দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চেলের জনপদ ঝিনাইদহ এক সময় চরমপন্থিদের নিরাপদ ঘাঁটি ছিল। দীর্ঘ দুই দশক পর এ অঞ্চলে চরমপন্থিরা আবারো তৎপরতা বাড়িয়েছে।
তাঁরা নতুন করে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করছে। হত্যাকারী পাশাপাশি গুলি ও বোমা ফাটিয়ে তাঁদের অবস্থান জানান দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জেলার পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ছাড়াও বিএনপি-জামায়াত নেতাদের সঙ্গে যোগযোগ রাখছে চরমপন্থি দলের সদস্যরা। ঠিকাদারি কাজ, হাট-ঘাট, বিল-বাঁওড় দখলে নিতে এখন তাঁরা মরিয়া। চরমপন্থিদের সঙ্গে সমঝোতা না করে দরপত্র, হাট-ঘাট ও বড় জলমহাল ইজারা নেওয়া ঠিকাদারদের জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও চরমপন্থিদের চোখ এখন সরকারি বিভিন্ন কাজে। সম্প্রতি পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি কাজ তাঁদের পছন্দের ঠিকাদার না পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বরতদের ভয়ভীতি দেখিয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছে।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ শাসনামলে কথিত বন্দুকযুদ্ধে টিকতে না পেরে বেশির ভাগ চরমপন্থিরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। যাঁরা দেশে ছিলেন, তাঁরাও আত্মগোপনে ছিলেন। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থানে চরমপন্থি সংগঠনগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গত বছরের ৫ আগস্টের পর প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে চরমপন্থিরা। পালিয়ে থাকা অনেক চরমপন্থি এখন অনেকটা প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করছেন।
গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, এ জেলায় চরমপন্থিদের তৎপরতা হঠাৎ করে বেড়েছে। বিশেষ করে ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া ও রাজবাড়ি জেলার সীমান্ত এলাকায় তাঁরা শক্ত অবস্থান করে তুলেছেন। খুব সহজেই তাঁরা এ জেলা থেকে অন্য জেলায় ঢুকে অপরাধ ঘটিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক আগে থেকেই এ এলাকায় জাসদ গণবাহিনীর প্রভাব ছিল। বর্তমানে নিষিদ্ধঘোষিত এ সংগঠনটি কালু, ফারুকসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতা আত্মগোপনে থেকে পরিচালনা করছেন। এখন তাঁদের ৭০ থেকে ৮০ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে। তাঁদের কাছে রয়েছে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র।
জানা গেছে, জেলার হরিণাকুণ্ডু ও শৈলকুপায় কালুর অনেক সদস্য রয়েছে। জাসদ গণবাহিনীর নামে তাঁরা নতুন করে সংগঠন পরিচালনা করছে। গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে শৈলকুপার রামচন্দ্রপুর এলাকায় তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই জায়গায় একই ভাবে দেড় দশকে হত্যা করা হয় আরো আটজনকে। চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া সীমানায় অবস্থিত এলাকাটি। সবশেষ নিহত তিনজনের মধ্যে ছিল বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হানিফ আলী ওরফে হানেফ। হানেফের বিরুদ্ধে ডাকাতি, হাট-ঘাট, সরকারি টেন্ডার নিয়ন্ত্রণসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ ছিল। সম্প্রতি তিনি আবার নতুন দল গোছানোর কাজ করছিল।
হানেফের বাড়ি ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলায়। এ উপজেলাতে অনেক বিল-বাঁওড় আছে। এসব দখলে নিতে বেশ কয়েকটি দল ৫ আগস্টের পর থেকে তৎপর ছিল। সেই সাথে বাংলা নতুন বছরে হাট-বাজারগুলো ইজারা দেওয়া হবে। এসব হাট-বাজার ও বিল-বাঁওড়ের দখল নিতে কাজ করছে চরমপন্থিরা। বিএনপির অনেক নেতাও এসব নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য এখন চরমপন্থী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
সূত্র জানায়, এসব চরমপন্থি সংগঠনগুলো এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছেন। গত ২০ বছর ধরে কোণঠাসা এসব সংগঠন আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছে। তাই ঠিকাদারি কাজ, হাট-বাজার ও বিল-বাঁওড়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করছে। অনেকে ভয়ে সরকারি কাজের দরপত্র কিনতে ভয় পাচ্ছেন। ঠিকাদারদের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। হঠাৎ করে চরমপন্থিদের উত্থানের হওয়ার পেছনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বলতা রয়েছে।
এ ব্যাপারে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান জাকারিয়া বলেন, ‘ত্রিপল মার্ডারের ঘটনায় ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যে সকল চরমপন্থিরা আত্মগোপনে রয়েছে তাঁদের সম্পর্কে আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি।’
তিনি আরো বলেন,‘চরমপন্থি নিয়ে জনমনে কিছুটা শংকা তৈরি হয়েছে। পুলিশ এ নিয়ে কাজ করছে। খুব দ্রুতই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’