মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথের স্মৃতিবিজড়িত স্থান মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার মুজিবনগর। স্বাধীনতার ৫০ বছরে মুজিবনগরে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র, ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্যর স্বাধীনতা সড়ক বাস্তবায়ন হয়েছে। ঘোষনায় রয়েছে সম্ভাব্য চেক পোস্ট, মুজিবনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন এবং নতুন করে এক হাজার কোটি টাকার বরাদ্দের আন্তর্জাতিক মুক্তিযুদ্ধ পর্যটন কেন্দ্রের । স্বাধীনতার এই পিঠস্থান তেমন কিছুই পাইনি। যা নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে এলাকাবাসীর।
৮০ একর জমি অধিগ্রহণ করে প্রায় তিনশ কোটি টাকা ব্যয়ে বৈদ্যনাথতলায় নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র। নতুন করে আরো ১ হাজার কোটি টাকা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে আন্তজার্তিক মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য। তবে নির্মিত বেশ কিছু স্থাপনায় ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে।
প্রকল্পের মধ্যে ৪৭ কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর ভিত্তিক বাংলাদেশ মানচিত্র নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়নি। মানচিত্রে পুরো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন চিত্র ফুটে উঠলেও মুজিবগরের শপথ নেওয়ার কোন চিত্র সেখানে স্থান পায়নি।
মানচিত্রের বাইরে নির্মিত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ভাস্কর্যসহ অন্যান্য ভাষ্কর্যগুলো অতি নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে তৈরি এবং মূল নকশা অনুযায়ী না হওয়ায় সেগুলো ভেঙে ফেলে নতুন করে তৈরি করার জন্য আরো তিন কোটি টাকার প্রকল্প পাশ করা হয়েছে।
মানচিত্রের বাইরে নির্মিত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ভাস্কর্যসহ অন্যান্য ভাস্কর্যগুলো এতটাই নিম্ম মানের যা মাঝে মধ্যেই ভেঙ্গে পড়ে। অনেকগুলোর ভেতরের রডের বদলে চিকন তার দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে শিলাবৃষ্টি বা ঝড় হলে সেগুলো ভেঙে যায়। কয়েকদফা সেগুলো পুনরায় রিপিয়ারিং করাও হয়েছে। এছাড়া প্রতিবছর ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসকে ঘিরে রিপিয়ারিংসহ পালিশ করে দৃষ্টিনন্দন করে তোলা হয়। তবে করোনা অতিমারির কারণে গত দুই বছর ধরে সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন অনুষ্ঠান না করায় সেটিও বন্ধ রয়েছে।
কমেপ্লক্সে ছাড়াও ঐতিহাসিক আম্রকাননের অনেকগুলো গাছ পরিচর্যার অভাবে মারা গেছে। ওই স্থলে নতুন কোন গাছ রোপন করাও হয়নি। বাগানটি ঘুরে দেখা গিয়েছে প্রায় ১০ থেকে ১২টি গাছ মরে। সম্প্রতি শেখ হাসিনা মঞ্চ সংলগ্ম দুটি আম গাছ ছিল যে গুলো মারা যাওয়ার কারণে কেটে ফেলা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানের করে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের স্থান, ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের স্মৃতি, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা সমৃদ্ধ তথ্য ও নিদর্শন দেশবাসী ও তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং বিদেশীদের কাছে মূর্ত করে তুলতে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে স্মৃতিকেন্দ্র নির্মান করা হয়েছে । অথচ উদ্বোধনের আগেই নষ্ট হয়ে যাওয়াতে পর্যটকরা আহত হচ্ছেন।
মেহেরপুর গণপূর্ত বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৮ সালে কাজ শুরু করে মাঝে প্রকল্প কাটাছেড়া করা হয়। ফলে কাজটি শেষ হয় ২০১১ সালে। অতিনিম্নমানের কাজ হবার কারণেই ভাষ্কর্যগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। প্রকল্পর অন্যান্য কাজ এখনও অসমাপ্ত আছে।
স্বাধীনতা সড়ক
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগদিতে ভারতের কলকাতা থেকে যে মেঠোপথ ধরে জাতীয় চার নেতাসহ দেশ-বিদেশের সাংবাদিকরা এসেছিলেন সেই মেঠপথটিকে স্বাধীনতার অর্ধশত বছর উৎযাপন উপলক্ষে বর্তমান সরকার ‘স্বাধীনতা সড়ক’ নামে নামকরণ করেছেন। ওই মেঠপথটির বাংলাদেশের অংশ ৫০০ মিটার কোটি ৪ লাখ টাকা ব্যায়ে ইতিমধ্যে পাকাও করা হয়ে গেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে এটি উদ্বোধন করেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী।
মুজিবনগর কমপ্লেক্সে যা আছে:
১১টি মন্ত্রনালয়ের প্রায় ৩’শ কোটি টাকা বরাদ্দে গড়ে উঠেছে মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্র । এর মধ্যে পর্যটক মোটেল, শপিংমল, শিশু পরিবার, ডাকঘর, হেলিপ্যাড, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, ছয় দফা ভিত্তিক মনোরম গোলাপ বাগান, অত্যাধুনিক মসজিদ, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বাংলাদেশের মানচিত্র ও জাদুঘর। এখন পর্যন্ত এসব কোন স্থাপনাই আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়নি। অথচ প্রকল্পের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ধাপের কাজ শেষ হয়েছে অন্তত ১০ বছর আগে। সবশেষে সাড়ে আট কোটি টাকা ব্যয়ে বড় মিলনায়তন নির্মাণের কাজও শেষ হয়েছে।
তবে এখনো প্রশাসনিক প্লাজা, অ্যাপ্রোচ রোড, বিদ্যুৎ, জেনারেটর ক্রয় (১০০-কেভিএ), মানচিত্রে স্টেজে কাঠের কাজ, সিঁড়িতে এসএস রেলিং, জলছাদ র্যাম্প ও এসপিএমসিবি পাওয়ার সকেট, আন্ডার গ্রাউন্ড সার্ভিস লাইন কাজ আজও শেষ হয়নি।
নতুন করে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষনা হয়েছে। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক পর্যটন এলাকা গড়ে তোলা হবে। চারপাশ দিয়ে দৃষ্টিনন্দন লেক তৈরি করা হবে। বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতিচিহৃ তৈরি করা হবে।
মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বাগোয়ান ইউপি চেয়ারম্যান আয়ুব হোসেন বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার তীর্থ স্থান মুজিবনগরের উন্নয়ন নিয়ে আমি সন্তুষ্ট নই। এখানে অনেক কিছু ঘোষনা হয়েছে কিন্তু দৃশ্যমান হয়নি। স্বাধীনতা সড়ক ও চেক পোস্টের দৃশ্যমান চাই। রেল লাইন ঘোষনা হয়েছে এখনো দৃশ্যমান হয়নি। নতুন করে মুজিবনগর কমপ্লেক্স এর জন্য ১০০০ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প ঘোষনা হয়েছে। প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে কিন্তু এখনো দৃশ্যমান কিছু হয়নি। মুজিবনগরবাসী হিসেবে এই প্রকল্পগুলোর দৃশ্যমান বাস্তবায়ন আশা করি।
এ বিষয়ে মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ড. মোহাম্মদ মুনসুর আলম খান বলেন, স্মৃতিকেন্দ্রের কাজটি প্রকল্পভুক্ত কাজ। এখনো বেশ কিছু কাজ বাকি রয়েছে। নুতন করে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব হয়েছে। যা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রকল্পের ডিজাইন করা হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন লেকসহ আন্তর্জাতিক মানের মুক্তিযুদ্ধ পর্যটন এলাকা গড়ে তোলা হবে। যাতে করে পর্যটকরা মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গবেষণা করতে পারে। এছাড়া করোনা মহামারির কারণে মুজিবনগর দিবসের অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে।
এবারের কর্মসূচী
সকাল ৬টায় মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে জাতীয় পতাকা উত্তোলন স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষথেকে, সকাল ১১ টায় জাতীয় সংসদের হুইপ ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এমপি এবং জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফরহাদ হোসেন এমপি মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করবেন। এছাড়া সন্ধ্যা ৭টার সময় বর্ণিল আঁতশবাজি উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।