গাংনীতে ছাগল পালন করে কয়েক হাজার পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে। গাংনী ছাপিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হচ্ছে এ সব ছাগল। ইতি মধ্যে মেহেরপুরের ব্লাক বেঙ্গল ছাগলের সুনাম দেশ ব্যাপি। ছাগল পালন করে যেমন ঘুরিয়েছে নিজের ভাগ্যের চাকা তেমনি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাখছে ব্যাপক ভুমিকা।
গাংনী উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের তথ্য মোতাবেক গাংনী উপজেলায় পৌরসভায় ছাগলের সংখ্যা ৬ হাজার টি, কাজীপুর ইউনিয়নে ১৫ হাজার ৯ শ ১০টি, তেঁতুলবাড়িয়া ইউনিয়নে ১৪ হাজার ৮শ ৭টি, কাথুলি ইউনিয়নে ১৪ হাজার ৭শ ২৩টি, বামুন্দী ইউনিয়নে ১৪ হাজার ১শ ৩ টি, ষোলটাকা ইউনিয়নে ১৩হাজার ২শ ৯ টি, রায়পুর ইউনিয়নে ১৩ হাজার ১শ ৩৭টি, ধানখোলা ইউনিয়নে ১৪ হাজার ২শ ৩২টি, মটমুড়া ইউনিয়নে ১২ হাজার ১শ ১২টি, সাহারবাটি ইউনিয়নে ১২হাজার ৪শ ৫টি, পৌরসভাসহ ৯টি ইউনিয়নে ১লক্ষ ৩০ হাজার ৬শ ৩৮ টি ছাগল রয়েছে। ছাগলের খামারী রয়েছে সরকারি রেজিষ্টার্ডভূক্ত ৬৪ টি, রেজিষ্টার্ডবিহীন ৯২ টি। মোট ১৫৬ টি ছাগলের খামার রয়েছে। প্রতিটি খামারে গড়ে ছাগলের সংখ্যা ১৭ টি।
এই বিষয়ে পশ্চিম মালসাদহ গ্রামের ছাগল ব্যবসায়ী বজলুর রহমান বলেন, আমরা বিভিন্ন গ্রাম থেকে বিভিন্ন জাতের মধ্যে বিশেষ করে ব্লাক বেঙ্গল প্রজাতির ছাগল বেশী কিনে আনি এবং এগুলোর চাহিদা ব্যাপক হওয়ায় গাংনী, বামুন্দীসহ বিভিন্ন বাজারে আমরা এগুলো বিক্রয় করে থাকি এবং এগুলো বেশ লাভজনক।
জুগিন্দা গ্রামের মাংশ ব্যবসায়ী করিম মেহেরপুর প্রতিদিনকে বলেন, গাংনীর অধিকাংশ সরকারি অনূষ্ঠান গুলোতে আমি মাংশ সরবরাহ করে থাকি। ব্লাক বেঙ্গল ছাগলের মাংশ সুস্বাদু হওয়ায় মাংশ ক্রয় কারীদের চাহিদা অনেক বেশী গাংনী উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা মোস্তফা জামান’র এর সাথেযোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাদের জনবলের অভাবে আমরা সকল ছাগল খামারীকে সঠিক সেবা দিতে পারছি না, এই সমস্ত সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।
গাংনী উপজেলার ধানখোলা ইউনিয়নের পাকুড়িয়া গ্রামের প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবার দেশি-বিদেশী বিশেষ করে ব্লাক বেঙ্গল ছাগল পালন করে আজ তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী।ঐ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ গরিব এবং বাড়িঘর তেমন উন্নত নয়। পরিবারের এই অস্বচ্ছলতা দূর করতে প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবার নিজেদের সাংসারিক স্বচ্ছলতা আনতে ছাগল পালন করে আজ তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। ঐ গ্রামের পশ্চিম পাড়ার জ্বলেদের স্ত্রী মিনা-রানী (২০ ) বলেন, প্রায় এক বছর পূর্বে আমার বিবাহ হয়।
বিবাহের সময় আমার বাবা-মা ১৫ হাজার টাকা দেন স্বর্ণের গহনা তৈরি করা জন্য কিন্তু বাবা-মায়ের দেয়া সেই টাকা আমি গহনা তৈরি না করে , সেই টাকা দিয়ে একটি পাটি ছাগল ক্রয় করি। সেই একটি ছাগল থেকে এখন আমার বাড়িতে ১১টি ছাগল। গত কোরবানীর সময় ৪ টি ছাগল বিক্রয় করি। বর্তমানে সব ছাগলগুলো বিক্রয় করলে আমি আনুমানিক ২ লক্ষাধিক টাকা পাব। অন্যদিকে একই গ্রামের মিখায়েল বিশ্বাস এর স্ত্রী স্বর্ণমেরী বিশ্বাস(৩৬ ) বলেন,১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে আমি ছাগল পালন করে আসছি।
ছাগল পালনে আমরা সাধারনত কিনে আনা কোন খাবার দিতে পারি না। মাঠের ঘাস পাতা খেয়েই সাধারনত তারা জীবন ধারন করে। বর্তমানে আমি ২৩ টা ছাগল পালন করছি। এই ছাগলগুলো বিক্রয় করলে আনুমানিক সর্বনি¤œ হলেও ২ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা হবে। ছাগল পালন করে আমি আমার পরিবারে স্বচ্ছলতা এনেছি। ছাগল পালন একটা লাভজনক পেশা । অল্প পুঁজিতে ছাগল পালন করা যায়। গৃহের সমস্ত কাজ সেরে আমি নিজেই ছাগল গুলো মাঠে নিয়ে যায়। একই পাড়ার দানিয়েল বিশ্বাস’র স্ত্রী শেফালী বিশ্বাস বলেন, ছাগল পালন এর পূর্বে আমার সাংসারিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। চারিদিকে সবার ছাগল পালন দেখে আমিও পরিবারের অভাব দূর করার জন্য ছাগল পালন শুরু করি। বর্তমানে আমার ১১ টি ছাগল রয়েছে। বাইরে থেকে কোন খাবার কেনার সামর্থ না থাকায় এই ছাগলগুলোর খাবারের জন্য ৮ কাঠা জমিতে নেপিয়ার ঘাস লাগিয়েছি। বর্তমানে ছাগলগুলো বিক্রয় করলে আনুমানিক ১লক্ষ ২৫ টাকার কম হবে না। আমরা এখন ছাগল পালন করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হযেছি। ঐ গ্রামের মথির স্ত্রী রুলি বলেন, পরিবারের অভাব ঘোচাতে আমি ছাগল পালন করি।
ছাগল পালন করে আমার আর্থিক সমস্যা অনেকাংশে দূর হয়েছে। আমার বাড়িতে বর্তমানে ১৫ টি ছাগল আছে। যার আনুমানিক মূল্য ১লক্ষ ৫০ হাজার টাকা । ছাগলের প্রতি একটু খেয়াল রাখলে তেমন কোন রোগ হয় না । অন্যদিকে ঐ গ্রামের শুকেশের স্ত্রী সুখি বলেন, আমাদের এই পাড়ায় অধিকাংশ বাড়িতে ছাগল পালন করে, আমি প্রথমে একটি ছাগল ক্রয় করি, আস্তে আস্তে দু-এক বছরের মধ্যে আমার এখন ১২ টি ছাগল।যা বিক্রয় করলে বর্তমান বাজার মূল্যে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা হবে বলে আমার বিশ্বাস। অপরদিকে একই পাড়ার সেবাস্তীনের স্ত্রী মরি বলেন, আমরা গরিব মানুষ গরু পালন করা আমাদের সম্ভব নয়।আমি প্রথমে একটি ছাগল ক্রয় কর্ িসেই থেকে আজ আমাদের ১৩ টি ছাগল। এই ছাগলগুলো ঠিকমত খেতে দিতে পারি না ।
মাঠের ঘাস-পাতা খেয়েই জীবন ধারন করতে হয় তাদের। বাজার থেকে ছাগলগুলোর জন্য যদি খাবার কিনে আনতে পারতাম তাহলে স্বাস্থ্যবান হতো এবং আমরাও আরো বেশী লাভবান হতে পারতাম। ঐ গ্রামের বাসিন্দা অঞ্জনা রানী (৩৮)বলেন, আমরা অনেকদিন থেকে ছাগল পালন করি ।বর্তমানে আমার বাড়িতে ১৫ টি ছাগল রয়েছে। যার বর্তমান মূল্য আনুমানিক ১লক্ষ ৭০ হাজার টাকা। ছাগল পালন করে আমাদের সংসারের অনেক উপকার হয়েছে। ঐ গ্রামের পায়েল (৩০) বলেন, আমাদের বাড়িতে ২০ টি ছাগল আছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য আনুমানিক ৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। অপরদিকে একই পাড়ার ঊষারানী (৩৫) বলেন, আমার বাড়িতে বর্তমানে ১২ টি ছাগল আছে যার বর্তমান বাজার মূল্য আনুমানিক ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা।
অপরেিদক মরিয়ম নামের একজন ছাগল পালন কারী বলেন, আমাদের গ্রামে অধিকাংশ বাড়িতেই ছাগল পালন করে। আমারও ১০ টি ছাগল আছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য আনুমানিক ১ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা হবে। এখানে সবাই গৃহের কাজ সেরে প্রায় সবাই ছাগল নিয়ে মাঠে চলে যায়। ছাগল গুলো সাধারনত গৃহিনীরাই লালন-পালন করে থাকে। এছাড়া ও ঐ গ্রামের অধিকাংশ ছাগল পালন কারীরা বলেন, পরিবারের ছোট- ছোট সমস্যা গুলো সমাধানের জন্য ছাগল পালন সবচেয়ে উপকারি বলে তারা সে¦চ্ছায় আনন্দের সাথেই ছাগল পালন করছেন। কেননা ছাগল পালনে খরচ কম।বর্ষাকালে একটু খেয়াল রাখলে রোগ বালাই তেমন চোখেই পড়ে না।
ছাগল পালনের জন্য একটু উঁচু করে ঘর বানাতে হয়, কারন বর্ষাকালে ঘরে যেন কোনভাবেই পানি জমতে না পারে সেজন্য সতর্ক থাকতে হয়।আর এর জন্য বাঁশের মাচা ও টিনের ছাউনি দিয়ে ঘরগুলো সাধারনত তৈরি করা হয়। এভাবে ছাগল পালনকারীরা একদিকে নিজেরা যেমন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে অন্যদিকে তারা মাংশের চাহিদাতেও রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। এই বিষয়ে ৮ নং ধানখোলা ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন মেহেরপুর প্রতিদিনকে বলেন, পাকুড়িয়া গ্রামের প্রায় অর্ধশতাধিক গৃহিনী ছাগল পালন করে তাদের সংসারে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনেন।
ঐ গ্রামের বাসিন্দা মেহেরপুর জেলা সিনিয়র আইনজীবী সুজন কুমার মন্ডল মেহেরপুর প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের গ্রামে এক সময় অধিকাংশ মানুষ অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল ছিল,বর্তমানে ছাগল পালন করে তারা স্বালম্বী হয়েছে । এটা সত্যিই আনন্দের কথা। আমরা তাদেরকে নিয়ে গর্ব করি । তারা আমাদের গ্রামের অহংকার।
নিজস্ব প্রতিবেদক: