অনলাইন জুয়ার সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজের শিক্ষক নুরুল ইসলাম ওরফে লালন ও জামান উদ্দিনকে শোকজ করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। তবে কি করতে হবে না জানা থাকায় মাদার আলীকে এখনো শোকজন করেননি সাহেবপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
গত ২৫ সেপ্টম্বর “এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে, প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় চলেন তাঁরা, অনলাইন জুয়ার অন্যতম চার হোতা, মুকুল-জামান-নুরুল-মাদার” শিরোনামে মেহেরপুর প্রতিদিনে সংবাদ প্রকাশ হয় । সংবাদ প্রকাশের পর থেকে বিভিন্ন স্থানে ধর্ণা দেওয়া শুরু করেছেন ওই চারজন।
মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ওমর খৈয়াম উষা মেহেরপুর প্রতিদিনকে বলেন, মেহেরপুর প্রতিদিনের তাদের দুই শিক্ষক নুরুল ইসলাম ও জামান উদ্দিনের বিরুদ্ধে অনলাইন জুয়ার মূল হোতা হিসেবে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদ প্রকাশের কারণে তাদের দুজনকে শোকজ করা হয়েছে এবং একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশিত অভিযোগের জবাব দিতে বলা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। তারা কলেজের বাইরে কি করেন তা বলতে পারবো না।
তবে, সদর উপজেলার সাহেবপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহাজুল ইসলাম বলেন, লাইব্রেরীয়ান মাদার আলীর বিরুদ্ধে প্রকাশিত সংবাদ দেখেছি। এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকায় শোকজ করতে পারিনি। এমনকি তার বিরুদ্ধে কি করণীয় তাও জানিনা। আগামীকাল (আজ) রবিবার উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা স্যারের কাছে জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন ধরাছোঁয়ার বাইরে অনলাইন জুয়ার অন্যতম চার হোতা মুকুল-জামান-নুরুল-মাদার
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, চারজনের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর থেকে চারজনই এলাকা থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন। নুরুল ইসলাম ও জামান উদ্দিনের দায়িত্ব নিয়ে মাদার আলী বিভিন্ন মহলে দোড়ঝাপ শুরু করেছেন। এমনকি নুরুল ইসলাম ও জামান উদ্দিনের কাছে থেকে মাদার আলী আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন বিষয়টি ম্যানেজ করা হবে বলে।
অপরদিকে, সংবাদ প্রকাশের দিনই প্রথমে মেহেরপুর প্রতিদিনের সম্পাদককে মোবাইল ফোনে হুমকি দিয়ে দেখা করতে আসবেন বলে জানান অনলাইন জুয়ার হোতা মুকুল ইসলাম। কিন্তু পরে তিনি আর আসেননি।
ওই দিনই সন্ধ্যায় মেহেরপুর প্রতিদিন কার্যালয়ে আসেন আরেক হোতা মাদাার আলী। তিনি এক বছর আগে অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত ছিলেন বলে স্বীকার করেন। তবে বর্তমানে এই জগতের কারো সাথে তার যোগাযোগ নেই বলে দাবী করেন। অন্য দুই হোতা নুরুল ইসলাম ও জামান উদ্দিনের তার যোগাযোগ নেই বলে দাবী করলেও তাদের দেওয়া লিখিত প্রতিবারে প্রতিটি কথা হুবুহু মিলে গেছে। যা থেকেও মেহেরপুর প্রতিদিন ধারণা করছে তারা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত।
নুরুল, মাদাার, মুকুল ও জামানের সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সূত্র থেকে তাদের সাথে জড়িতদের তালিকা মেহেরপুর প্রতিদিনের হাতে এসেছে। মেহেরপুর প্রতিদিন তালিকা হাতে পাওয়ার পর অনুসন্ধান অব্যহত রেখেছে। তালিকার মধ্যে থেকে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনের সম্পৃক্তার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। তবে এ অনলাইন জুয়ার এ গ্রুপটি শুধু মেহেরপুর থেকেই নয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনলাইন জুয়া এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন।
আরও পড়ুন মেহেরপুরে অনলাইন জুয়ার মাস্টারমাইণ্ড প্রসেনজিৎ সহযোগীসহ আটক
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিআইডির কাছে কয়েকজন জুয়ার এজেন্ট আটকের পর রাশিয়ান জুয়া সাইট ওয়ান এক্সবেট বাংলাদেশে বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এখন তারা মেইলবেট ও লাইনবেট সাইটের মাধ্যমে জুয়ার লেনদেন চালিয়ে যাচ্ছেন। মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুর গ্রামসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের প্রায় দুই শতাধিক এজেন্ট সারা বাংলাদেশে এ জুয়া নিয়ন্ত্রণ করছেন। এতে এজেন্টরা কোটিপতি বনে গেলেও নি:স্ব হচ্ছে হাজার হাজার তরুণ ও যুবকরা।
বিষয়টি নিয়ে মেহেরপুর পুলিশের ধারাবাহিক অভিযানে কয়েকজন আটক হয়েছে। আটকের ফলে অন্যরা এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দিয়েছেন। কৌশলে জেলার বাইরে থেকেও লেনদেন চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে মেহেরপুরের সাইবার ক্রাইম বিভাগ ও ডিবি পুলিশ যৌথ অভিযান পরিচালনা করে ৫ জনকে আটক করেছেন। তাদের স্বাকারোক্তি অনুযায়ী আরো ১৫ জনকে আসামি করে একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন। মামলার অন্যান্য আসামিরা পলাতক রয়েছে। পুলিশের স্বীকারোক্তিতে একটি চ্যানেল থেকে দিনে দেড় কোটি টাকা লেনদেনের তথ্যও দিয়েছে তারা।
২০২০ সালে করোনাকালীন সময়ে মূলত কয়েকজন অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়েন। তারা হলেন- কোমরপুর গ্রামের মুকুল ইসলাম, নুরুজ্জামান ওরফে জামান মাস্টার, নুরুল ইসলাম ওরফে লালন মাস্টার, মাদার আলী ওরফে মাদার মাস্টার এদের অন্যতম। গত পর্বে অনলাইজন জুয়ার মূল হোতা চারজনকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়। সে সংবাদের কিছুটা এখানে তুলে ধরা হলো।
চার হোতাদের মধ্যে জামান উদ্দিন ওরফে মাস্টার ও নুরুল ইসলাম ওরফে লালন মাস্টার দুজনই মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেন। কিন্তু কলেজটি এখনো এমপিও ভুক্ত হয়নি। তারা দুজনই মুকুল ইসলামের মাধ্যমে অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়েন। অপরদিকে, মাদার আলী মাস্টারও নিজেই এ অনলাইন জুয়ার হোতা হয়ে উঠেছেন।
আরও পড়ুন মেহেরপুরে অনলাইন জুয়ার দূর্গে হানা
জামান মাস্টার ঢাকার একটি গার্মেন্টেসে চাকরি করতেন। চাকরি ছেড়ে তিনি নিজ গ্রামে চলে আসেন। কলেজ শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি নবাব ও মুকুলের মাধ্যমে অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়েন। এর পর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কোমরপুর বাজারে ডাচ বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট নিয়ে ব্যাংকিং ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। মূলত অনলাইনের লেনদেনগুলো যেন তার ব্যাংকে থেকেই করতে পারেন। পাশাপাশি কেউ যেন সন্দেহ করতেও না পারেন তাকে। কোথায় থেকে এত টাকা মালিক হচ্ছেন। বছর তিনেক আগে মাটির ঘরে বসবাস করলেও বর্তমানে আলিশান বাড়ি তৈরি করেছেন। ব্যবহার করেন দামি মোটরসাইকেলও।
নুরুল ইসলাম ওরফে মাস্টার গরিব ঘরের সন্তান। তিনি মুজিবনগর আদর্শ কলেজের শিক্ষক। তিনিও জড়িয়ে পড়েন অনলাইন জুয়ায়। শুরু করেন লাইনবেট অনলাইন জুয়ার এজেন্ট হিসেবে। পরবর্তিতে তিনি কেদারগঞ্জ বাজারে সিটি ব্যাংকের এজেন্ট নিয়েছেন। তার পাশে মার্কেন্টাইল ব্যাংক নামের আরেকটি ব্যাংকের এজেন্ট নিয়েছেন। পরবর্তিতে আরো একটি ব্যাংকের এজেন্ট নেন। তিনি স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, কয়েকমাস আগে তিনি একই দাগে প্রায় কয়েক বিঘা জমি কিনেছেন প্রায় কোটি টাকা দিয়ে। দুই তলা বিশিষ্ট বাড়িও করেছের নিজ গ্রামে। আর এ সবকিছুর উৎস অনলাইন জুয়া।
মাদার আলী ওরফে মাদার মাস্টার। তিনি কোমরপুরের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও সদর উপজেলার সাহেবপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কর্মরত। অথচ কোটি টাকা খরচ করে ২তলা বিশিষ্ট রাজপ্রাসাদ বানিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১০ থেকে ১২টি লাইনবেট সাইটের এজেন্ট তিনি। তিনি নিজেও এই লেনদেনের সাথে জড়িত এবং তার ছেলে অনিক ঢাকা থেকে তার এসকল লেনদেন করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ছেলে অনিক ঢাকায় বাসা ভাড়া করে অভিযাত জীবনযাপন করেন বলে জানা গেছে।
মাদার আলীকেও কয়েক মাস আগে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হয়েছিলো বলে পুলিশের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে। পুলিশ সুপারের নামে স্থানীয় অনলাইন এজেন্টদের কাছে টাকা তোলার অভিযোগ ছিলো তার বিরুদ্ধে।
এই তিনজনই স্থানীয় প্রভাবশালী এক নেতার সানিধ্য থেকে নিজেদের বড় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে দাবী করেন। এমনকি সুযোগ পেলেই জনপ্রতিনিধিদের সাথে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়ে নিজেদের জানান দেন। অভিযোগ রয়েছে তাদের নাম যেন কোন সংবাদে না আসে কয়েকজনকে সাংবাদিককেও মাসোহারা দিয়ে থাকেন।
আরও পড়ুন অনলাইন জুয়ার এজেন্ট প্রসেনজিতের সহযোগীদের আদালতে জবাবনবন্দী প্রদান
অপরজন, মুকুল ইসলাম। তিনি অনলাইন জুয়ার মূল হোতা। তিনি কোমরপুর গ্রামের ইজারুল ইসলামের ছেলে। তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি ইনকামের নেশায় মাহফুজুর রহমান নবাবের সাথে অনলাইন জুয়া খেলায় জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তিতে তার মাধ্যমে অনলাইন জুয়ার এজেন্ট চ্যানেল দিয়ে পুরো এলাকা অনলাইন জুয়ায় ছাপিয়ে দেন। বিভিন্ন জনের কাছে থেকে বিভিন্ন অংকের টাকা নিয়ে তিনি লাইনবেটের এজেন্ট বিক্রি করেন। এবং একই সঙ্গে নিজেও জুয়া খেলেন। অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন জনের কাছে থেকে তিনি চ্যানেল বিক্রির নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন কিন্তু অনেককেই চ্যানেল দিতে পারেননি। তিনি নিজেও জুয়া খেলে চ্যানেল বিক্রির টাকা নস্ট করে সর্বশান্ত হয়েছেন। অন্যান্যরা কোটিপতি হলেও তিনি জুয়ায় হেরে ধীরে ধীরে নি:স্ব হচ্ছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মেহেরপুর প্রতিদিনের অনুসন্ধান অব্যহত রয়েছে। অনুসন্ধানে ওই চারজনের বিরুদ্ধে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের সম্পদের হিসাব নিকাশও পাওয়া গেছে। আরো গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে। ধারাবাহিকভাবে অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িতদের তথ্য তুলে ধরবে মেহেরপুর প্রতিদিন। (চলবে..)
এ সংক্রান্ত আরো অনলাইন জুয়ার খপ্পরে মেহেরপুরের অর্ধশত তরুণ