কৃষিপ্রধান বাংলাদেশ এখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিশ্ববাজারেও কৃষিপণ্য রপ্তানির সম্ভাবনা দেখছে। এরই মধ্যে জয় করেছে প্রতিবেশী দেশ ভারত, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং মধ্যপ্রাচ্যের বাজার।
বিশ্বব্যাপী করোনার মহামারির প্রভাবের মধ্যেও গত (২০২০-২১) অর্থবছরে ১০০ কোটি ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে কৃষিপণ্য। চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) আয় করেছে প্রায় ৫৬ কোটি ডলার। প্রতি ডলার ৮৭ টাকা ধরে বাংলাদেশি মুদ্রায় তা দাঁড়ায় চার হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। এই আয় আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছরে ১১০ কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত সময়ের আগেই পূরণ করা সম্ভব হবে। এ নিয়ে দেশের উদ্যোক্তা ও সরকারের নীতি-নির্ধারকরা আরো বড় স্বপ্ন দেখছেন। তাঁরা জানান, দেশের কৃষিপণ্যের উন্নয়নে সম্প্রতি যুক্তরাজ্য এবং নেদারল্যান্ডস সফর করেছে সরকারি-বেসরকারি একটি প্রতিনিধিদল। এ সময় কৃষিপণ্য নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সুপারশপ সেইন্সবারি ও টেসকো। এ ছাড়া বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃষিপণ্য রপ্তানিকারক দেশ নেদারল্যান্ডসের একটি কারিগরি দল সহায়তা দিতে আগামী মার্চ মাসে আসছে বাংলাদেশে।
রপ্তানিকারকরা মনে করেন অবকাঠামোগত সহায়তা পাওয়া গেলে আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে কৃষিপণ্যে রপ্তানি দিগুণ করা সম্ভব। দেশের কৃষিপণ্যের বিশ্ববাজারের সম্ভাবনার কথা জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে কৃষিপণ্য রপ্তানি বাড়াতে সরকার নানা ধরনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সম্ভাবনা যাচাই ও জ্ঞান অর্জনে সরকারি-বেসরকারি একটি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাজ্য সফর করেছে। সেখান থেকে ইতিবাচক সারা মিলেছে। এ প্রেক্ষাপটে আগামী বছর মার্চ মাসে ডেনমার্কের একটি কারিগরি প্রতিনিধিদল আসছে বাংলাদেশে। এই প্রতিনিধিদল দেশের কৃষি আধুনিকায়ন, প্রযুক্তি সহায়তা, উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি, সংরক্ষণ ও বিপণন বাড়াতে সহায়তা করবে।’
সরকার দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে উল্লেখ করে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ এখনো গ্রামে বাস করছে। তাদের আয় বাড়াতে, কৃষিপণ্য রপ্তানি বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ২০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া হয়। ভর্তুকি দেওয়া হয় সারে। এ ছাড়া দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে শাক-সবজি, ফল দেশের বাইরে যায়। বাড়ছে কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের রপ্তানি বাজার। এর পরও সরকার চায় কৃষির সঙ্গে জড়িত মানুষদের আয় বাড়াতে।’
রপ্তানিকারকরা জানান, কৃষিপণ্য রপ্তানিতে নানা ধরনের সমস্যা সমাধানে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে ঠিক, কিন্তু বিমানবন্দরে কার্গো সমস্যা, কৃষিপণ্য সংরক্ষণ বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাঁদের। এ ছাড়া দক্ষ জনশক্তি এবং বিশ্বমানের স্বীকৃত মানসনদের সমস্যা তো আছেই।
এ বিষয়ে সবজি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবলস এলাইড প্রডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফভিএলপিইএ) সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘ক্রেতার চাহিদা অনুসারে পণ্য রপ্তানি করা হলেও সব পণ্যের ল্যাব নেই বাংলাদেশে। এ জন্য কিছু কিছু পণ্যে গুজরাট এবং সিঙ্গাপুর থেকে মান পরীক্ষা করে আনা হয়। এ ছাড়া সরকার আন্তরিক হলেও সিভিল এভিয়েশনে কর্তৃপক্ষের সুনজর কম।’ তিনি বিমানবন্দরে স্ক্যানার সমস্যার স্থায়ী সমাধান এবং কার্গো বিমানে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পচনশীল পণ্য পরিবহন করার একটি নীতিমালা করার দাবি জানান।
স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের চিফ অপারেটিং কর্মকর্তা পারভেজ সাইফুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কৃষি খাতের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে অংশীদারি বাড়ছে। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ, একই সঙ্গে নেদারল্যান্ডসও কৃষিতে বিশ্ববাজারের বড় অংশীদার। এই অংশীদারির ফলে বাংলাদেশের উৎপাদন থেকে দক্ষতা উভয় ক্ষেত্রে লাভবান হবে। দেশটির প্রযুক্তি সহযোগিতা নেওয়া গেলে পেঁয়াজ, টমেটো এবং আলুসহ কৃষিপণ্য দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব। আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে ২০০ কোটি ডলারের কৃষিপণ্য রপ্তানি করে আয় করা সম্ভব।’
অ্যাগ্রো ফুড প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইকতাদুল হক বলেন, ‘দেশের কৃষিজাত পণ্যের একটি অংশ ভারতের সেভেন সিস্টারস এলাকায় যায়। এই অঞ্চলে মোট রপ্তানির ১৫-২০ শতাংশ যায়। তবে ভারতের কিছু অশুল্ক বাধা (নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার) আছে। এসব বাধা দূর করা গেলে আরো ৫-১০ শতাংশ রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব।