দেশ জুড়ে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা ভাইরাসে সংক্রমনের সংখ্যা। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে মৃতের সংখ্যাও। গতকাল শুক্রবারও সারা দেশে ২ হাজার ৮’শ২৮ জন নতুন করে সনাক্ত হয়েছে এবং মৃত্যু বরণ করেছে ৩০ জন। গত ৮ মার্চ দেশে করোনা রোগ সনাক্ত হয়। গতকাল পর্যন্ত দেশে ৮১১ জন করোনা আক্রান্ত মৃত্যুবরণ করেছেন, আক্রান্ত হয়েছেন ৬০ হাজার হাজার ৩৯১ জন এবং সুস্থ হয়েছেন ১২ হাজার ৮০৪ জন।
তবে দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় মেহেরপুরে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে করোনা ভাইরাস। ৮ লক্ষ মানুষের এ জেলায় এ পর্যন্ত ২৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ২ জন, সুস্থ হয়েছেন ৬ জন এবং বর্তমানের ১৮ জন চিকিৎসাধীন থাকলেও তারা সকলেই ভাল রয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। বর্তমানে মেহেরপুর সদরে ৯জন ও গাংনী উপজেলায় ৯জন মোট ১৮ জন করোনা রোগী চিকিৎসাধীন আছে। ইতিমধ্যে মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলা শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে।
তবে জেলাকে করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে দুটি জেলার প্রবেশমুখে তল্লাশি চৌকি আরো জোরদার করতে হবে। দেশের বিভিন্ন প্রাণÍ থেকে আসা মানুষদের সনাক্তের মাধ্যমে তাদের হোম কোয়ারেন্টিন কঠোরভাবে বাধ্যতামূলক করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রেও প্রশাসনকে আরো কঠোর হতে হবে বলে মত দিয়েছেন বিভিন্ন জনেরা।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, সর্বশেষ গত ৩১মে ১টি পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়া যায়। ৫দিন অবিবাহিত হলেও নতুন কোন পজিটিভ রিপোর্ট আসেনি। প্রাপ্ত রিপোর্টের সব গুলোই নেগেটিভ। এ পর্যন্ত মেহেরপুরে ১হাজার ১শ ২৮টি রিপোর্ট আসে। তার মধ্যে ১হাজার ১শ ২ জন নেগেটিভ।
এভাবেই প্রশাসনিক তৎপরতা অব্যাহত রেখে সামাজিক দুরুত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে পারলে করোনা মহামারী থেকে মেহেরপুরকে রক্ষা করা সম্ভব বলে মনে করছেন অনেকেই।
মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও আইনজীবী অ্যাড. ইব্রাহীম শাহিন বলেন, করোনা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছে গণমাধ্যম। করোনা আক্রান্ত এলাকা থেকেই লোকজন এসে মূলত আমাদের মেহেরপুরে করোনাভাইরাস অল্প হলেও ছড়িয়েছে। সে ক্ষেত্রে গণমাধ্যম কর্মিরা প্রশাসনকে এ সংক্রান্ত তথ্য দিয়ে সার্বিকভাবে সহযোগীতা করেছে। সেই সাথে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ও মেহেরপুর ১ আসনের সংসদ সদস্য ফরহাদ হোসেনের নিয়মিত মনিটরিং করে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই মোতাবেক প্রশাসনের কর্মকান্ডের ফলে আমরা অন্য জেলার তুলনায় করোনা প্রতিরোধে অনেকটাই সফল। এই ধারাবাহিকতা বিগত কয়েকদিনে আমাদেরর নতুন করে কোন করোনা রোগী আক্রান্ত হয়নি। এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হলে প্রশাসন, গণমাধ্যম কর্মিদের তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে। সেই সাথে সাধারণ জনগনকে আরও সচেতন হতে হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকল কার্যক্রম করতে হবে।
মেহেরপুর জেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও সিনিয়র সাংবাদিক তোজাম্মেল আযম বলেন, আমাদের মেহেরপুরে এখনো পর্যন্ত অন্য জেলার তুলনায় করোনার প্রাদুর্ভাব অনেক কম। মহামারী আকার ধারণ করার আগেই আমাদের আরও কঠোর হতে হবে। অদৃশ্য শত্রু করোনার যেহেতু এখনও ধন্বন্তরি কোন ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। তাই সচেতনতায় করোনা প্রতিরোধের প্রতিষেধক। মেহেরপুরের মুল চালিকাশক্তি কৃষি। জেলায় করোনার মহামড়কের আগে এখনিই কারফিউ দিয়ে কৃষি ও কৃষককে বাচাতে হবে।
মেহেরপুর সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল-আমিন ধুমকেতু বলেন, অন্য জেলার তুলনায় দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা মেহেরপুরে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা কম। সেক্ষেত্রে করোনার প্রাদুর্ভাব মেহেরপুরে যাতে বৃদ্ধি না পায় সেজন্য আমাদের কিছু কাজ করতে হবে। প্রথমত যারা করোনা পজিটিভ হবে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক আইসুলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। বাড়িতে আইসুলেশনে থাকলে অনেক সময় তার পরিবারের লোকজন আক্রান্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ইতিমধ্যে সাহারবাটি গ্রামের এক করোনা পজিটিভ ব্যক্তির দেখভাল করতে গিয়ে তার পরিবারের একজন আক্রান্ত হয়েছে। আমরা জানি গণপরিবহন চালু হয়েছে। সারা দেশের সাথে একটা যোগাযোগ ব্যবস্থা পূনরায় চালু হলো। এক্ষেত্রে গণ-পরিবহনগুলোতে কড়া নজরদারি দিতে হবে। শতভাগ স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। মেহেরপুর শহরের কাঁচাবাজারে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা অনেকটা কষ্টসাধ্য। এক্ষেত্রে মেহেরপুর হোটেল বাজার ও বড় বাজারের কাচা বাজার দুটোকে বড় খেলার মাঠে স্থানান্তর করা গেলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। এছাড়াও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের করোনা মোকাবেলার ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে।
সিভিল সার্জন ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, মেহেরপুরে এ পর্যন্ত মোট ২৬ জন করোনা পজিটিভ রোগী সনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মৃত্যু বরণ করেছে ২জন, সুস্থ্য হয়েছেন ৬ জন এবং চিকিৎসাধীন আছে ১৮ জন। বর্তমানে যারা চিকিৎসাধীন আছে তাদের সর্ব্বোচ্চ সেবা দেওয়া হচ্ছে। আমরা নিয়মিত নমুনা প্রেরন করছি তবে গত কয়েকদিনের মধ্যে মেহেরপুরে কোন পজিটিভ রিপোর্ট আসেনি সবগুলোই নেগেটিভ। এই মূহুর্তে অন্য জেলার তুলনায় আমাদের মেহেরপুরে করোনা পরিস্থিতি বেশ ভালো। জেলা স্বাথ্য বিভাগ এই করোনা প্রতিরোধের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
পুলিশ সুপার এস এম মুরাদ আলী বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই জেলা পুলিশ সামাজিক দুরুত্ব নিশ্চিত ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে সর্বাত্মক কাজ করছে। আমরা মেহেরপুরের প্রবেশ মুখে কড়া নজরদারি করছি। প্রতিটি গাড়ি ও জনগনকে মেহেরপুরে প্রবেশের আগে ভালোভাবে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। সেই সাথে গাড়ি গুলোকে জীবানুমুক্ত করার জন্য স্প্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে। সীমিত আকারে সবকিছু খুলে দেওয়ার পর জনগনের স্বাস্থ্যবিধি ও গনপরিবহনে চলাচল করার সময় শতভাগ স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে জেলা পুলিশের একটি চৌকস দল সব সময় মাঠে কাজ করছে। মেহেরপুরের করোনা পরিস্থিতি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে আমরা আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাবো।
জেলা প্রশাসক আতাউল গনি বলেন, করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই ভাইরাসটি যাতে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য জেলা প্রশাসন কঠোরভাবে কাজ করেছে। গত ২৪ মার্চ থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ব্যাতিত সব ধরনের ব্যবসা-বানিজ্য, দোকানপাট বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছিল। সামাজিক দুরুত্ব নিশ্চিত করার জন্য জেলা প্রশাসনের টিম সব সময় মাঠে কাজ করেছে। সেই সাথে মানুষকে ঘরে রাখতে ৫৩ হাজারেও বেশি পরিবারের মাঝে প্রধানমন্ত্রী ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর উদ্যোগে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। আরও ৫০ হাজার পরিবারকে ২০ কেজি করে চাউল বিতরণের কার্যক্রম চলমান আছে।
সেই সাথে মেহেরপুরে ৫০ হাজার দরিদ্র পরিবার প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ২হাজার ৫শ টাকা করে পাবে। ইতিমধ্যে ১৩ হাজার ৮শ ৫৬জনকে এসএমএস এর ম্যাধমে অর্থ প্রেরন করা হয়েছে। এছাড়াও সীমিত আকারে সব প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে তিন শিফটে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে।
এছাড়াও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাস্ক ও সাবান বিতরণ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য সম্মত ভাবে যাতে দোকানপাট, সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলো পরিচালনা হয় সে দিকে কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে। প্রয়োজনে জরিমানার আওতায় এনে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে আমরা লক্ষ্য করেছি সাধারণ মানুষের ভিতর স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি হয়েছে। ধিরে ধিরে এটি অভ্যাসে পরিনত হচ্ছে। এছাড়াও আমরা মেহেরপুরের প্রবেশ মুখে কঠোর নজরদারি রেখেছি।