গমের ব্লাস্ট একটি ক্ষতিকর ছত্রাকজনিত রোগ। ছত্রাকটির বৈজ্ঞানিক নাম ম্যাগনাপরথি অরাইজি (পাইরিকুলারিয়া অরাইজি) প্যাথোটাইপ ট্রিটিকাম। গমের শীষ বের হওয়া থেকে ফুল ফোটার সময়ে তুলনামূলক উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া থাকলে এ রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে।
তবে এ মৌসুমে গমে শীষ বের না হওয়ায় এখনো এখনো রোগের সংক্রমণ বোঝা যায়নি। এ রোগের কারণে গমের ফলন বিপর্যয় হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে ফলন একেবারেই কমে যায়।
মেহেরপুরসহ দেশের ৬টি জেলায় গত চার বছর ধরে এ রোগটি দেখা দিয়েছে। পরপর দুই বছর এ রোগের সংক্রমন থেকে মুক্তিপেতে সরকারি ভাবে গম চাষের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তারপরও কিছু চাষী গম চাষ করায় ব্লাষ্ট রোগটি নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। তবে ব্লাষ্ট রোগটি নির্মূলে এবং এর প্রতিরোধী গমের জাত নির্নয়ে গত ৩তন বছর ধরে মেহেরপুরে গবেষনা চলছে।
আন্তর্জাতিক গম ও ভুট্টা গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিমিট, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইন্সটিটউট, বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইন্সটিটউট, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গত তিন বছর ধরে মেহেরপুরে ব্লাষ্ট নির্মূল ও প্রতিরোধী জাত তৈরিতে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বারি ৩৩ জাত সহ কয়েকটি প্রতিরোধী জাতও উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে কৃষি বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে।
রোগের ইতিহাস ও লক্ষণ
১৯৮৫ সালে সর্বপ্রথম ব্রাজিলে দেখা যায়। পরে ব্রাজিলসহ দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে, আর্জেন্টিনা এসব দেশে এর বিস্তার হয়। বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর গমের জমি ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয় এবং ফলন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, বরিশাল ও ভোলা জেলায় প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, যা মোট গম আবাদি জমির প্রায় ৩ শতাংশ। তবে মেহেরপুরের গমের ব্লাস্ট রোগের কারণে প্রকৃত ক্ষতির মাত্রা ছিল আরো ভয়াবহ। সরকারিভাবে এই রোগটি প্রথম সনাক্ত করা হয় মেহেরপুরের মুজিবনগরে।
এ রোগের কারণে আক্রান্ত গমের ফলন শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ কমে যায় এবং ক্ষেত্র বিশেষে কোনো কোনো ক্ষেতের ফসল প্রায় সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে ব্লাস্ট আক্রান্ত গম খেতের কোনো কোনো স্থানে শীষ সাদা হয়ে যায় এবং অনুকূল আবহাওয়ায় তা অতি দ্রুত সমগ্র খেতে ছড়িয়ে পড়ে। গমের কিছু শীষের উপরিভাগ শুকিয়ে সাদাটে বর্ণ ধারণ করে যা সহজেই নিম্নভাগের সবুজ ও সুস্থ অংশ থেকে আলাদা করা যায়।
আবার কোনো কোনো শীষের প্রায় সম্পূর্ণ অংশই শুকিয়ে সাদাটে হয়ে যায়। এটি গমের ব্লাস্ট রোগের আদর্শ লক্ষণ। প্রধানত গমের শীষে ছত্রাকের আক্রমণ হয়। কৃষি বিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, আক্রান্ত বীজ এবং বাতাসের মাধ্যমে গমের ব্লাস্ট রোগ ছড়ায়। বৃষ্টির কারণে গমের শীষ ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা ভেজা থাকলে এবং তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস অথবা এর বেশি হলে এ রোগের সংক্রমণ হয় এবং রোগের জীবাণু দ্রুত বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে গমের ব্লাস্ট রোগ প্রাদর্ভাবের জন্যে আবহাওয়া সব সময় সুনির্দিষ্ট কোন নিয়মের আওতায় পড়েনা।
২০১৬ সালে গমের ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয়ার ফলে, মেহেরপুরের বারাদি বিএডিসি খামার ও চিতলা বিএডিসি খামারের সকল গমসহ এবং চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ খামারের ২১০ হেক্টর গম আক্রান্ত গম বীজ খেতের সমস্ত জমি আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। সেইসাথে সরকারিভাবে গম আক্রান্ত সকল জেলাতে ২০১৭ সালে গম চাষ না করার জন্যে সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় এবং ২০১৮ সালের গম চাষে নিরুৎসাহিত করা হয়। এরপরও কৃষকরা তাদের জমিতে গম চাষ করায় পুনরায় মেহেরপুরে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয়।
গবেষণা
গমের ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয়ার পর থেকে, ২০১৭ সাল হতে মেহেরপুর জেলাকে ব্লাস্ট রোগের ‘হটস্পট’ বিবেচনা করে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক গম ও ভুট্টা গবেষণা কেন্দ্র বা সিমিট এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে অর্থায়ন করছে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং কৃষি গবেষণা ফাউণ্ডেশন (কেজিএফ)।
দেশি বিদেশি বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে গমের ব্লাস্ট নিয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু হয়। বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইন্সটিটউট ,বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইন্সটিটউট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ব বিভাগ এবং গাজীপুরস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ব্লাস্ট নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের গবেষণাগারে এবং আক্রান্ত জমিতেও এ গবেষনা পরিচালনা করা হচ্ছে।
বিগত ২০১৮ সালে মেহেরপুর জেলার সদর উপজেলার দিঘিরপাড়া এলাকায় কৃষকের জমি লিজ নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইন্সটিটিউট, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট।
মেহেরপুর সদর উপজেলার মদনাডাঙ্গার কৃষকের জমিতে গবেষণা পরিচালনা করেন যৌথভাবে বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ব বিভাগ এবং সদর উপজেলার উজলপুরে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন গাজীপুরস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ।
এসব গবেষণার নেতৃত্ব দেন উদ্ভিদ রোগতত্ব গবেষক প্রফেসর ড. বাহাদুর মিয়া, প্রফেসর ড. তোফাজ্জেল হোসেন, প্রফেসর ড. আলী হোসেন, ড. নরেশ দেব বর্মা, ড. পরিতোষ মালাকার।
এছাড়াও ব্রিটিশ রয়েল সোসাইটি ফেলো প্রফেসর ড. নিকোলাস ট্যালবোট, প্রফেসর ড. সোফিয়ান কামাউন, ড. মোরিশিও, ড. পবন সিং, ড. টি পি তেওয়ারি নানাভাবে এসব গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন।
এ গবেষনা দলকে সহায়তা করছেন এবং মুখ্য ভুমিকা পালন করছেন মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কিটতত্ত্ববিদ ড. আখতারুজ্জামান।
একটি টিম চলতি বছরও মেহেরপুর সদর উপজেলার ২টি এবং গাংনী উপজেলায় ১টি স্থানে গমের ব্লাস্ট রোগ নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে।
চাষীদের কথা
মেহেরপুর সদর উপজেলার উজুল পুর গ্রামের গম চাষী মসলেম উদ্দিন জানান, গম চাষ না করলে খাবার সংকটে পড়তে হয়। সে কারণে গম চাষ করতেই হয়। গম চাষ বন্ধ না করে কিভাবে এ সমস্যা সমাধান করা যায় সে ব্যাপারে সরকারকে জোর দিতে হবে। তিনি আরো বলেন, ২০১৭ সালে ব্লাস্ট রোগের কারনে গমে কোন ফলন হয নি। ২০১৮ সালেও কিছুটা আক্রান্ত হয়। এবছরও গমে চাষ করেছি । এখনো বলা যাচ্ছেনা কি হবে।
ঝাউবাড়িয়া গ্রামের কৃষক আব্দুল কাদির জানান, গমে ব্লাস্ট রোগের কারণে গত বছর অর্ধেক ফলন হয়েছে। এবার প্রায় দেড় বিঘা জমিতে গমের চাষ করা হয়েছে। গমের চাষ না করলে আমাদের মত চাষীদের বাজার থেকে গম কিনে সংসার চালানো সম্ভব না। দ্রুত এর সমাধান বের করতে হবে।
কৃষি কর্মকর্তার কথা:
মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের উপ-পরিচালক ড. আখতারুজ্জামান জানান, গবেষণা একটা চলমান প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে বছরব্যাপী গমের ব্লাস্ট বিষয়ক গবেষণা পরিচালনা করা প্রয়োজন কিন্তু গ্রীণ হাউজ ফ্যাসিলিটিজ না থাকার কারণে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা পরিচালনা করবার জন্যে পুরো একটা বছর অপেক্ষা করতে হয়।
তিনি জানান, প্রাপ্ত গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণে করে দেখা গেছে, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইন্সটিটউট ইতোমধ্যে ব্লাস্ট প্রতিরোধী বারি গম ৩৩ নামক একটা জাত উদ্ভাবন করেছেন এবং বোরলগ ১০০ নামে আরেকটি ব্লাস্ট প্রতিরোধী জাত অবমুক্তির পর্যায়ে রয়েছে। সিমিট এর গবেষণা থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশে পরীক্ষিত প্রায় ৫হাজার গমের জাত থেকে আরো কিছু ব্লাস্ট প্রতিরোধী জাত পাবার আশা করা হচ্ছে।
ড. আখতারুজ্জামান জানান, গমের ব্লাস্ট রোগ প্রতিকারের কোন ব্যবস্থা করা না গেলেও প্রতিরোধক হিসেবে ভাল কীটনাশক উৎপাদক ও আমদানীকারক প্রতিষ্ঠানের ঞবনঁপড়হধুড়ষব ৫০%+ঞৎরভষড়ীুংঃৎড়নরহ ২৫% কম্বিনেশনের ছত্রাশনাশক বেশ ভালভাবে কাজ করছে বলে গবেষকেরা নিশ্চিত করেছেন।
ওদিকে সিমিটের তত্বাবধানে ব্রাজিলের গম বিজ্ঞানী ড. মোরিশিও একটা মডেল দাঁড় করানোর নিরন্তর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। প্রতিবেশী দেশ ভারত গমের ব্লাস্ট প্রতিরোধী কিছু জাত উদ্ভাবনের দাবী করছে, সেসব জাতের বীজ আমদানীরও চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
ড. আখতারুজ্জামান আরো জানান, এ বছর মেহেরপুরে প্রায় ৫০ বিঘা জমিতে ব্লাস্ট প্রতিরোধী বারি গম ৩৩ জাতের প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান গুলোর সহায়তায়।
গত বছরে উৎপাদিত বীজ থেকে বেসরকারিভাবে আরো ১০০ বিঘার অধিক জমিতে কৃষকরা বারি গম ৩৩ জাতের গম চাষ করেছেন।
ফলে আশা করা হচ্ছে বারি গম ৩৩ জাতের যে পরিমাণ বীজ এ বছরে মেহেরপুর জেলাতে উৎপাদিত হবে তাতে করে আগামী বছর মেহেরপুরের সর্বত্র গমের ব্লাস্ট প্রতিরোধি বারি গম ৩৩ জাতটি ছড়িয়ে পড়বে। তাই গমে চাষের ব্যাপারে ২০১৬ সাল থেকে কৃষকদের মধ্যে যে অনীহা ও ভীতি ছিল সেটা আগামী বছর থেকে দূর হওয়ার আশা করা হচ্ছে।
-নিজস্ব প্রতিবেদক