরের শীর্ষ এবং দেশের সেকেণ্ড ম্যান। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় হাসিব ও রিমেট অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত থাকা কথা স্বীকার করেছে এবং তাঁরা অনিক ও তার পিতা মাদার আলীর চ্যানেল পরিচালনা করে বলে স্বীকারোক্ত দিয়েছে।
এদিকে, অনলাইন জুয়ার দূর্গে একের পর এক হানা দিয়ে ইতোমধ্যে প্রায় অনলাইন জুয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট অর্ধশতাধিকজনকে আটক করে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে। মাদারের ছেলে অনিককে আটকের মধ্যে দিয়ে বড় ধরণের একটি সফলতার মাইল ফলক স্পর্শ করলো মেহেরপুর পুলিশ বিভাগ।
পেছনের কথা:
গত বছরের ২৫ সেমেপ্টম্বর মেহেরপুর প্রতিদিনে “অনলাইন জুয়ার অন্যতম চার হোতা, মুকুল-জামান-নুরুল-মাদার” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হয়। প্রকাশিত সংবাদে মাদার আলীর তথ্য উঠে আসে। এনিয়ে মেহেরপুর প্রতিদিনের সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্টদের হুমকি ধামকিও দেয় মাদার আলীর লোকজন।
প্রকাশিত ওই সংবাদে জানা যায়, ২০২০ সালে করোনাকালীন সময়ে মূলত কয়েকজন অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়েন। তারা হলেন- কোমরপুর গ্রামের মুকুল ইসলাম, নুরুজ্জামান ওরফে জামান মাস্টার, নুরুল ইসলাম ওরফে লালন মাস্টার, মাদার আলী ওরফে মাদার মাস্টার এদের অন্যতম। তাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে অনলাইন জুয়ার দূর্গ। তারাও হয়েছেন কোটিপতি। এদের রয়েছে প্রায় দু’ডজন এজেন্ট। যারা এই চারজনের চ্যানেল নিয়ে নিয়মিত অবৈধ ট্র্যানজেকশন করে চলেছেন।
মাদার আলী ওরফে মাদার মাস্টার। তিনি কোমরপুরের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও সদর উপজেলার সাহেবপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কর্মরত। অথচ কোটি টাকা খরচ করে ২তলা বিশিষ্ট রাজপ্রাসাদ বানিয়েছেন তিনি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১০ থেকে ১২টি লাইনবেট সাইটের এজেন্ট তিনি। তিনি নিজেও এই লেনদেনের সাথে জড়িত এবং তার ছেলে অনিক ঢাকা থেকে তার এসকল লেনদেন করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ছেলে অনিক ঢাকায় বাসা ভাড়া করে অভিযাত জীবনযাপন করেন বলে জানা গেছে।
মাদার আলীকে কয়েক মাস আগে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হয়েছিলো বলে পুলিশের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে। পুলিশ সুপারের নামে স্থানীয় অনলাইন এজেন্টদের কাছে টাকা তোলার অভিযোগও ছিলো তার বিরুদ্ধে। অথচ বর্তমান পুলিশ সুপার রাফিউল আলম, পিপিএম (সেবা), অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষনা দিয়ে তাঁর বাহিনীকে মাঠে নামিয়েছেন। পুলিশের ওই টিমটি অনলাইন জুয়ার দূর্গে হানা দিয়ে একের পর এক সফল অভিযান বাস্তবায়ন করছে।