বর্তমান সময়ে ঝুঁকির কেন্দ্রে অবস্থান করছে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম। জুলিয়ান এসাঞ্জ থেকে জামাল খাশোগি, মিয়ানমারের সাংবাদিক ওয়া লোন এবং কিয়াও সোউ থেকে সাগর- রুনি। যারা নিজেদেরকে মৃত্যু ঝুঁকির মধ্যে রেখে অনন্য সাংবাদিকতার নজির সৃষ্টি করেছিলেন। বর্তমান যুদ্ধবিধ্বস্ত প্যালেস্টাইনে দায়িত্বশীল সাংবাদিক নিধনের ভয়াবহতা বিশ্বকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে।
গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের এই মাধ্যমটি নিয়ে বিস্তর সমালোচনা রয়েছে। পরতে পরতে যেমন রয়েছে হলুদ সাংবাদিকতার ঘেরাটোপ, কর্পোরেট আগ্রাসনে বিপন্ন হয়ে পড়ার উদাহরণ। তেমনই রয়েছে ইতিবাচক দৃষ্টান্তও। দেশি -বিদেশি সংবাদযোদ্ধাদের নির্ভীক দায়িত্বশীলতার কারণে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বৈশ্বিক সমর্থন সহজ হয়েছিল। আবার একাত্তর পরবর্তী সময়ে সংবাদমাধ্যমগুলো বস্তুনিষ্ঠতার পরিসর সৃষ্টি করতে না পারাই বিভিন্ন আকৃতির ফ্যাসিবাদেরও উত্থান হয়েছে।
গণমাধ্যমের দায়িত্ব কেবল বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে সক্ষম হওয়া নয় বরং পাঠকের মনে ইতিবাচকতাকে সংক্রমিত করা, জনগণকে সজাগ করে তোলা। বিশেষভাবে অনাধুনিক ও চিন্তাগতভাবে পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলোতে।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম দুটি মোটা দাগে বিভক্ত। একভাগের কাজ হলো ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলের হয়ে ক্ষমতামুখি গতিস্রোত তৈরি করা। অন্যভাগে ক্ষমতার পক্ষে অবস্থান করে সুবিধা গ্রহণ আর ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করার নির্লজ্জ প্রবাহ তৈরি। যার ফলে এখানে নজিরবিহীন দুর্নীতির রেকর্ড তৈরি হয়েছে। কেবলমাত্র সংবাদমাধ্যমের নির্লিপ্ততায় অনেক মন্ত্রী এমপিসহ কর্মকর্তা কর্মচারীরা লাগামহীন দুর্নীতির সুযোগ পেয়েছে। আল-জাজিরার অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত না হলে হয়তো জানাই যেতোনা জেনারেল আজিজ ও তার ভাইদের কীর্তি কিংবা সাবেক ভূমিমন্ত্রীর লন্ডনের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ৩৬০ টা বাড়ি সহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে অগাধ সম্পদের ফিরিস্তি।
বিশ্বস্ত গণমাধ্যমের অভাবে সমাজ, রাষ্ট্র ও জনমত গঠনের পর্যায়প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। শাসকের চোখে চোখ রেখে চেতনার কোন স্ফুলিঙ্গ সংবাদমাধ্যম গুলো জ্বালতে পারেনি। বরং ক্ষেত্রবিশেষ গণতান্ত্রিক চর্চায় প্রতিকূল পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হয়েছে।
সংবাদ মাধ্যমকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের ধারণায় যুক্ত করা সময় বিবেচনায় অনিবার্য। কিন্তু মানবতার পরিধির ধারণা কেবল স্বদেশে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিশ্বজনীন। সংবাদ মাধ্যমকে দেশকাল ধর্মের ঊর্ধ্বে থেকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম যদি গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দল বা উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রতিনিধিত্ব করে তখন তার সম্ভাবনাময় আদর্শিক জায়গাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উগ্র দেশপ্রীতিও অন্য দেশের মানবিক বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। পশ্চিমা গণমাধ্যমের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে অশান্ত করে রেখেছে দশকের পর দশক।
সম্প্রতি বাংলাদেশের ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে সংবাদমাধ্যম ও অনলাইন পোর্টালে যে তর্কযুদ্ধ বা সংবাদ উপস্থাপন ও বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে তা দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান স্বাভাবিক সম্পর্কগুলো নষ্ট করে দিয়েছে। এজন্য গণমাধ্যমকে পেরিয়ে যেতে হয় দেশ কালের সীমা।
গণমাধ্যমের এমন দশার মধ্যে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের পশ্চাদপদ দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের একমাত্র জনপ্রিয় পত্রিকা মেহেরপুর প্রতিদিনের ভবিষ্যৎ কি? এমন প্রশ্ন স্বাভাবিক। মারাত্মকভাবে বিভাজিত এই সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে মানুষের কথা বলা, মানুষের বুকের স্পন্দন ও অপ্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাসকে অনুবাদ করে প্রকাশ করা এ কঠিন কর্মযজ্ঞ। তার উপরে রয়েছে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার মতো কঠিন বিষয়। মেহেরপুর প্রতিদিনের সপ্তম বর্ষ পেরিয়ে অষ্টম বর্ষে পদার্পণ একটি বিস্ময়। এটি টিকে আছে কেবল কয়েকজন মানুষের শ্রম ও আন্তরিক পরিচর্যার কারণে। সংবাদমাধ্যমের টিকে থাকা সহজ হয় তখনই যখন সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তা মানুষ অনুভব করতে পারে। সামাজিক অসঙ্গতি, স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে যেখান ব্যক্তির একক লড়াই অসম্ভব, সেখানে সংবাদমাধ্যম সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
মানুষের কন্ঠস্বর হয়ে প্রতিবাদের ভাষা জোরালো করে। সংবাদমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যেমন সহযোগিতা করে তেমনি জনগণকেও তার দায় সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। যে কাজটি মেহেরপুর প্রতিদিন সাবলীলতার সাথে করে চলেছে। আর তার টিকে থাকার কারণও সেটি। মেহেরপুর প্রতিদিনের প্রয়োজনে নয় বরং সকলের প্রয়োজনেই এর বেঁচে থাকা জরুরি। এই উপলব্ধি মানুষের মধ্যে দ্রুত জাগরিত হোক।
মেহেরপুর প্রতিদিনের জন্য শুভকামনা।
লেখক: শিক্ষক , কবি ও উপস্থাপক।