তাদের বাণিজ্যপথের মাধ্যমে নাবাতিয়ান আরবি ভাষা ও এই রূপান্তরিত আরামাইক লিপি আরব উপদ্বীপের পশ্চিম উপকূলে হিজাজ (বর্তমানে ইসলামের পবিত্র নগরী মক্কা ও মদিনা এই হিজাজ অঞ্চলে অবস্থিত) হয়ে ইয়েমেন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
যা-ই হোক, প্রথমে নাবাতিয়ান বাণিজ্যের প্রভাবে এবং পরে ইসলামের প্রসারের সাথে সাথে সারা আরব উপদ্বীপেই ধীরে ধীরে আরবি ভাষা ছড়িয়ে পড়ে, এবং আগের প্রাচীন ভাষাগুলোর ব্যবহার কমতে কমতে এককালে হারিয়ে যায়। প্রধান ব্যতিক্রম থেকে যায় নাবাতিয়ান রাজ্য থেকে দূরতম প্রান্তে অবস্থিত ইয়েমেন ও ওমান সীমান্তে হাজরামাউত ও জুফার অঞ্চল, যেখানকার আঞ্চলিক ভাষা তখনও আরবি ছিল না।
৩২৯ খ্রিষ্টাব্দে দামেস্কের ১২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে আন-নামারাতে আরেকটি শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়। এই শিলালিপির ভাষাটি প্রায় শাস্ত্রীয় আরবির মতোই। যদিও এই শিলালিপিগুলো স্পষ্টতই আরবি ভাষায় লেখা, এগুলো আরবি লিপিতে লেখা নয়, বরং এটি নাবাতিয়ান লিপি, যা আরামাইক লিপি থেকে এসেছে।
কিন্তু কিছু শিলালিপি খ্রিষ্টীয় ৪র্থ এবং ৫ম শতাব্দীরও রয়েছে, যেগুলো আরবি ভাষার মতো একটি লিপিতে লেখা। সাধারণত মনে করা হয় যে, আরবি লিপি নাবাতিয়ান লিপি থেকে বিকশিত হয়েছে, এবং এই শিলালিপিগুলো একটি স্ক্রিপ্ট বা লিপিতে লেখা হতে পারে যেটি এই দুটির মধ্যে হতে পারে। এই শিলালিপিগুলো মূলত উত্তর আরবের ছিল।
অন্যদিকে, দক্ষিণ আরবীয়রা তাদের বাণিজ্যিক আদান-প্রদান, ঐতিহাসিক ঘটনাবলি ও সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়কে লিপিবদ্ধ করার জন্য যে ধরনের উপাদান ব্যবহার করত, তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। এই ধরনের শিলালিপির প্রাচীনতম নিদর্শনগুলোর বয়স খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম ও নবম শতক।
এই লিপিগুলো লেখা হতো একবার বাঁ দিক থেকে ডান দিকে, পরের লাইন ডান থেকে বাঁ দিকে। এই লিপিগুলো থেকে জানা যায় যে, দক্ষিণ আরবীয় বা মিনীয়-সাবিয়ান ভাষার (হিময়ারাইট নামেও পরিচিত) বর্ণমালাতে ২৯টি অক্ষর ছিল যা আধুনিক আরবি বর্ণমালাতেও দেখা যায়। বর্ণগুলোর আকার ছিল অনেকটা কাঁটাওয়ালা আঁকশি বা কুড়ুলের মতো।
এগুলো এসেছিল সিনিয় বর্ণমালা থেকে, যেটি আবার ফিনিশিয় ও মিশরীয় বর্ণমালার পূর্বসূরির মধ্যে যোগসূত্র গড়ে তুলেছিল। এই সমস্ত সুসামঞ্জস্য অক্ষরগুলো একটি দীর্ঘ উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করে।
অন্যান্য সেমিটিয় বর্ণমালার মতো এর বর্ণমালাতেও কেবলমাত্র ব্যঞ্জনবর্ণেরই অস্তিত্ব ছিল। বিশেষ্য পদ গঠনে, ক্রিয়ার ধাতুরূপ, ব্যক্তিবাচক সর্বনাম ও শব্দভাণ্ডারের বেশ কিছু ক্ষেত্রে আক্কাদিয়ান (অ্যাসিরো-ব্যাবিলনিয়ান) ও ইথিওপীয় ভাষার সঙ্গে দক্ষিণ আরবীয় ভাষার মিল লক্ষ্য করা যায়।
আবার, এই ভাষার মধ্যে ভাঙা-ভাঙা বহুবচন লক্ষ্য করা যায় যা উত্তর আরবীয় ও ইথিওপীয় ভাষার বৈশিষ্ট্যকেই প্রতিফলিত করে। আক্কাদিয়ান, দক্ষিণ আরবীয় ও ইথিওপীয় ভাষা কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরনো সেমিটিক ভাষার বৈশিষ্ট্যকেই প্রতিফলিত করেছে। ইয়েমেন সংস্কৃতি ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ আরবীয় ভাষার বিলুপ্তি ঘটে, আর এই স্থান দখল করে নেয় উত্তর আরবীয় ভাষা। উত্তর আরবে ‘উকাজ’-এর মতো সাহিত্য মেলা, কাবায় বার্ষিক হজ্বযাত্রা ও মক্কার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
আরবে ইসলাম আগমনের আগে, উপদ্বীপের চারপাশে আরবি ভাষার অসংখ্য উপভাষা প্রচলিত ছিল। তবে ‘কোইন’ নামে একটি সাধারণ সাহিত্যিক ভাষাও ছিল কবিতার জন্য, যা বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে ব্যবহৃত হতো। সাহিত্যিক ভাষা কোইনে লেখা কবিতার অংশগুলো ক্লাসিক্যাল বা ধ্রুপদী আরবি ভাষার প্রাচীনতম উদাহরণ।
ধ্রুপদী আরবি সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হলো ‘মুআল্লকাত’ নামক কবিতা সংকলন। আরব পণ্ডিতদের মতে, ইসলামি যুগের আগে তদানীন্তন প্রাক-ইসলামি কবিদের লেখা সেরা সাতটি দীর্ঘ কবিতা সংগ্রহ করে একে একত্রে সংকলন করা হয়। এই প্রাক-ইসলামি কবিদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ইমরুল-কায়েস, যিনি খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধে জীবিত ছিলেন। পরবর্তী যুগে আরবি ব্যাকরণবিদরা যে ভাষাকে ‘আরাবিয়্যা’ নাম দিয়ে প্রমিত আরবি হিসেবে গ্রহণ করেন, তার প্রথম নিদর্শন এই কবিতাগুলো। কুরআন পাঠে যে আরবি উচ্চারণ ও ব্যাকরণ ব্যবহার হয়, সেটিও এই প্রমিত আরবির উদাহরণ।
তাই বলা যায়, ধ্রুপদী আরবি, যেটি ৬ষ্ঠ শতক থেকে প্রচলিত হয়, সেটাতেই পবিত্র কুরআন লেখা হয়েছে। কুরআন লেখার সময় ধ্রুপদী আরবি ভাষার সাতটি উপভাষা ছিল, যার সবকটিতেই কুরআন লেখা হয়েছিল। কিন্তু কুরাইশ সংস্করণটি সেই মানদণ্ড হয়ে উঠেছে, যার উপর ভিত্তি করে আজকের কুরআন পঠিত হয়।
পার্থক্যগুলো উচ্চারণে; শব্দভান্ডার বা ব্যাকরণে নয়। কুরআনের আরবি প্রাক-ইসলামিক ধ্রুপদী আরবি কবিতার অনুরূপ, তবে সম্পূর্ণভাবে নয়। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনের শুরু থেকে অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত, ইসলামি সাম্রাজ্যের বিজয় আরবি ভাষাকে নতুন নতুন দূরবর্তী দেশে ছড়িয়ে দেয়। ইসলামি সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির পর আরবি ভাষাকে মানসম্মত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। কারণ, বিপুল সংখ্যক মানুষ এই ভাষা ব্যবহার শুরু করেছিল। যার কারণে একে আরও ব্যবহারিক করা হয়, নতুন শব্দভাণ্ডার তৈরি করা হয়, এবং গদ্যের ব্যাকরণ ও গদ্যশৈলী প্রমিত করা হয়।
সব সেমিটিক ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ব্যাঞ্জনবর্ণ দিয়ে গঠিত শব্দমূল। সাধারণত তিনটি ব্যাঞ্জনবর্ণ নিয়ে গঠিত হয় একটি মূল শব্দ, যাদের একটি মূল অর্থ থাকে। তারপর স্বরবর্ণ যোগ করে বা উপসর্গ, মধ্যসর্গ আর অন্তঃপ্রত্যয় বসিয়ে এই মূলকে বিভিন্নভাবে পরিবর্তন করে বিভিন্ন কাছাকাছি অর্থের শব্দ তৈরি করা হয়। উদাহরণস্বরূপ আরবি ‘সালিম’ মূলটি দেখা যাক। এর অর্থ ‘নিরাপদ’। মূল শব্দের সাথে স্বরবর্ণ বা উপসর্গ, মধ্যসর্গ আর অন্তঃপ্রত্যয় যোগ করে আমরা পাই: সালামুন (যার অর্থ শান্তি), মুসলিমুন (যার অর্থ মুসলিম)। আবার ‘কিতাব’ দেখি, যার অর্থ ‘বই’। এ থেকে পেলাম কুতুবি (যার অর্থ বই বিক্রেতা), মক্তব (যার অর্থ প্রাথমিক বিদ্যালয়)। আর এভাবেই আরবি ভাষার বিভিন্ন শব্দভাণ্ডার তৈরি হয়েছে।
যখন লিখিত ভাষা হিসেবে ধ্রুপদী আরবি প্রমিত হচ্ছে, আরব সাম্রাজ্যের শহরগুলোতে আরবি ভাষার স্থানীয় উপভাষাগুলোও আবির্ভূত হয়। এই উপভাষাগুলো সরাসরি ধ্রুপদী আরবি থেকে আসেনি, বরং প্রাক-ইসলামিক আরবি উপভাষা ‘কোইন’ থেকে এসেছে। লেভান্ট এবং মেসোপটেমিয়ার উপভাষাগুলো আরামাইক দ্বারা, মাগরেবের উপভাষাগুলো বারবার (Berber) দ্বারা, মিশরের উপভাষাগুলো কপ্টিক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।
এই নতুন উদীয়মান উপভাষাগুলোর প্রথম শতাব্দীকে নিও বা নব্য-আরবি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যদিও ধ্রুপদী আরবি প্রমিত ছিল, সবাই এটি নিখুঁতভাবে লিখতে পারত না। ক্লাসিক্যাল আরবি এবং নব্য-আরবি বা এর উপভাষা উভয়ের বৈশিষ্ট্য ধারণ করা লেখাকে মিডল বা মধ্য আরবি ভাষা বলা হয়।
‘মিডল’ কোন সময়কে বোঝায় না, বরং এই আরবি ক্লাসিক্যাল এবং নব্য-আরবির কথোপকথনের মধ্যবর্তী ভাষা ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিও আরবি উপভাষাটি (যেটি আধুনিক) আধুনিক আরবিসহ কথোপকথন উপভাষায় বিকশিত হতে থাকে, কিন্তু সাহিত্যিক আরবি তুলনামূলকভাবে স্থির ছিল, কারণ কুরআনের আরবিকে সর্বদাই আদর্শ হিসেবে দেখা হতো।
আদর্শ আরবি অনুসরণ করার জন্য এটি সম্ভবত উপভাষার উপর রক্ষণশীল প্রভাব ফেলেছিল, এবং এই কারণে নেপোলিয়ন মিশরে প্রবেশের পরেও তাদের মধ্যে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি।
মধ্যযুগের প্রথমদিকে আরবি ভাষা ছিল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সংস্কৃতির প্রধান বাহন। এটি বিশেষ করে বিজ্ঞান, গণিত এবং দর্শনে বহুল ব্যবহৃত হতো। ফলে ইউরোপের দেশগুলোর অনেক ভাষাও আরবি থেকে প্রচুর শব্দ ধার করেছে।
ইউরোপের খ্রিস্টান ও আরবের মুসলিম সভ্যতার নৈকট্য এবং দীর্ঘস্থায়ী মুসলিম সংস্কৃতি ও আরবি ভাষার উপস্থিতির কারণে স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, কাতালান এবং সিসিলিয়ান শব্দভাণ্ডারে আরবি শব্দ দেখা যায়।
উদাহরণস্বরূপ, ‘আলজেবরা’ বা ‘বীজগণিত’ আরবি শব্দ ‘আল-জাবর’ থেকে এসেছে। মাল্টিজ বা মাল্টার ভাষা হলো একটি সেমিটিক ভাষা, যা আরবি ভাষার একটি উপভাষা থেকে এসেছে এবং এটি ল্যাটিন বর্ণমালায় লেখা হয়। গ্রীক এবং বুলগেরিয়ানসহ বলকান রাষ্ট্রের ভাষাগুলোও অটোমান তুর্কিদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে আরবি ভাষার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শব্দ অর্জন করেছে।
১৭৯৮ সালে আরব বিশ্ব প্রথমবারের মতো পশ্চিমা বিশ্বের সাথে যোগাযোগের বৃহত্তর যুগে প্রবেশ করে এবং নতুন পশ্চিমা ধারণাগুলো প্রবাহের জন্য আরবি ভাষাকে বিংশ শতকের গোড়ার দিকে আধুনিকায়ন করার প্রয়োজনিয়তা অনুভব করে। ফলশ্রুতিতে আরবি ভাষার আঞ্চলিক একাডেমিগুলো ভাষার একটি সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করে। সংস্কার প্রক্রিয়াটি প্রধানত ভাষার শব্দভান্ডার সম্প্রসারণ এবং ভাষাকে আধুনিক করা নিয়ে ব্যাপক কাজ করে। সংস্কার প্রক্রিয়ার পর আরবি ভাষা আধুনিক স্ট্যান্ডার্ড আরবি হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।
বিশ্বজুড়ে আরবি ভাষা অন্যান্য অনেক ভাষাকে প্রভাবিত করেছে, বিশেষ করে মুসলিম সংস্কৃতি এবং মুসলিমরা যেসব দেশ জয় করেছিল সেগুলোর ভাষাকে। সর্বাধিক প্রভাবিত ভাষার মধ্যে কয়েকটি হলো ফার্সি, তুর্কি, হিন্দি, উর্দু, কাশ্মীরি, কুর্দি, বসনিয়ান, কাজাখ, বাংলা, মালয় (ইন্দোনেশিয়ান এবং মালয়েশিয়ান), মালদ্বীপ, পশতু, পাঞ্জাবি, আলবেনিয়ান, আর্মেনিয়ান, আজারবাইজানীয়, সিসিলিয়ান, স্প্যানিশ , গ্রীক, বুলগেরিয়ান, তাগালগ, সিন্ধি, ওড়িয়া, হিব্রু, হাউসা, এবং আফ্রিকার কিছু কিছু ভাষা, যেমন: সোয়াহিলি, সোমালি। বিপরীতে, অন্যান্য ভাষা থেকেও আরবি ভাষায় শব্দ এসেছে, যার মধ্যে রয়েছে আরামাইক, হিব্রু, ল্যাটিন, গ্রীক, ফার্সি এবং কিছুটা তুর্কি (উসমানী সাম্রাজ্যের কারণে), ইংরেজি এবং ফরাসি (লেভান্টে তাদের উপনিবেশের কারণে) এবং অন্যান্য সেমিটিক ভাষা, যেমন- আবিসিনিয়ান।
আরবি বর্ণমালা লেখা হয় ডান দিক থেকে বাম দিকে। এই বর্ণমালাগুলো নাবাতিয়ানের মাধ্যমে আরামাইক থেকে উদ্ভূত হয়েছে। সাধারণ লেখার পাশাপাশি আরবি বর্ণমালার অনেকগুলো লিখনশৈলী বিকশিত হয়েছিল।
এদের মধ্যে অন্যতম ও সুন্দর একটি লিখন পদ্ধতি হলো আরবি ক্যালিগ্রাফি। পবিত্র কুরআন ও অন্যান্য বই লেখার জন্য, এবং মসজিদ, মাজার বা ইসলামের স্মৃতিসৌধের শিলালিপিগুলোর সজ্জা হিসেবে আরবি ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার দেখা যায়। এই ক্যালিগ্রাফিগুলো কুরআনের একটি আয়াত বা একটি হাদিস বা আরবিতে লেখা যেকোনো বিমূর্ত আর্ট বা শৈল্পিক নকশা হতে পারে।
ক্যালিগ্রাফিগুলো বেশ মনোমুগ্ধকর হয় বলে বিভিন্ন ডিজাইন হিসেবে এগুলোর ব্যবহার চোখে পড়ে। সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে এসব ক্যালিগ্রাফির বিশ্বজোড়া ব্যাপক কদর রয়েছে।
সংকলনেঃ এম.এ.এস ইমন
প্রকাশক, দৈনিক ‘মেহেরপুর প্রতিদিন’