৬৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের মাত্র ১০ মিনিটের বৃষ্টিতেই চেংগাড়া থেকে চোখতোলা পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার রাস্তার অন্তত ১৫ টি স্পটে ভেঙ্গে গেছে।
ফলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জহিরুল লিমিটেডের লোকজন তড়িঘড়ি করে গোজামিল দিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া স্পর্টগুলো মাটি ভরাট করেছে।
তবে সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, সড়কের কাজ চলমান। যেখানে যে অবস্থায় থাকুক না কেনো নির্দিষ্ট সময়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কাজ বুঝে নেওয়া হবে। শিডিউল মেনেই সড়ক নির্মাণ করা চলছে।
নিমার্ণাধীন এ সড়কটি শুরু থেকেই নানা অনিয়ম ও নিম্নমাণের বালু ও খোয়াসহ অন্যান্য উপকরণ ব্যবহারের অভিযোগ তুলেছিলেন স্থানীয়রা। তার প্রমাণ গতকালের এই ১০ মিনিটের বৃষ্টিতেই পিচ ঢালাই রাস্তাটির দুইপাশ দিয়ে ভাঙতে শুরু করেছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, এজিং ভেঙে হুমকির মুখে পড়েছে নির্মাণাধীন দেড় কিলোমিটার সড়ক। এতে করে নষ্ট হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ। সড়কের বিভিন্ন অংশের এজিং ভেঙে পাশের জমিতে চলে গেছে। ফাটল দেখা দিয়েছে সড়কের বিভিন্ন স্থানে। সামান্য বৃষ্টিতেই কোনও কোনও স্থানে কার্পেটিং উঠে এজিং ভেঙে গেছে। কাজে নিম্ন মানের ইট, খোয়া, পাথর, বালু ব্যবহার করার কারণে সড়কের কয়েকটি কয়েকটি স্থানে উঁচু নিচু হয়ে দেবে গেছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
এছাড়াও পাকা সড়কের দুই পাশে কমপক্ষে ৩ ফুট মাটি থাকার কথা। অথচ অধিকাংশ সড়কেই এই নিয়ম মানা হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি একটি ট্রাক রাস্তার পাশে দাঁড়াতের রাস্তা বসে গিয়ে ট্রাকটি রাস্তার পার্শবর্তি খাদে উল্টে যায়।
তিনি বলেন, সড়কটি একদিকে নির্মাণ চলছে। আবার অপর দিক থেকে ভেঙ্গেও যাচ্ছে। মুলত নিম্নমানের কাজের কারনেই ভেঙ্গে গেছে বলে অভিমত দেন এই ব্যক্তি।
স্থানীয় আরেক বাসিন্দা রাকিবুল ইসলাম বলেন, নির্মাণ করছে সড়ক অথচ এখনই ভেঙ্গে গেছে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। কর্তৃপক্ষের উচিত ঠিকাদারের কাজের মান যাছাই করা। এভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করা ঠিক নয়।
নিয়ম অনুযায়ী এলাকার বাইরে থেকে মাটি এনে রাস্তার দুই পাশ ভরাট করার শর্ত থাকলেও তা অগ্রাহ্য হয়েছে সেটি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন রাস্তার পাশে সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানা জমি থেকে মাটি কেটে রাস্তার পাশে মাটি ভরাট করেছে। একটু ভারী বৃষ্টি হলেই রাস্তার পাশে দেওয়া ওই মাটি ধসে রাস্তা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
সড়কটিতে রয়েছে কয়েকটি কালভার্ট। কালভার্ট নির্মাণে ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের ইট, খোয়া আর ঢাকার লোকাল পূর্বাচল রড। স্থানীয়রা এ বিষয়টিতে বাধা দিলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের হুমকিতে মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন তারা। ফলে নবনির্মিত এসব কালভার্ট জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে বলে অভিযোগ করছেন এ সড়কে চলাচলকারীরা।
এদিকে গাংনীর আখ সেন্টার এলাকা থেকে বাঁশবাড়িয়া পর্যন্ত প্রায় পৌণে চার কিলোমিটার রাস্তা ফোর লেনের আওতায় রয়েছে। রাস্তা ফোর লেন হলেও গাংনী ও বাঁশবাড়িয়ার মাঝখানে ঝিনিরপুলটি একেবারেই সরু অবস্থায় রয়েছে। যেখানে বড় ধরণের দুর্ঘটনার আশংকা করছেন এলাকার মানুষ। এছাড়া আলমদিনা মাদ্রাসার সামনের কালভার্টটি মাঝখানে আগের অবস্থানে রেখেই দুই পাশে প্রস্ততকরণ করা হয়েছে। কালভার্টটির মাঝখানের সেই মান্ধাতা আমলে নির্মিত অবস্থায়ই রাখা হয়েছে।
এদিকে গাংনী বিদ্যুত উপকেন্দ্রের কাছে ও চেংগাড়া বাজারের কাছের দুটি কালভার্ট ভেঙ্গে নতুন করে নির্মাণ করা হয়নি। শত বছরের এসব কালভার্টগুলোতে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশংকা করছেন স্থানীয়রা। এছাড়া চোখতোলার অদুরে নির্মিত একটি কালভার্ট, জোড়পুকুরিয়া—তেরাইলের মাঝখানের একটি কালভার্ট, অলিনগরের মাঠের মাঝখানের একটি কালভার্ট, বাওট ভূটি দোকানের অদুরে নির্মিত কালভার্ট, শুকুরকান্দি—বাওটের মাঝখানের কালভার্টগুলো প্রসস্তকরণ করা হলেও রাস্তার উপরে রয়েছে কালভার্টের দু পাশের রেলিং।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেহেরপুর—কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়ক প্রশস্তকরণসহ সংস্কার প্রকল্পের আওতায় ২৯ কিলোমিটার তিন ভাগে ২৭০ কোটি ৫৪ লাখ টাকার কাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে গাংনীর তেরাইল ডিগ্রি কলেজ থেকে খলিশাকুন্ডি ব্রিজের পূর্বপাশ পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার একটি প্যাকেজ। এই প্যাকেজটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমএম বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড ও মেসার্স রিমি নির্মাণ সংস্থা। এ প্যাকেজটির প্রাক্কলিত ব্যয় ৯০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বামন্দী বাজারের অদূরে অস্থায়ী কার্যালয় ও ফিল্ড স্থাপন করেছে।
সেখানে প্রকাশ্যে নিম্নমানের ইট ভেঙে বানানো হয়েছে খোয়া। এই খোয়া ও নিম্নমানের বালু দিয়েই সম্প্রসারিত অংশের ডব্লিউবিএম সম্পন্ন হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান রাতদিন সমানভাবে ও সঠিকভাবে কমপেকশন করা হয়নি মর্মে এলাকার লোকজন বারবার বলার পরেও তাতে কর্ণপাত করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কাজের পাশে সড়ক ও জনপথ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের অভিযোগ, সঠিকভাবে কমপেকশন না হলে ও নিম্নমানের দ্রব্য ব্যবহার হলে রাস্তার স্থায়িত্ব কমে যাবে।
এদিকে, মেহেরপুর থেকে তেরাইল বঙ্গবন্ধু ডিগ্রী কলেজ পর্যন্ত রাস্তার ঠিকাদার মেসার্স জহিরুল লি:। অভিযোগ উঠেছে, রাস্তা নির্মাণের ক্ষেত্রে কালো পাথর দেওয়ার ক্ষেত্রে দেওয়া হচ্ছে সাদা পাথর। ডাব্লু বিএম ১ নং ইটের খোয়া ব্যবহার করা কথা সেখানে করা হয়েছে আমা ইটের খোয়া। এছাড়া বালি ও পাথরের সংমিশ্রন এক এক দেওয়ার কথা থাকলেও সেখানে দেওয়া হয়েছে পাথর ও বালি এক চার বলে অভিযোগ উঠেছে। নির্মাণ কাজে বাংলাদেশী পিচ ব্যবহারের স্থানে করা হয়েছে ইরানি পিচ।
জানা গেছে, মেহেরপুর জেলায় চলমান সবচেয়ে বড় প্রকল্প এটি। অভিযোগ উঠেছে, কাজ হচ্ছে যাচ্ছেতাইভাবে। নিম্নমানের ইট, বালুর ব্যবহার হচ্ছে প্রকল্পের কাজ দেখভালে যান না দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীরা। এতে স্থানীয় সচেতন অনেকেই কাজ দেখে ক্ষোভে ফুঁসছেন।
এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলী খন্দকার গোলাম মোস্তফা বলেন, ঠিকাদার কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে এখনও কাজ বুঝিয়ে দেয়নি। তবে ঠিকাদার রাস্তার পাশে পর্যাপ্ত মাটি না দেওয়ায় দুইপাশ ভেঙে গেছে।
তিনি আরও জানান, রাস্তা হ্যান্ডওভারের তিন বছর পর্যন্ত রাস্তার সব দায়ভার ঠিকাদারের। তারা রাস্তার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।