মেহেরপুরে সুখসাগর পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা
আমদানি নির্ভরশীল না থেকে নিজেরাই সুখসাগর পেঁয়াজর বীজ উৎপাদন করে লাভের মুখ দেখছেন মেহেরপুরের কৃষকরা। পেঁয়াজ বীজ বপনের মৌসুমে ভারত থেকে আমদানী নির্ভরশীল থাকতে হতো জেলার পেঁয়াজ চাষিদের।
বীজ সংকটের কারনে অনেকেইে চড়া দামে সুখসাগর জাতের পেঁয়াজ বীজ কিনতেন। প্রয়োজনের তাগিদে আমদানি নির্ভর না থেকে নিজ ক্ষেতেই পেঁয়াজ বীজ উৎপন্ন করছেন কৃষকরা । নিজেদের চাহিদা মেটানোর পরও সরবরাহ করছেন অন্যান্য চাষিদেও কাছে। এতে উৎপাদন ব্যয় অনেকটা কমে যাচ্ছে এবং অধিক মুনাফা আয় করছেন। কৃষি বিভাগ বলছেন কৃষকরা আমদানী নির্ভর না থেকেই নিজেদের উৎপাদিত বীজ দিয়ে যে সুখ সাগর পেঁয়াজ চাষ শুরু করেছেন তা কৃষিতে একটি ইতিবাচক দিক। বীজ উৎপাদনে চাষিদেরকে প্রয়োজনিয় সহায়তাও দেয়া হচ্ছে।
জেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় এবছর পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে ২৭ হাজার ৭৭৫ হেক্টর। এতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৫ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন। প্রতি বছরের নভেম্বর মাসে পেঁয়াজ বীজ বপন করা হয়ে থাকে। জানুয়ারী মাসের দিকে পেঁয়াজ বাজারজাত করা হয়। আর বীজ উৎপাদন হয় মার্চ মাসের শেষের দিকে। তবে জেলার পেঁয়াজ চাষিরা বীজ উৎপাদন করে নিজের চাহিদা পুররুনের পাশাপাশি জেলার বাইরের কৃষকদের কাছে বিক্রি করেও মোটা টাকা আয়করছেন বলে জানান, কৃষি অধিদপ্তরের উপ পরিচালক শংকর কুমার মজুমদার। এছাড়াও কৃষি গবেষণাগার থেকে বারি-৪ জাতের পেঁয়াজেরও ভাল ফলন পাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
জানাগেছে, মেহেরপুর জেলায় বিগত চার বছর যাবত সুখ সাগর পেঁয়াজের চাষ করছেন চাষিরা। অন্যান্য জাতের পেঁয়াজের তুলনায় একই খরচে দ্বিগুন পেঁয়াজ উৎপাদন করছেন তারা। পেঁয়াজের প্রচলিত জাত তাহেরপুরি,বারিফোর, নাসিকা রেড ও ফিপটি-৫০ জাতের পেঁয়াজ উৎপাদন হতো। পরে ভারত থেকে সুখ সাগর পেঁয়াজ বীজ পাওয়ায় এজাতের পেঁয়াজ আবাদে ঝুঁকে পড়েন চাষিরা। অন্যান্য জাতের পেঁয়াজের তুলনায় সুখ সাগর জাতের পেঁয়াজের ফলন পাচ্ছেন দ্বিগুন।
বপনকালীণ সময়ে বীজ সংকট দেখা দিলে বেশি মুল্য দিয়ে বীজ কিনতে হতো,এবং ভেজাল বীজে ফলন বিপর্যয়ে চাষিদের লোকসান গুনতে হতো। পরে পলাশীপাড়া সমাজ কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে সুখ সাগর জাতের পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনের কাজ শুরু করেন মুজিবনগর উপজেলার প্রায় অর্ধশত চাষি। এতে প্রতি বিঘা জমিতে প্রায় ১০০ কেজি বীজ উৎপাদন হয়। নিজেদের চাহিদা পুরুনের পাশাপাশি বীজ বিক্রি করেই লক্ষাধিক টাকা আয় করে অনেকেই সাবলম্বি হচ্ছেন। প্রতি কেজি বীজ বিক্রি হয় ২ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। শুধু বীজই নয়,ফুল থেকে বীজ সংগ্রহ করার পর গাছ থেকে পেঁয়াজ পাওয়া যায় বিঘা প্রতি ৩৫ থেকে ৪০মন। একই সাথে বীজ ও পেঁয়াজ দুটোই পাচ্ছেন চাষিরা। পেঁয়াজ চাষিদের পাশে দাঁড়িয়েছেন পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন অর্থায়নে পরিচালিত সংস্থা পলাশীপাড়া সমাজ কল্যাণ সমিতি। জেলার মুজিবনগর উপজেলায় ১০ থেকে ১৫টি প্রদর্শনী প্লটের মাধ্যমে প্রায় অর্ধশত কৃষককে আর্থিক সহায়তা ও বীজ উৎপাদনে নানা মুখি পরামর্শ দিচ্ছেন।
মুজিবনগর বিদ্যাধরপুর গ্রামের কৃষক ইদুল ইসলাম জানান, তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ পেঁয়াজের আবাদ করেন। সুখ সাগর পেঁয়াজের জাত পাওয়ার পর চার বছর থেকে এজাতের পেঁয়াজ চাষ করছেন। প্রতি বিঘা জমিতে তিনি ৫৫ থেকে ৬০মন পেঁয়াজ পেয়েছেন। বীজ বপনের সময় বীজের সংকট ও মুল্যবৃদ্ধির কারনে চাহিদা অনুযায়ী আবাদ করতে পারতেননা। পরে পলাশপাড়া সমাজ কল্যাণ সমিরি কৃষি অফিসারের পরামর্শ ও আর্থিক সহায়তা পেয়ে এক বিঘা জমিতে সুখ সাগর পেঁয়াজ আবাদ করেন। সেখান থেকে প্রায় ৮০ কেজি বীজ উৎপন্ন হয় এবং একই গাছ থেকে প্রায় ৪০ মন পেঁয়াজ বিক্রি করেন। পেঁয়াজ ও বীজ বিক্রি করে এক বছরে আয় করেন তিন লক্ষাধিক টাকা। তার পর থেকে তিনি সুখ সাগর জাতের পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন করছেন। তার দেখাদেখি অনেকেই বীজ উৎপাদনে উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন।
দারিয়াপুর গ্রামের কৃষক শাহাবুদ্দিন জানান, আমাদের মুজিবনগর উপজেলায় শতভাগ চাষিরা সুখ সাগর জাতের পেঁয়াজের আবাদ করেন। ভারত থেকে আমদানি নির্ভর না থেকে এখন নিজেরাই বীজ উৎপাদন করছেন। এতে বীজ কেনার টাকাও লাগছেনা আবার বীজ নিয়ে প্রতারিত হতে হচ্ছেনা তাদের। উপরন্ত একই জমি থেকে বীজ ও পেঁয়াজ দুটোই পাচ্ছেন। আবহাওয়া ভাল থাকলে বিঘা প্রতি জমিতে তিন থেকে চার লাখ টাকা আয় হয় বলেও জানান তিনি।
খানপুর গ্রামের কৃষক ইউনুস আলী জানান, আমাদের উৎপাদিত সুখ সাগর জাতের পেঁয়াজ জেলার চাহিদা পুরুনের পাশাপাশি বাইরের জেলাতে বিক্রি হচ্ছে। পেয়াজ উৎপাদনের পাশাপাশি বীজ উৎপাদনে অনেক বেশি লাভ। কারন একটি পেঁয়াজ গাছের ফুল থেকে বীজ পাচ্ছি এবং শিকড় থেকে পেঁয়াজ পাচ্ছি। আমি প্রতি বছর সুখ সাগর জাতের বীজ কিনতাম বাজার থেকে। এতে অনেক টাকা বেশি খরচ হয়ে যেত। এখন আমি নিজেই বীজ উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছি। এতে সার্বিক সহায়তা করছেন মেহেরপুরের পলাশীপাড়া সমাজ কল্যাণ সমিতি। তাদের নিজস্ব কৃষি অফিসার আমাদের জমিতে এতে পরামর্শ দিয়ে যায়। কয়েক বছর ধরে সুখ সাগর জাতের বীজ উৎপাদন করে অনেক কৃষককেরই ভাগ্য বদলে ভাসছেন সুখের সাগরে।
পিএসকেএস এর কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মোস্তফা রাব্বি জানান, মেহেরপুর জেলার মাটি ও আবহাওয়া সব ফসল ফলানোর জন্য খুবই উপযোগী। বিশেষ করে পেঁয়াজ চাষের জন্য যে আবহাওয়া ও মাটি তা সুখ সাগর পেঁয়াজের ব্যপক ফলন পাওয়া সম্ভব। শুধুমাত্র মুজিবনগর উপজেলাতে রয়েছে শতাধিত পেঁয়াজ চাষি। যারা শুধুমাত্র সুখ সাগর পেঁয়াজের আবাদ করেন। এতে প্রতিবছর এক বিঘা জমির জন্য বীজ খরচ লাগতো প্রায় ১০ হাজার টাকা। পরে আমাদের পরামর্শ অনুযায়ী কৃষকরা এখন বীজ উৎপাদন করে ৩/৪ লাখ টাকা আয় করছেন। সোনার বাংলায় সোনা ফলানো সম্বব বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
পলাশীপাড়া সমাজ কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মুহঃ মোশাররফ হোসেন জানান, সমন্বিত কৃষি ইউনিটের কৃষি খাতের আয়তায় পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন ও পেঁয়াজ চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে মুজিবনগর উপজেলায় ১৫টি প্রদর্শনি দেয়া হয়েছে। চার বছর যাবৎ প্রদর্শনির মাধ্যমে প্রায় অর্ধশত কৃষককে আর্থিক সহায়তা ও হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে বীজ উৎপাদনে সাবলম্বি করে তোলা হয়েছে। এখানকার একজন কৃষক তিন মাসের ব্যবধানে শুধুমাত্র বীজ উৎপাদন করে আয় করছেন ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা। আমাদের সাথে পরামর্শ নিয়ে অনেকেইে বীজ উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছেন বলেও জানান তিনি।