বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও অধিকারের মামলার বিষয়ে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংসদে গৃহীত রেজোলিউশনের প্রতিবাদ ও তা বাতিলের জন্য চিঠি দিয়েছে ইউরোপে বসবাসরত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা নবম ইউরোপীয় সংসদের উচ্চ প্রতিনিধি জোসেপ বোরেল, ১৪ জন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং দা লেফট, ভার্টস/এএলই, রিনিউ, এস এন্ড ডি, পিপিই-এর প্রতিনিধি এমইপিদের কাছে চিঠি দেন।
চিঠিতে প্রবাসীরা জানান, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিশেষ করে অধিকারের মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে যে রেজোলিউশন পাস করা হয়েছে তার জন্য তারা সকলেই ক্ষুব্ধ। “অবিলম্বে এবং নিঃশর্তভাবে এই দণ্ড প্রত্যাহার করার এবং অধিকারের নিবন্ধন পুনঃস্থাপন করার” অনুরোধ জানিয়ে যে বিবৃতি দেয়া হয়েছে তারা সে বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যা তারা একটি সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ আইনি বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন।
‘অধিকার মামলাটি’ বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা অধিকার কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের কারণে করা হয়েছিল। বাংলাদেশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হেফাজতে ইসলাম নামের ‘ জঙ্গি সংগঠন’ দ্বারা ২০১৩ সালের ৫ মে, ধ্বংসাত্মক ইসলামিক এজেন্ডা দাবি এবং একটি সহিংস ভাঙচুর ও জনগণের অধিতার নস্যাৎ করার জঙ্গি আন্দোলন ব্যর্থ করে। এই ঘটনায় গত একই বছরের ১০ জুন অধিকার রিপোর্টে ৬১ জন নিহত হওয়ার দাবি করা হয়েছে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্বাধীন সংস্থাগুলো অধিকার এর দেওয়া মৃত্যুর তালিকায় ব্যাপক অনিয়ম এবং ভুল তথ্য পায়।
চিঠিতে বলা হয়, উদাহরণস্বরূপ- তালিকায় ১০ তম এন্ট্রি খালি ছিল। অধিকারের তালিকায় তিনজনের নাম নিহত হওয়ার দাবি করলেও পরে জীবিত পাওয়া যায়। এতে নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে নিহত আরও পাঁচজনের নাম ছিল যারা ওই ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিলো না । তালিকায় পাঁচটি নাম রয়েছে যা দুবার গণনা করা হয়েছে। তালিকায় প্রথম নাম, সিদ্দিকুর রহমান, পুলিশ কর্তৃক রিকুইজিশন করা বাস চালক যাকে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা হত্যা করেছে। ৫৭ তম নাম- কামাল উদ্দিন খান, একজন জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ব্যবস্থাপক, সেই রাতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। এছাড়া আরো ১৯ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
প্রবাসীরা জানান, অধিকারের রিপোর্ট উগ্র ইসলামপন্থীদের তুষ্ট করেছে এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে তাদের ক্রোধ উস্কে দিয়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিশ্চিত করার জন্য লড়াইরত প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানোর জন্য এই ‘৬১ জন’ মৃত্যুর সংখ্যা হেফাজতে ইসলাম এবং জামায়াতে ইসলামের মতো কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলোর জন্য একটি ভিত্তি হয়ে উঠেছে । হেফাজতে ইসলাম ২০১০ সালে কওমি মাদ্রাসা এবং তাদের ছাত্রদের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাদের ১৩ দফা দাবির সনদ – যার মধ্যে ব্লাসফেমির জন্য মৃত্যুদণ্ড, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা, সমস্ত স্তরে লিঙ্গ বিচ্ছিন্নতা, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থানগুলো ধ্বংস করা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে হেফাজত তালেবানের সাফল্যকে অনুকরণ করছে । তারা বাংলাদেশকে একচেটিয়া ইসলামী ধর্মতত্ত্বে পরিণত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে যা খুবই উদ্বেগজনক।
এতে আরও বলা হয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার রক্ষায় একটি প্রশংসনীয় ট্র্যাক রেকর্ড রয়েছে। তবুও, একটি রেজোলিউশন বিরাজমান উদ্বেগগুলোকে মোকাবেলা করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় কিনা তা নির্ধারণ করার জন্য গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা অপরিহার্য। হেফাজতে ইসলামের ক্রিয়াকলাপ এবং তাদের ১৩ দফা দাবিগুলো তাদের একটি রক্ষণশীল ইসলামী এজেন্ডা অনুসরণ করে এবং তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য ধ্বংসাত্মক জঙ্গি প্রক্রিয়ায় জড়িত হওয়ার আগ্রহকে প্রতিফলিত করে। এই ধরনের সহিংস আন্দোলনের মুখে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসাবে প্রতীয়মান হয়েছে।
বাংলাদেশে অধিকার মামলাটি ঢাকা শহরে ২০১৩ সালের হেফাজতে ইসলামের সহিংস কর্মকাণ্ডের সময় মৃত্যুর সংখ্যা সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য প্রচারের অভিযোগকে কেন্দ্র করে। তাদের বক্তব্য মানবাধিকার প্রতিবেদনের চেয়ে রাজনৈতিক। এটি ইসলামিক জঙ্গিদের রক্ষা করছে বলে মনে হচ্ছে এবং প্রগতিশীল শক্তিকে খলনায়ক হিসেবে দেখানো হয়েছে।
আদিলুর খান ২০০১-২০০৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী জোট সরকারের সময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সহিংস সরকার ছিল। তাদের ‘হরকাত-উল-জিহাদ’ নামের একটি তালেবান-সংযুক্ত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সমর্থন করার ইতিহাস রয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, উগ্র ইসলামপন্থীদের সাথে তার অতীতের সম্পর্ক স্পষ্টভাবে তার পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি শুধুমাত্র জঙ্গিবাদী ইসলামপন্থীদের পক্ষপাতমূলক নয়, অপ্রমাণিত দাবি এবং মিথ্যা যুক্তিতেও পূর্ণ। ইইউ পার্লামেন্ট স্বচ্ছ ও ন্যায্য আইনি প্রক্রিয়ার পক্ষে ওকালতি করতে পারে যা অবশ্যই ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকারের নীতিগুলিকে সমর্থনের ভিত্তিতে হবে। এটি অবশ্যই বাংলাদেশের আইনের শাসনকে সম্মান করার, দেশের আইনি কাঠামো এবং সেই মোতাবেক গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো বজায় রাখার গুরুত্বের উপর জোর দিতে হবে। একটি জাতির সার্বভৌমত্বকে সম্মান করা এবং মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের পক্ষে ওকালতি করার মধ্যে একটি ভারসাম্য থাকা আবশ্যক।
চিঠিতে প্রবাসীরা ইইউ পার্লামেন্টকে প্রস্তাবটি পুনর্মূল্যায়ন করার জন্য অনুরোধ করেন।