২০০৪ সালের ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলায় আহতরা ভালো নেই। অনেকে এখনো গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের অসহ্য যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন। মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা। গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে কেউ হারিয়েছেন চোখ, কারো গেছে চলার ক্ষমতা, কেউ হারিয়েছেন শ্রবণশক্তি। অনেকে প্যারালাইসড হয়ে হুইলচেয়ারে চলাফেরা করছেন, অনেকের জীবনে এখন ক্র্যাচই চলাফেরার নিত্যসঙ্গী।
আবার কারো সারা জীবনের সঙ্গী হয়েছে অসহ্য যন্ত্রণা। ১৬ বছর পরও গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের যন্ত্রণায় রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না তারা। সেদিনের পরে আহতদের অনেকেই আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। কেউ কেউ শরীরে বহন করে চলেছেন শত শত স্প্লিন্টার।
ঐ গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার কথা জানান মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী ও জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নাসিমা ফেরদৌসী। তিনি বলেন, ‘পঙ্গুত্বের জীবন যে কী কষ্টের, কী যে ভয়াবহ, সে কথা পঙ্গু না হলে জানা যায় না। আমার সুন্দর জীবনটা হারিয়ে গেছে। জোড়াতালি দেওয়া হাত-পা নিয়ে বেঁচে আছি। মাথা, বুক, দুই পা, পেট—সর্বাঙ্গে বিঁধে আছে অসংখ্য ঘাতক স্প্লিন্টার। অনেকটা মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করেই চলছি।’
দলের অনেক সিনিয়র নেতাও গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করে প্রতিদিন দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন, নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন দলের। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনিও ২১শে আগস্ট ভয়াল গ্রেনেড হামলায় মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। দেশ-বিদেশে চিকিত্সার পর এখনো সর্বাঙ্গে অসংখ্য ঘাতক স্প্লিন্টার বিঁধে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়েই আমার দিন কাটছে। অমাবস্যা ও শীতকাল এলে যন্ত্রণা আরো বেড়ে যায়।’
বর্বরোচিত সেই গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন। ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে এস এম কামাল হোসেন বলেন, এখনো ১০ থেকে ১২টি স্প্লিন্টার শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।
১ হাজার ৮০০ স্প্লিন্টার দেহের মধ্যে নিয়ে বেঁচে আছেন মাহবুবা পারভীন। তিনি জানান, মাথার দুটি স্প্লিন্টার তাকে খুব জ্বালায়। সুঁইয়ের মতো হুল ফোটায়। যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে একবার নিজেই ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে স্প্লিন্টার বের করার চেষ্টা করেছিলেন মাহবুবা। পরে জায়গাটায় ঘা হয়ে যায়। নিয়মিত ওষুধ খেয়ে ব্যথাটা দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। যন্ত্রণা যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন হাসপাতালে ছোটেন। মাঝেমধ্যে তিনি পাগলের মতো চিত্কার করে আবোল-তাবোল বলেন।
আহতদের একজন বর্তমান ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান। কিডনি, অণ্ডকোষ, রক্তনালিসহ তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে এখনো ৫৮টি স্প্লিন্টার রয়েছে। শরীরে থাকা স্প্লিন্টারের যন্ত্রণার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সবকিছু ফেলে দুনিয়া থেকে চলে যেতে হবে। শুধু ওদেরই (গ্রেনেডের স্প্লিন্টার) সঙ্গে নিয়ে যাব।’ শারীরিকভাবে আহত হওয়ার পাশাপাশি মানসিক ট্রমা প্রসঙ্গে শেখ বজলুর রহমান বলেন, ‘সেই ভয়াল স্মৃতি আর মনে করতে চাই না।’
২১শে আগস্ট শেখ হাসিনা যে ট্রাকে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, সেই ট্রাকের পেছনে ছিলেন পুরান ঢাকার মাজেদ সরদার রোডের বাসিন্দা স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেত্রী রাশিদা আক্তার রুমা। গ্রেনেডের আঘাতে ১৮টি দাঁত পড়ে যায় তার। ডান পা পচতে পচতে হাড়ে লেগেছে। এখন পচতে শুরু করেছে বাম পা। গ্রেনেড হামলার পর মরার মতো পড়ে ছিলেন। মারাত্মক আহত রাশিদাকে যখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তাকে মৃত ভেবে কেউ একজন চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে দিয়েছিলেন। রাশিদাকেও হামলার কয়েক দিনের মাথায় কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে রক্ত দিতে হয়েছিল ২০ ব্যাগ। পায়ে হেঁটে সমাবেশস্থলে গিয়েছিলেন, কলকাতা থেকে দেশে ফেরেন হুইলচেয়ারে।
গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের অসহ্য যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন আসমা জেরিন ঝুমুও। গ্রেনেড হামলায় আহত হয়েছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমান, প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু, প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিম, প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ, ওবায়দুল কাদের, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, প্রয়াত সাহারা খাতুন, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, কাজী জাফর উল্লাহ, পংকজ দেবনাথ, সাঈদ খোকন, নজরুল ইসলাম বাবু, শাহিদা তারেক দিপ্তী, উম্মে রাজিয়া কাজল, আবুল হোসেন মোল্লা, মামুন মল্লিক, কাজী মোয়াজ্জেম হোসেইন, হামিদা খানম মনিসহ পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী।
সূত্র- ইত্তেফাক