মেহেরপুরের বিভিন্ন ইটভাটায় প্রচলিত আইনের তোয়াক্কা না করে অবাধে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। ফলে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি বিভিন্ন রোগ সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই ইটভাটাগুলো। জেলা ও জেলার বাইরের বনাঞ্চলের গাছ ধ্বংস করে লাখ লাখ টন কাঠ পোড়ানো চলছে ভাটাগুলোতে।
পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়াই শুধুমাত্র ট্রেড লাইসেন্স দিয়েই চলছে এসব ইটভাটা। এতে ক্ষতির মুখে পড়ছে পরিবেশের ভারসাম্য। উজাড় হচ্ছে বনজ সম্পদ।
সরকারি হিসেবে জেলায় ছোট বড় মিলিয়ে ১১৪টি ইটভাটা রয়েছে। এদের বেশিরভাগেরই অনুমোদন নেই। অবৈধভাবে গড়ে উঠা ৮০ ভাগ ইটভাটায় কয়লার পরিবর্তে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানোর প্রস্তুতি চলছে। অনেকে ভাটার ভেতরেই ভ্রাম্যমাণ স’মিল বসিয়ে কাঠ চেরাই করে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে। এসব ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো বন্ধে প্রশাসন বা পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো নাজরদারি নেই।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ইটভাটা তৈরি করতে কমপক্ষে ৬ একর জমির প্রয়োজন হয়। ইটভাটার মালিকরা জমির মালিকদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে নিচ্ছে। এতে ফসলি জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। কমে যাচ্ছে উৎপাদন ক্ষমতা।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩ এর ১৬ ধারায় বলা আছে, কোন ব্যক্তি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করেন, তাহলে তিনি অনধিক তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
সদর উপজেলার বন্দর গ্রামের ফয়সাল আহমেদ বলেন, প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গলী দেখিয়ে ইটভাটার মালিকরা কাঠ পোড়াচ্ছে। অধিকাংশ ইটভাটাগুলো রাস্তার পাশেই। ভাটার ধোঁয়া ও ধুলায় আমাদের চলাচল করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। ভাটার মাটি বহনের সময় রাস্তা ভেঙে যাচ্ছে।
এছাড়া একটু বৃষ্টি হলেও সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। নানামুখি সমস্যা তৈরি করছে ইটভাটাগুলো।
মেহেরপুর সদর উপজেলার বারাদির এসএস ব্রিকসের মালিক সেলিম হোসেন মোল্লা জানান, ভাটায় আগুন দিতে তিন থেকে চারশ মন কাঠ লাগে। কিন্তু জিগজাগ ভাটা (হাওয়া ভাটা) তৈরি করতে ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। কাঠ পোড়ানোর ফিক্সড চিমনির ভাটা ২৫ লাখ টাকা হলেও তৈরি করা সম্ভব। যে কারণে ফিক্সড চিমনির সংখ্যা বেশি।
মেহেরপুর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, কাঠ পোড়ানোর ফলে ইটভাটার নির্গত কালো ধোয়ায় মানুষের হাঁপানি, শ^াসকষ্ট, ফুসফুসের ক্যানসারসহ নানা রোগের সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও অতিরিক্ত কার্বনডাই অক্সাইডের কারণে মাঠের ফসল ও এলাকার পরিবেশ দূষণ হয়। শিশু ও বয়স্কদের জন্য এই দূষণ খুবই ক্ষতিকর। করোনা কালে কাঠপোড়ানোকে একেবারেই বন্ধ করা উচিৎ।
সামাজিক বনায়ন নার্সারি ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র মেহেরপুরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাফর উল্লাহ বলেন, আমরা ভাটা মালিকদের কাঠ পোড়াতে নিষেধ করেছি। তবে কাঠ পোড়ানোর বিষয়টা পরিবেশ অধিদপ্তরের। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ স’মিল বসিয়ে কাঠ চেরাই করলে অবশ্যই সেটা বাজেয়াপ্ত করব।
পরিবেশ অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আতাউর রহমান বলেন, গত বছর আমাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ছিল না তাই আমরা তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারিনি। এবার আমাদের নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট আছে। কোনো ভাটাতেই কাঠ পোড়াতে দেব না আমরা। খুব শিগগির অভিযান পরিচালনা করব।
মেহেরপুর জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ মুনসুর আলম খান বলেন, ভাটায় আগুন দেওয়ার জন্য কিছু কাঠ পোড়ানোর আবেদন করেছিল ভাটা মালিকরা। তবে এর থেকে অতিরিক্ত কাঠ পোড়ালে আপনাদের সঙ্গে নিয়ে অভিযান চালিয়ে কাঠ পোড়ানো বন্ধ করা হবে।
শৈলকুপা প্রতিনিধি জানান, ঝিনাইদহের শৈলকুপায় ইটের ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। এ যেন দেখার কেউ নেই, হাজার হাজার মণ কাঠ পাহাড়ের মত উঁচু করে রেখে একে একে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। শৈলকুপা উপজেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ২২টির মত ইট ভাটা, এর মধ্যে ৪টি ইট ভাটায় ড্রাম চিমনি রয়েছে, বাকিগুলো ফিক্সড চিমনির। শৈলকুপায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পায়নি কোনো ইটভাটা।
এসব ভাটায় প্রতিদিন আনুমানিক দেড় হাজার মণ কাঠ পুড়বে বলে জানা গেছে। সরোজমিন ঘুরে দেখা যায়, ইট ভাটার মৌসুম শুরু হওয়ায় কাঠ পোড়ানোর প্রতিযোগীতায় নেমেছে ভাটা মালিকরা। উপজেলার প্রতিটি ভাটায় প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ মণ কাঠ পোড়ানো হয়ে থাকে। এভাবে প্রতিদিন কাঠ পুড়তে থাকলে পরিবেশের উপর মারাত্বক প্রভাব পড়বে জেনেও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্তা ব্যক্তিরা উদাসীন। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রকাশ্যে কিভাবে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে তা নিয়ে জনমনে নানান প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
ভাটা মালিক আঃ মান্নান জানান, একটি ভাটায় জ্বালানি হিসেবে প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ মণ কাঠ ব্যবহার হয়ে থাকে। তার ভাটায় প্রতিদিন ২০০ মণ কাঠ লাগে। তবে কয়লা দিয়েও ইট পোড়ান বলে জানান তিনি। হাটফাজিলপুর এলাকার এক ইটভাটার মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তার ভাটায় প্রতিদিন ৩০০ মণ জ্বালানি কাঠ লাগে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকার ইটভাটা ঘুরে দেখা যায়, সব ভাটাতে কাঁচা ইট পোড়ানোর জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে হাজার হাজার মণ কাঠ।
ইট ভাটায় জ্বালানি কাঠ পোড়ানোর নিয়ম আছে কিনা জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের যশোর আঞ্চলিক অফিসের উপ-পরিচালক হারুন অর রশীদ জানান, ভাটায় কাঁচা ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি কাঠ ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। জিকজার ভাটা ছাড়া সরকারিভাবে কোন ভাটার অনুমোদন দেওয়া হয় না।
তিনি জানান, ২০১৪ সাল থেকে জিকজার ভাটা ছাড়া ড্রাম চিমনি ও ১২০ ফিট লম্বা ফিক্সড চিমনির ভাটা অবৈধ।
এব্যাপারে শৈলকুপার এসি ল্যান্ড পার্থ প্রতিম শীল বলেন, এভাবে কাঠ পোড়ানো সম্পূর্ণ বে-আইনী। হাই কোর্টের নিষেধাজ্ঞা না থাকলে অবশ্যই ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।