গ্রামীণ জনপদ মেহেরপুর সদর উপজেলার যুগিন্দা গ্রাম। এই গ্রামের যুগিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২৫ বছর ধরে প্রধান শিক্ষক নেই। একজন সহকারি শিক্ষককে প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্ব পালন করছেন। এমন বিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, মেহেরপুর জেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৩০৮টি। প্রধান শিক্ষকের মঞ্জুরিকৃত পদ ৩০৭ টি। কর্মরত আছে ২২১ জন। মেহেরপুর সদরে ১০৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৫০টিতে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে।
গাংনী উপজেলায় ১৬১ টির মধ্যে ২১ টিতে, মুজিবনগরে ৩৮ টির মধ্যে ১৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। কোনো কোনো বিদ্যালয়ে দুইযুগের অধিক সময় ধরে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য। দীর্ঘবছর এসব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদ পুরণ না করায় প্রশাসনিক কর্মকান্ড পরিচালনায় ব্যাহত হচ্ছে। সহকারি শিক্ষক থাকার কথা ১৭৫৪ জন। আছে ১৬৩৩ জন। অর্থাৎ ১২১ জন সহকারির শিক্ষদের পদও শূন্য রয়েছে।
সদর উপজেলার যুগিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদে চলতি দায়িত্বে আছেন ওই স্কুলের সহকারি শিক্ষক আবদুল কুদ্দুস। তিনি বলেন, ৬জন শিক্ষকের পদ থাকলেও ৩ জন আছি। এরমধ্যে আমাকে প্রশাসনিক দায়িত্বপালন করতে হয় আবার ক্লাসও নিতে হয়। প্রশাসনিক কাজে বা বিভিন্ন সভায় যোগদান করতে হয় প্রায় প্রতিদিন। ফলে আমি ক্লাস নিতে পারিনা। এর ফলে বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পাঠদান ব্যাহত হয়। সিংহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১১ বছর ধরে প্রধান শিক্ষকের পদ শূণ্য।
হাসনাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মো. আলফাজ হোসেন প্রধান শিক্ষকের দায়ীত্বে আছেন ২০১৮ সাল থেকে। তিনি জানান, ৭ জন শিক্ষকের পদ থাকলেও আছেন ৪ জন। তিনি সরকারের বিভিন্ন কাজের দায়ীত্ব পালনসহ বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজের চাপে ক্লাস নিতে পারেন না। বিদ্যালয়ে প্রাক প্রাথমিক ক্লাস সংযুক্ত হওয়াতে ৩ জন শিক্ষক একসাথে ৩টি ক্লাস নিলে অপর তিনটি ক্লাসের শিক্ষার্থীরা ক্লাসের বাইরে খেলা ধুলায় মত্ত থাকে। শিক্ষকরা একটানা ক্লাস নিতে হাঁপিয়ে ওঠেন। অনেকসময় কোন ক্লাস নেয়া সম্ভব হয়না শিক্ষকদের।
সদর উপজেলার বর্শিবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৫ বছর প্রধান শিক্ষক পদে শিক্ষক নাই। বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক তাহমিনা সুলতানা চলতি দায়িত্ব পালন করছেন। বিদ্যালয়ে ৬ জন শিক্ষকের স্থলে আছেন ৪ জন। একজন পিটিআই-এ। তিনি প্রশাসনিক কাজে ব্যাস্ত থাকেন। ২ জন শিক্ষককে ৬টি শ্রেণির ক্লাস নিতে হয় পালা করে। একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শহর এলাকায় বা শহরতলীর স্কুলগুলোতে অবসরের কারণে পদ শূন্য হলে অন্য এলাকা থেকে বদলি হয়ে পদ পূরণ হয়। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলগুলোতে অবসরে যাওয়ার পর পদ শূন্যই থেকে যাচ্ছে। তাই প্রতিবছরই বাড়ছে প্রধান শিক্ষকের পদশূন্য স্কুলের সংখ্যা। বর্শিবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী রেবেকা সুলতানা জানান শিক্ষক সংকটে কোনদিন চারটি, কোন দিন ৩টি ক্লাস হয়। শিক্ষক সংকটে তারা শিক্ষা বঞ্চিত হচ্ছেন।
সিংহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র আকরাম হোসেন অভিযোগ করেন, শিক্ষক সংকটে ক্লাসে বাড়ির জন্য পড়া দেয়া হয়না। বছর শেষে সিলেবাস শেষ না হবার কারণে তারা বার্ষিক পরীক্ষায় অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর লিখতে ব্যর্থ হয়। এই শিক্ষার্থী বলেন- এর চেয়ে সপ্তাহের তিনদিন ওয়ান থেকে ২য় শ্রেণি এবং আর তিনদিন ৩য় থেকে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস নেয়া হলে প্রতি শিক্ষার্থী উপকৃত হবেন। পিছিয়ে পড়ার হার কমবে।
প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির একজন নেতা জানান, জেলা শহর ও শহরের উপকন্ঠের গ্রামগুলোর একটি বিদ্যালয়েও প্রধান শিক্ষক ও সহকারি শিক্ষকপদ শূন্য নাই। রাজনৈতিক ও প্রশাসনের সহায়তায় এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জেলা শহরের নাগরিক শিক্ষকরা প্রধান শিক্ষক পদ পেয়ে যান। গ্রামীন কোন শিক্ষক জেলা শহরে প্রধান শিক্ষক থাকতে পারেনা।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রধান শিক্ষকের পদগুলো ৬৫ ভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে এবং ৩৫ ভাগ সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণের বিধান রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সরাসরি প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ করা হচ্ছে না। আবার সহকারি শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি দেওয়াও বন্ধ রয়েছে। তাই প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদ পূরণ করা যাচ্ছে না।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. রুহুল আমীন বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সহকারি শিক্ষকদের পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু করছে। পদোন্নতি হলে শূন্য পদগুলো পূরণ করা যাবে। শহরের স্কুলগুলোতে অবসরের কারণে পদ শূন্য হলে পূরণ হয়। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকায় অবসরে যাওয়ার পর শূন্যই থেকে যাচ্ছে।
মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল্লøাহ আল আমিন বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়েই শিশুদের শিক্ষার ভিত তৈরি হয়। তাই সেখানে পাঠদান সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য শিক্ষক শূন্যপদ এবং প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদ পূরণের জন্য সরকারের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।