এখন আর আমি হাটবার পারিনা সেরম, পায়ে বল পায়না, চলতে পারিনা, ওষুধপাতি নাই। হটাৎ বৃষ্টির পানিতে ঠান্ডা লেগেছে। কাশতে কাশতে মরে যায়। এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রসিদ্ধ লোকসঙ্গীত শিল্পী কাঙ্গালিনী সুফিয়া। কোনবা পথে নিতাইগঞ্জে যাই, পরাণের বান্ধব রে, বুড়ি হইলাম তোর কারণে, নারীর কাছে কেউ যায় না, আমার ভাঁটি গাঙের নাইয়া প্রভৃতি গানের জন্য তিনি বিখ্যাত।
তিনি বলেন, মাস শেষে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বরাদ্দকৃত ভাতা দশ হাজার টাকা ভাতা আর বছর শেষে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ৩২ হাজার টাকার শিল্পী ভাতা। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আর করোনার এই সময়ে মাসিক দশ হাজার টাকায় কি আর দিন যায়? তাছাড়াও অনেক দিন ধরে এসব ভাতা পায়নি বলেও জানান তিনি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এখন আমি মরে যাচ্ছি, আমার দেহ কি অবস্থায় আছে তার কোন খোঁজ নেও না কেহই। প্রধানমন্ত্রী আমার দিকে একটু খেয়াল রাখুক আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না।
সম্প্রতি কুষ্টিয়া শহরের এরশাদ নগর আশ্রয়ন প্রকল্প এলাকায় তার আবাসনে গিয়ে দেখা যায়, বিছানাগত হয়ে দিন দিন মৃত্যুর প্রহর গুনছেন কাঙ্গালিনী সুফিয়া। রোগ শোকে আক্রান্ত হয়ে জীবনের সাথে লড়াই করছেন তিনি। অর্থের অভাবে ব্যর্থ হচ্ছেন ওষুধ কিনতে। নিয়মিত ওষুধ খেলে কিছুটা সুস্থ্য থাকেন তিনি। সরকার থেকে যে অনুদান পান তা দিয়ে কিছুই হচ্ছে না তার। ঘরের চালা দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে ঠান্ডায় আক্রান্ত হয়ে গানের গলা হারিয়ে গেছে তার। চলতেই যদি না পারি তাহলে আর গান গাইবো কিভাবে যোগ করেন তিনি। বর্তমানে এই শিল্পী একটি টিনশেড ঘরে কাঙালিনী মেয়ে পুষ্প ও নাতনিদের নিয়ে থাকছেন।
কাঙালিনী মেয়ে পুষ্প জানান, আমার মা খুব একটা ভালো নেই। টাকার অভাবে মার ওষুধ কিনতে পারিনি। ঘরের মধ্যে বৃষ্টির পানি পড়ে। আমাদের হাতে টাকা পয়শা নেই। করোনার এ এক দেড় বছরে কোন গানবাজনার আয়োজন নেই। টাকাও নেই। বিপদের মধ্যে আছি আমরা। মায়ের শরীর সুস্থ্য থাকলে গান গাইতে পারে। বেঁচে থাকতে যদি খাইতে না পারি, তাহলে মরে গেলে দেখার লোকের দরকার নেই শাহ আবদুল করিমের মতো। পুষ্প আরও বলেন, আমার মায়ের সঙ্গী স্যাকম। সেও সবসময় ছায়া হয়ে মােেয় সাথে থাকতেন। সেও ৭-৮ মাস হলো মারা গেছে। সঙ্গী না থাকায় বিমুর্ষ হয়ে পড়েছে আমার মা। করোনার কারনে জেলা প্রশাসক (ডিসি) দেখা করে না বলেও জানান কাঙ্গালীনি সুফিয়ার মেয়ে পুষ্প।
কাঙ্গালিনী সুফিয়া ১৯৬১ সালে রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার রামদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম ছিল টুনি হালদার। বাবার নাম খোকন হালদার ও মা টুলু হালদার। সঙ্গীত জীবনে গ্রাম্য একটি গানের অনুষ্ঠানে ১৪ বছর বয়সে তিনি তার সঙ্গীত জীবন শুরু করেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে সুধির হালদার নামের একজন বাউলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়, যদিও সে বিয়ে বেশিদিন টেকেনি। ওস্তাদ হালিম বয়াতির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ১৯৭৮ সালে।
সে সময় তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সুফিয়া খাতুন নাম ধারণ করেন। সুফিয়ার মোট রচিত গানের সংখ্যা প্রায় ৫০০। তিনি রাজ সিংহাসন চলচ্চিত্রে প্রথম কণ্ঠ দেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, চীন, ভারতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সাবেক ডিজি মুস্তাফা মনোয়ার তাকে কাঙ্গালিনী উপাধি প্রদান করেন। তারপর থেকে তিনি সুফিয়া খাতুন থেকে দেশব্যাপী কাঙ্গালিনী সুফিয়া নামে পরিচিত হন।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা বলেন, কাঙ্গালিনী সুফিয়া একজন দেশের সম্পদ। তিনি একজন অনেক বয়স্ক মানুষ। তাকে মাঝে মধ্যে সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করা হয়ে থাকে। তবে অসুস্থতার কথা তার জানা নেই, খোঁজ খবর নিয়ে তাকে ওষুধ কেনাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হবে।
কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম খোঁজ খবর নিয়ে সহযোগীতার আশ্বাস দিয়েছেন।