দুই ভাইয়ের মধ্যে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে আদালতে করা মামলা পাঠিয়ে দেওয়া হয় ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম আদালতে। সেখানে উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে মামলাটির নিষ্পত্তি ঘটে। এতো সহজে মামলার নিষ্পত্তি হবে ভাবতেও পারেনি ওই মামলার বাদী।
গ্রাম আদালতের মাধ্যমে উপকৃত হওয়ার কথা বলছিলেন ঝিনাইদহের সদর উপজেলার মধুপুর গ্রামের লোকমান মণ্ডল। গ্রাম আদালত সক্রিয় থাকলে অনেক মামলা লোকমান মণ্ডলের মামলার মতো নিষ্পত্তি হতো।
তবে জেলার ৬৭টি ইউনিয়নে দৈনন্দিন কার্যাবলীর ন্যায় গ্রাম আদালত পরিচালনা করার কথা থাকলেও তা যথাযথ ভাবে করা হয় না। মূলত মানুষের অসেচতনতা, এজলাস না থাকা, জনপ্রতিনিধিদের অনিহাসহ নানা কারণে গ্রাম আদালতের সুফল সেভাবে পাচ্ছেনা গ্রামের সাধারণ মানুষ।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ গ্রাম আদালত থেকে কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছে না তা গত এক বছরে জেলার ৬৭টি ইউনিয়নের চিত্রই বলে দেয়।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৭টি ইউনিয়নে মাত্র ৯২৬ টি মামলা গ্রহণ করে গ্রাম আদালত। এর মধ্যে ৮০৩টি মামলার সমাধান করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা গ্রহণ করে মহেশপুর উপজেলার শ্যামকুড় ইউনিয়ন পরিষদ। এ ইউনিয়নে গ্রাম আদালতে গেল বছর সর্বোচ্চ ৪৮টি মামলা গ্রহণ করে। এর মধ্যে ৪৬টি সমাধান হয়, ২টি মামলা এখনো চলমান রয়েছে।
গত বছর জেলার ৬টি থানায় মোট ২হাজার ২৮৯টি মামলা হয়। নানাবিধ কার্যক্রমের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানো আর জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসার ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগ মাঠ পর্যায়ে সেভাবে কার্যকর হচ্ছে না গ্রাম আদালতে। জেলার অন্তত ২৩টি ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালত পরিচালনার জন্য এজলাস নেই। এজলাস না থাকার কারণে এইসব ইউনিয়ন পরিষদে আদালত কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না।
ফলে গ্রাম আদালতের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ওই এলাকার জনগণ। আদালত থেকে পাঠানো মামলা গ্রাম আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তির নজির খুব বেশি না হলেও অনেক মামলা এখন গ্রাম আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হচ্ছে।
জানা যায়, গ্রামের সকল জনগনকে কম সময়ে নামমাত্র খরচে বিচারিক সেবা প্রদান করার লক্ষে গ্রাম আদালত অধ্যাদেশ জারি হয় ১৯৭৬ সালে। তা আইনে রুপ নেই ২০০৬ সালে। এরপর থেকে ইউএনডিপি এবং ইউরোপিয় ইউনিয়নের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় প্রকল্প আকারে তা মাঠ পর্যায়ে কার্যকর হয়। সর্বশেষ সংশোধনী ২০২৪ অনুযায়ী গ্রাম আদালতের আর্থিক ক্ষমতা ৭৫ হাজার টাকা থেকে পরিবর্তন করে ৩ লাখ টাকা করাসহ তফসিলের দ্বিতীয় অংশে দেওয়ানী বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে।
এদিকে গেল বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জেলার অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা আত্মগোপনে চলে যায়। ওই সকল ইউনিয়নে প্রশাসক নিয়োগ দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। তারপর থেকে ওই সকল ইউনিয়নে গ্রাম আদালতে মামলার সংখ্যা কমতে শুরু করে। তখন থেকে আরো বেশি গতিহীন হয়ে পড়ে গ্রাম আদালতের কার্যক্রম।
সুশাসনের জন্য নাগিরক (সুজন) এর জেলা কমিটির সভাপতি ও মানবাধিকারকর্মী আমিনুর রহমান বলেন,‘আস্থাহীনতার কারণে অনেকে গ্রাম আদালতে যেতে চাই না। এছাড়াও নানা ধরণের জটিলতার কারণে মানুষ থানা পুলিশের দ্বারস্থ হচ্ছে বেশি।’
ঝিনাইদহের অতিরিক্তি পুলিশ সুপার ইমরান জাকারিয়া বলেন, ‘পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা থাকায় তাঁরা থানায় মামলা করেন বেশি। তারপরেও আমাদের পক্ষ থেকে অনেক বাদীকে মামলার জন্য গ্রাম আদালতে পাঠানো হয়।’
এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার বিভাগ ঝিনাইদহের উপ-পরিচালক রথীন্দ্রনাথ রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গ্রাম আদালতকে শক্তিশালী করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও প্রশাসকদের নানা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যে ইউনিয়নে গ্রাম আদালতের জন্য এজলাস নেই সেখানে আমরা এজলাস তৈরি করে দেবো। বিভিন্ন ধরণের প্রচারণার মাধ্যমে গ্রাম আদালতের কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করা হচ্ছে।’