একবারের ঘটনা, সাহাবী হযরত আবূ যর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে এক ব্যক্তির সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয়ে গেল। ক্রোধের আতিশয্যে আমি তাকে বলে বসলাম, হে কৃষ্ণকায় নারীর সন্তান! আমার একথা শুনে, রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, হে আবূ যর! ‘উভয় পাল্লা সমান। কৃষ্ণকায় নারীর সন্তানের উপর শ্বেতকায় নারীর সন্তানের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ আবূ যর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একথা শুনে আমি মাটিতে শুয়ে পড়লাম এবং লোকটিকে বললাম, তুমি আমার গন্ডদেশকে পদতলে পিষ্ট কর।
অন্যের চাইতে নিজেকে বড় মনে করাই অহংকার।
শরী’আতের পরিভাষায় অহংকার হচ্ছে, হককে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করা এবং কোনো বিষয়ে নিজেকে বড় মনে করে অন্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করা।
হককে প্রত্যাখ্যান করা অর্থ হককে অস্বীকার করা, হককে কবুল না করে তার প্রতি অবজ্ঞা করা এবং হক কবুল করা হতে বিরত থাকা।
মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা অর্থ মানুষকে নিকৃষ্ট মনে করা, অবজ্ঞা করা, তুচ্ছ মনে করা ও মানুষকে ঘৃণা করা। মানুষের গুণের থেকে নিজের গুণকে বড় মনে করা। কারো কোনো কর্মকে স্বীকৃতি না দেওয়া, কোনো ভালো গুণকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা না থাকা। অন্যদের সালাম না দেওয়া, কারো উপদেশ গ্রহণ না করা। নিজেকে অন্যের অপেক্ষা জ্ঞানী মনে করা। গরীব, মিসকিন, অসহায় ও দুর্বল লোকদের সাথে উঠা বসা করাকে ঘৃণার চোখে দেখা এবং তাদের ঠাট্টা-বিদ্রুপ, উপহাস এবং তিরস্কার করা। অন্যদের দোষ প্রকাশ ও তাদের দুর্বলতা বর্ণনা করা তথা চোগলখোরি ও গীবত করা। নিজেকে নির্দোষ, নিরপরাধ ও কামেল ব্যক্তি মনেকরে নিকৃষ্ট ও দোষণীয় কাজের ওপর অটুট থাকা এবং কারো উপদেশ গ্রহণ না করা। হাঁটার সময় তার সামনে কেউ হাঁটুক তা পছন্দ না করা, নিজেই আগে আগে হাঁটতে পছন্দ করা। অপরের দাঁড়িয়ে সম্মান করাকে পছন্দ করা।
ড. মুশফিক আহমেদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলতেন, অহংকারের মেজাজ হল, নিজেকে উপরে উঠানো এবং অন্যকে নীচে নামানো, অন্যকে নিজের থাবার মধ্যে আনা। যেমন বিড়াল যদি ইদুরকে পায় থাবা দিয়ে আহত করে এবং ছেড়ে দেয়। ইদুর আহত অবস্থায় আস্তে আস্তে গর্তের দিকে চলে। ঠিক গর্তে পৌঁছার পূর্ব মুহূর্তে বিড়াল আবার ইদুরকে ধরে এবং আছাড় দেয়। আগে ধরে না। সে মজা দেখে। ঠিক গর্তে ঢোকার পূর্ব মুহূর্তে ধরে। এটার মধ্যে সে আনন্দ পায়। অহংকারের মেজাজ ঠিক এধরনের। অন্যকে আঘাত করবে, অন্যকে অধিনস্থ রাখবে, নিজেকে উপরে উঠাবে, আর এটা দেখে সে আনন্দ পাবে।(মোজাকারা হতে)
অভিশপ্ত ইবলিসের কুফরী করা ও আল্লাহর আদেশের অবাধ্য হওয়ার একমাত্র কারণই ছিল তার অহংকার। সৃষ্টিজগতের প্রথম মানব আমাদের পিতা আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করার পর আল্লাহ তা’য়ালা ফেরেশতাদের আদেশ করেছিলেন-তোমরা আদমকে সিজদা কর। সকল ফেরেশতা সিজদায় লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু ফেরেশতাদের মাঝে বেড়ে ওঠা শয়তান মাটি আর আগুনের যুক্তি হাজির করল। সে আগুনের তৈরি বলে মাটির তৈরি মানুষকে সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানাল। কুরআনের ভাষায়: সে অস্বীকৃতি জানাল এবং অহংকার করল। আর সে ছিল কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত।(সূরা বাকারা;৩৪)
মহান আল্লাহ তা’য়ালা যদি ইবলিসকে বলতেন, আমাকে ১০০সিজদা কর, তাহলে ইবলিস ১০০ কেন ১ লক্ষ সিজদা করত। কিন্তু ইবলিস নিজেকে বড় মনে করল। সে অহঙ্কার করল যে, সে আদমের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
যখন কোনো মানুষের অন্তরে অহংকার ও বড়াই এর অনুপ্রবেশ ঘটে, তখন তা তার জ্ঞান, বুদ্ধির ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে এবং তাকে নানাবিধ প্রলোভন ও প্ররোচনার মাধ্যমে বাধ্য করে সত্যকে অস্বীকার ও বাস্তবতাকে প্রত্যাখ্যান করতে। অহংকারী ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন হতে বঞ্চিত হয়। অহংকারী ব্যক্তি কখনো কারো উপদেশ গ্রহণ করে না। সে মনে করে আমিতো কামিল ব্যক্তি আমার থেকে বড় আর কে হতে পারে? যে আমাকে উপদেশ দিবে। এছাড়াও সে কিভাবে মানুষের উপদেশ গ্রহণ করবে? সে নিজেই মানুষকে উপদেশ দিয়ে বেড়ায়। যে ব্যক্তি অহংকার করতে চায় ও বড়ত্ব দেখাতে চায় আল্লাহ তাকে নীচে ছুড়ে ফেলে দেন ও বেইজ্জত করেন। অহংকারীর নাম জাব্বারিনদের খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়। সর্বপরি হংকারীর আবাসস্থল হবে জাহান্নাম। রসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যার অন্তরে সরিষার দানা (অর্থাৎ সামান্য তম) পরিমাণও অহংকার আছে, সে (প্রথম পর্যায়েই) জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না এবং যার অন্তরে সরিষার দানা (সামান্যতম) পরিমাণ ঈমান আছে সে জাহান্নামে (স্থায়ীভাবে) প্রবেশ করবে না।’(মুসলিম)
অহংকার ও বড়াই মানবাত্মার জন্য খুবই ক্ষতিকর ও মারাত্মক ব্যাধি, যা একজন মানুষকে হেদায়াত ও সত্যের পথ থেকে দূরে সরিয়ে ভ্রষ্টতা ও গোমরাহির পথের দিকে নিয়ে যায়। ইসলামে অহংকারকে হারাম করা হয়েছে। এজন্য আমাদের সকলেরই উচিৎ এই ব্যাধির চিকিৎসায় সচেষ্ট হওয়া।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সকলকে অহংকার হতে বেঁচে থাকার তৈফিক দান করুন। আমিন।
লেখক:
বয়োকেমিস্ট, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রনালয়, খুলনা।