আরবি নামটি শুনলে প্রথমেই আমাদের মনে আসে এটি পবিত্র কুরআনের ভাষা, যা ইসলাম ধর্মের সাথে সম্পর্কিত। সারা বিশ্বের মুসলমানরা প্রতিদিন তাদের প্রার্থনায় আরবি ভাষায় কুরআনের কিছু অংশ পাঠ করে থাকেন।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আরবি ভাষা মুসলমানদের কাছে একটি অতি পবিত্র ভাষা হিসেবে গণ্য।সর্বশেষ নবী ও রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মাতৃভাষা ছিল আরবি, আর আল্লাহ জিব্রাইলের (আ.) মাধ্যমে তার উপর এই ভাষায় ওহী নাযিল করতেন।
ঐতিহাসিকভাবে মুসলিমদের বিশ্বাসমতে, আরবিই সেই ভাষা যার মাধ্যমে জান্নাত বা স্বর্গে মানুষ একে অন্যের সাথে বা ফেরেশতাদের সাথে যোগাযোগ করবে।
আরবি হলো বিশ্বের বহুল ব্যবহৃত কথ্য ভাষাগুলোর মধ্যে একটি। ব্যবহারের দিক থেকে এটি পঞ্চম স্থানে, যা আজকের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা জুড়ে একটি সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এমনকি এর ব্যবহার বিভিন্ন উপভাষাতেও রয়েছে। উপরেই বলা হয়েছে, আরবি ভাষা মুসলিমদেরর কাছে একটি ধর্মীয় ভাষা হিসেবেও কাজ করে।
কারণ, আরবি হলো পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআনের ভাষা, এবং এটি ইসলাম ধর্মের সাথে সরাসরি যুক্ত। এভাবে এই ভাষা ধর্মীয় তাৎপর্যের সাথে সাথে ঐশ্বরিক উদ্ঘাটনের সাথেও যুক্ত, যা ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে।
জনপ্রিয় এই আরবি ভাষা কোথা থেকে এসেছে? এর জন্ম কীভাবে হলো? আর, কীভাবেই বা এর পরিবর্তন ঘটেছে? প্রাচীন এই ভাষা সম্পর্কে জানাতেই আজকের এই লেখা। পাঠকবৃন্দ, তো চলুন আরবি ভাষা সম্পর্কে জানতে ঘুরে আসি ইতিহাসের পাতা থেকে।
আজকের বিষয় হলো আরবি ভাষা, যাকে আরবিতে ‘আল আরাবিয়া’ বলা হয়। প্রায় ২৯৩ মিলিয়ন স্থানীয় ভাষা ব্যবহারকারী, এবং বিশ্বব্যাপী মোট ৪২২ মিলিয়ন মানুষ আরবি ভাষায় কথা বলেন। বিশ্বের ২৬টি দেশের অফিসিয়াল ভাষা আরবি। এটি জাতিসংঘের ছয়টি অফিসিয়াল ভাষার মধ্যে একটি।
কুরআনের ভাষা হিসেবে এটি সারা বিশ্বের ১.৭ বিলিয়ন মুসলমানের ধর্মীয় ভাষাও। যদিও তাদের অধিকাংশই আরবি ভাষায় মনের ভাব আদান-প্রদান পারে না, কিন্তু প্রার্থনা এবং ধর্মীয় অধ্যয়নের জন্য আরবি ভাষা সম্পর্কে কিছু জ্ঞান তাদের অধিকাংশেরই রয়েছে। এই ভাষার রয়েছে বিভিন্ন বৈচিত্র্য।
প্রধান বৈচিত্র্যগুলোর মধ্যে একটি হলো কুরআনের শাস্ত্রীয় আরবি। অনেক পণ্ডিত একে আরবি ভাষার সবচেয়ে নিখুঁত রূপ বলে মনে করেন, এবং কেউ কেউ বলেন যে, এটি একমাত্র সত্যিকারের আরবি, কারণ এটাই ছিল সেই ভাষা যে ভাষায় সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ শেষ নবী ও রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কাছে কুরআন অবতীর্ণ করেন। তারপর রয়েছে মডার্ন স্ট্যান্ডার্ড আরবি, যা আজ অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত আরবি ভাষার একটি রূপ।
এটি সাহিত্যে ব্যবহৃত আরবির আধুনিক রূপ, যা কুরআনের ধ্রুপদী আরবির উপর ভিত্তি করে তৈরি। এটা ঠিক শাস্ত্রীয় আরবির মতো নয়, কিন্তু উভয়কেই আরবরা ‘আল-ফুশা’ বলে উল্লেখ করেছে, যার অর্থ ‘বাকপটু বক্তৃতা’।
সেমিটিক ভাষার উপগোষ্ঠীর সর্বোত্তম শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্কে ভাষাবিদদের মধ্যে এখনও ভিন্নমত দেখা যায়। সেমিটিক ভাষাগুলো প্রোটো-সেমিটিক এবং মূল বা সেন্ট্রাল সেমিটিক ভাষার উদ্ভবের মধ্যে, বিশেষত ব্যাকরণে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে বলে তারা মনে করেন।
ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়- আরবি ভাষা সেমিটিক ভাষা পরিবার থেকে এসেছে, এবং এটি ঐ পরিবারের অন্যান্য সেমিটিক ভাষার সাথে বিকশিত হয়েছে। সেই দিক থেকে বিশেষ করে আরবি ভাষা মূলত কোনো নির্দিষ্ট ভাষা কোথা থেকে এসেছে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বেশ কঠিন, কারণ ভাষা সর্বদা পরিবর্তিত এবং বিকশিত হয়।
আরবি এবং অন্যান্য সেমিটিক ভাষা, যেমন- হিব্রু, আরামাইক এবং ফিনিশিয় সব একই প্রোটো-সেমিটিক ভাষা থেকে বিকশিত হয়েছে। আরবি ভাষা মূল বা সেন্ট্রাল সেমিটিক শাখার অন্তর্গত একটি ভাষা, যেখানে সেন্ট্রাল সেমিটিকের আরেকটি শাখা থেকে হিব্রু, আরামাইক এবং ফিনিশিয় ভাষাগুলো এসেছে। সেমিটিয় গোত্রের ভাষাসমূহের অন্তর্গত জীবিত সেমিটিক ভাষাগুলো হলো আধুনিক হিব্রু ভাষা (ইসরায়েলের ভাষা), আমহারীয় (ইথিওপিয়ার ভাষা), এবং ইথিওপিয়ায় প্রচলিত অন্যান্য ভাষা। মৃত সেমিটিয় ভাষাগুলোর মধ্যে আছে প্রাচীন হিব্রু, আক্কাদীয় (ব্যাবিলনীয় ও আসিরীয়), সিরীয় ও ইথিওপীয় ভাষা।
বহু আরব বিশেষজ্ঞ আরবি ভাষার উৎস খোঁজার চেষ্টা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ইবনে আল ক্বালবি তার লিখিত কিতাব আল-আসাম বইয়ে লিখেছেন, ব্যাবিলন থেকে আসা আমালিয়ার জায়ান্টরাই প্রথম আরবিতে কথা বলতেন, এবং তাদের সাথে এটি আরব ভূখণ্ডে ছড়িয়ে দেন।
এছাড়া একটি জনপ্রিয় ও ব্যাপক গৃহীত তত্ত্ব ও ধারণা হলো- আরবি ভাষা দক্ষিণ আরব ও আধুনিক ইয়েমেনের আশেপাশে উদ্ভূত হয়েছে, এবং পরে এটি উত্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। পাঠক, চলুন দেখে আসি ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে পাওয়া আফ্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবার থেকে আরবি ভাষা কীভাবে এলো তার একটি সম্ভাব্য প্রবাহ চিত্র।
প্রাচীনকালে আরবের অধিবাসীরা বিভিন্ন সেমিটিক ভাষায় কথা বলত। দক্ষিণ-পশ্চিমে, প্রাচীন দক্ষিণ আরব পরিবারের (যেমন- দক্ষিণ থামুডিক) অন্তর্গত এবং এর বাইরের বিভিন্ন সেন্ট্রাল সেমিটিক ভাষার ব্যবহার ছিল।
বিশ্বাস করা হয়, আধুনিক দক্ষিণ আরবীয় ভাষার (নন-সেন্ট্রাল সেমিটিক ভাষা) পূর্বপুরুষরাও এই সময়ে দক্ষিণ আরবের ভাষায় কথা বলত। উত্তরে, উত্তর হিজাজের মরূদ্যানে, দাদানিটিক এবং তায়মানিটিক শিলালিপির ভাষাগুলোর কিছুটা প্রতিপত্তি ছিল। নজদ এবং পশ্চিম আরবের কিছু অংশে ‘থামুডিক সি’ নামে শিলালিপিতে প্রাপ্ত একটি ভাষা পণ্ডিতরা খুঁজে পেয়েছেন।
পূর্ব আরবে প্রাপ্ত একটি শিলালিপি থেকে হাসাইটিক নামে পরিচিত একটি ভাষার প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া, আরবের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে, থামুডিক বি, থামুডিক ডি, সাফাইটিক এবং হিসমাইক নামে পণ্ডিতরা চারটি বিভিন্ন ভাষা পেয়েছেন। ভাষাপণ্ডিতদের প্রাপ্ত তত্ত্বের ভিত্তিতে বলা যেতে পারে যে, সাফাইটিক এবং হিসমাইক প্রকৃতপক্ষে আরবি ভাষার প্রাথমিক রূপ এবং সেগুলোকে পুরনো আরবি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।
আরবি সম্পর্কিত অসংখ্য সেমিটিক ভাষা ত্রয়োদশ এবং দশম শতাব্দীর মধ্যে আরবে ব্যবহার হতো। কিন্তু এগুলোর এমন কোনো বৈশিষ্ট্য নেই যা তাদের আরবি ভাষা হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়। ‘আরব’ হিসেবে উল্লেখ করা লোকদের প্রাচীনতম প্রমাণ খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর একটি অ্যাসিরিয়ান শিলালিপিতে পাওয়া যায়। কিন্তু, এতে শুধু আরবদের কথা বলা হয়েছে। এটি তাদের ভাষার কোনো প্রমাণ দেয় না।
খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টাব্দ ৪র্থ শতাব্দীর মাঝে এমন কিছু শিলালিপি পাওয়া গেছে যা আরবি ভাষার প্রাথমিক রূপের প্রমাণ দেয়। এই শিলালিপিগুলোর মধ্যে কিছু আরবি ভাষার প্রাথমিক রূপ এবং অন্যগুলো আরামাইক ভাষায় লেখা, তবে এতে আরবির কিছু প্রভাব দেখা যায়। এই শিলালিপিগুলোতে বেশিরভাগই সাধারণ নাম, তাই এটাও আমাদের আরবি ভাষা সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য দেয় না।
আরবি ভাষার সম্ভাব্য প্রাচীনতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মনে করা হয় জর্ডানের বায়ির এলাকায় প্রাপ্ত খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের প্রথমদিকের একটি শিলালিপিকে। অবশ্য এর ভাষা আরবি না অন্য কোনো সেমিটিক ভাষা তা সম্পূর্ণ পরিষ্কার নয়। তবে, প্রথম সহস্রাব্দের দ্বিতীয়ার্ধের দিককার বহু শিলালিপি পাওয়া গেছে সিরিয়া, জর্ডান ও উত্তর পশ্চিম সৌদি আরবে। মূলত এই লিপিগুলোর উপর ভিত্তি করে এগুলোকে একটি উত্তরের শাখা (সাফাইটিক) ও একটি দক্ষিণের শাখায় (হিসমাইক) ভাগ করা হয়। এগুলোতে ব্যবহৃত লিপি পরবর্তীকালের আরবি লিপি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও তৎকালীন দক্ষিণ আরবে প্রচলিত লিপি থেকে উৎপন্ন।
কিন্তু লিপি আলাদা হলেও এই লেখাগুলোর ভাষা বিবেচনা করে এগুলোকে আরবি ভাষারই প্রাচীন রূপ বলে নির্ণয় করেছেন ভাষাবিদরা। ঠিক একই সময়ে আরব উপদ্বীপের অন্যান্য জায়গায় অন্যান্য লিপিতেও সেমিটিক ভাষায় আরও লেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু সেগুলোর কোনোটাই পরবর্তী কালের আরবি ভাষার পূর্বসূরী ছিল না বলে মনে করেন পণ্ডিতরা। সেই হিসেবে দেখলে উত্তর-পশ্চিম আরব ও দক্ষিণ শাম (লেভান্ট বা Levant)-এ আরবি ভাষার প্রথম সহস্রাব্দের পূর্বপুরুষের দেখা পাওয়া যাচ্ছে।
আরব ভূমিতে প্রধান রাজ্যগুলোর একটি ছিল নাবাতিয়ান রাজ্য। তাদের রাজধানী ছিল জর্ডানের পেট্রা নগরীতে, যা উত্তর আরবে অবস্থিত। তবে মজার ব্যাপার হলো, নাবাতিয়ান মানুষরা তখন আরবি ভাষা লিখত না। তাদের বাণিজ্যব্যবস্থা ছিল অন্যান্য দূরের রাজ্যগুলোতে।
তাই যোগাযোগের জন্য ব্যবহার হতো সেই সময়ের মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান ভাষা আরামাইক। তবে স্থানীয় অধিবাসীরা মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই প্রাচীন আরবি ভাষায় কথা বলতেন। খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে নাবাতিয়ানদের মধ্যে প্রথম আরামাইক লিপির একটা টানা হাতের রূপভেদে আরবি ভাষা লিখতে দেখা গেল, যা আইন আভদাত (Ein Avdat) শিলালিপিতে দেখা যায়।
এটিই প্রাচীনতম শিলালিপি, যেটি নিঃসন্দেহে আরবি ভাষার, যার সময় প্রায় ১২৫ খ্রিষ্টাব্দ। পাঠক, আপনারা নিচে যে ছবিটি দেখতে পারছেন, সেটিই আইন আভদাত শিলালিপি, যা বর্তমান ইসরাইলের দক্ষিণে নেগেভ মরুভূমির একটি গিরিপথ ‘আইন আভদাত’-এ পাওয়া গেছে। এটি একটি আরামাইক শিলালিপি, তবে এতে আরবি ভাষার তিনটি লাইন রয়েছে।
সংকলনেঃ এম.এ.এস ইমন
প্রকাশক, দৈনিক ‘মেহেরপুর প্রতিদিন’