কম্পিউটারে লেখার অক্ষরকে সুন্দরভাবে দেখার জন্য রয়েছে নানা ফন্ট। আরও সহজে বিভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে কম্পিউটারে বাংলা লিখতে পারে সাধারণ মানুষ। এমনকি রয়েছে বাংলাসমৃদ্ধ নানা কী-বোর্ডও। আজকের আয়োজনে ইন্টারনেট ও কম্পিউটারে বাংলার আবির্ভাব নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন- সাইফ আহমাদ
কম্পিউটারে বাংলা কী-বোর্ড
বাংলা কি-বোর্ডর ধারণাটা প্রথম প্রয়োগ করেন শহিদ মুনীর চৌধুরী ১৯৬৫ সালে, তার ‘মুনীর’ কী-বোর্ডর মাধ্যমে। এটি ছিল টাইপ রাইটারের জন্য তৈরি করা একটি QWERTY কী-বোর্ড লেআউট। মূলত টাইপরাইটারের জন্য আবিষ্কৃত হলেও পরবর্তীতে কম্পিউটিং জগতে ‘মুনীর লেআউট’ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
পরবর্তীতে যখন কম্পিউটার এলো, তখন থেকেই বাংলা অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তা হলো, লেআউট তো রেডি; এবার সঙ্গে প্রয়োজন সফটওয়্যার বা মূল প্রোগ্রামিং, যা কম্পিউটারের বোধগম্য ভাষায় রূপান্তর করবে এবং ‘ফন্ট’ যা কম্পিউটারের মনিটরে দেখাবে।
প্রথম বাংলা সফটওয়্যার
১৯৮২ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশল বিভাগের ড. সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের তত্ত্বাবধানে কম্পিউটারে বাংলা ব্যবহারের ওপর গবেষণা শুরু হয়। এরপর চলমান গবেষণাগুলোর মধ্যে সাইফ উদ দোহা শহীদ সর্বপ্রথম বাংলা সফটওয়্যার আবিষ্কার করতে সক্ষম হোন। প্রথমে মুনীর লেআউট ও পরে QWERTY লেআউট ব্যবহার করে ২৫ জানুয়ারি সহকর্মীদের সহায়তায় বানিয়ে ফেলেন দুই বছরের পরিশ্রমের ফসল বাংলা লেখার সর্বপ্রথম সফটওয়্যার ‘শহিদলিপি’। অ্যাপোলের ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারে শহিদলিপি ব্যবহার করে লেখা যেত বাংলা।
মাইনুল লিপি
১৯৮৬ সালে মাইনুল ইসলাম তৈরি করেন ‘মাইনুললিপি’ নামক একটি বাংলা ফন্ট এর সুবিধা ছিল কোন ড্রাইভার কিংবা সফটওয়্যারের সাহায্য ছাড়াই এ ফন্ট দিয়ে ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারে খুব সহজেই বাংলা লেখা যেত। এরপর যুক্তাক্ষর সমস্যা সমাধানের জন্য মাইনুল ইসলাম চার স্তরবিশিষ্ট কী-বোর্ড ব্যবহার করেন।
বিজয় ৫২
সাংবাদিকতায় জড়িত মোস্তাফা জব্বার লন্ডনে গিয়েছিলেন মুদ্রণের কাজ সম্পর্কিত যন্ত্রাংশ কিনতে। সেখানে গিয়ে দেখলেন পার্সোনাল কম্পিউটারের সঙ্গে প্রিন্টারকে সংযুক্ত করে মুদ্রণের কাজ করে। তিনি একটি পার্সোনাল কম্পিউটার ও প্রিন্টার সঙ্গে করে কিনে নিয়ে আসেন। তারপর নতুন বাংলা সফটওয়্যার তৈরিতে কাজ করতে থাকেন। কোন এক বিদেশির পরামর্শে একটি ইংরেজি ফন্টের অনুকরণে তৈরি করে ফেলেন বাংলা ফন্ট তন্বী সুনন্দা। ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার দেবেন্দ্র যোশী তাকে বানিয়ে দেন বাংলা লেখার জন্য একটি সফটওয়্যার। ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বরে মোস্তাফা জব্বার ও গোলাম ফারুক আহমদ উন্মোচন করেন দেড় বছরের ফসল বাংলা লেখার সফটওয়্যার ‘বিজয়’। বাংলা সফটওয়্যার প্রবেশ করে উন্নত যুগে। ১৯৯৩ সালে সেইফ ওয়ার্কশ ‘বর্ণ’-এর উইন্ডোজ সংস্করণ ‘বর্ণনা’ তৈরি করে যার মূল আকর্ষণ ছিল, পাশাপাশি এটি বাংলা বানানের ভুল ধরিয়ে দিতে পারত। একই সালে বাংলাদেশ সরকার বাজারে আনে বাংলা লেখার সফটওয়্যার ‘জাতীয়’। তবে জাতীয় খুব বেশি জনপ্রিয় হয়নি। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে মোস্তাফা জব্বার পরবর্তীতে নিয়ে আসেন ‘বিজয়’-এর উইন্ডোজ সংস্করণ।
অভ্র ফোনেটিক
২০০৬ সাল, নবজাগরণ যুগের শুরু। এ সালে ঘটে বাংলা কম্পিউটিং শিল্পে এক নতুন বিপ্লব। মেহেদী হাসান, রিফাত-উন-নবী আর ওমিক্রন ল্যাবের সদস্যরা পরিশ্রম করে তৈরি করেন বাংলা লেখার নতুন পদ্ধতি-অভ্র ফোনেটিক। এর মাধ্যমে ইংরেজি কী-বোর্ড ব্যবহার করেই খুব সহজেই বাংলা লেখা যায়। যেমন-কেউ ইংরেজিতে ami banglay gan gai লিখলে সেটা হয়ে যাবে-আমি বাংলায় গান গাই। যদিও এর আগে হাসিন হায়দার নামক একজন ডেভেলপার ফোনেটিকভিত্তিক বাংলা কী-বোর্ড আবিষ্কার করেন বলে জানা যায়। মেহেদী হাসানের এ যুগান্তকারী আবিষ্কার বাংলার জগতে নিয়ে এলো নতুন এক বিপ্লব। দিনের পর দিন মেহেদী হাসান তার এ সফটওয়্যারে নতুন নতুন সুবিধা যুক্ত করেন। কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্রাউজারে বাংলা লেখাগুলো খুব ছোট দেখা যেত, যার কারণ উইন্ডোজের বৃন্দা (Vrinda) ফন্ট। ওমিক্রন ল্যাবের তানবীর ইসলাম সিয়াম সেজন্য বানান সিয়ামরূপালী (Siyamrupali) নামক ফন্ট, যা এ সমস্যার সমাধান করে। SutonnyMJ ফন্টের বিকল্প হিসাবে বানানো হয় কালপুরুষ (Kalpurush)। যুক্ত করা হয় স্পেল চেকার, উইনিকোড থেকে বিজয় কনভার্টার; এ ছাড়া ছিল অনেক সুবিধা। মেহেদী হাসান তার এ মূল্যবান আবিষ্কারকে সবার কথা ভেবে বিনামূল্যে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। তার মতে, ভাষা হওয়া উচিত সবার কাছে উন্মুক্ত।
এরপর স্মার্টফনে, ট্যাবসহ অন্যান্য গেজেটে বাংলা লেখার জন্যে আস্তে থাকে নানারকম সফটওয়্যার ও কী-বোর্ড, যেগুলোর মাধ্যমে খুব সহজে বাংলাই টাইপ করে লিখতে পারেন ব্যবহারকারীরা।