স্বাধীনতার তীর্থভূমি মেহেরপুরের মুজিবনগর। সুবিশাল একটি আম্রকানন। এই সুবিশাল আম্রকাননটির মালিক ছিলেন কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের ভবের পাড়ার জমিদার বৈদ্যনাথ বাবু। বৈদ্যনাথ বাবুর নামানুসারেই যায়গাটির নাম হয়ে যায় বৈদ্যনাথ তলা।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রথম অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। শপথ গ্রহণ করেন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার, পাঠ করা হয় বাংলাদেশ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। শপথ গ্রহণ এবং ঘোষণাপত্র পাঠের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ একটি বিবৃতি পাঠ করেন এবং বৈদ্যনাথতলার নাম রাখেন মুজিবনগর। সেই থেকে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার নাম হয় মুজিবনগর।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকারপ্রধান হলে মুজিবনগর কমপ্লেক্স নির্মাণকাজে হাত দেন। উল্লেখ্য ১৯৮৭ সালে তৎকালীন সেনাশাষক হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ এর আমলে স্মৃতিসৌধটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে একজন সেবক হিসেবে পুরো স্মৃতিসৌধ রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন সুভাষ মল্লিক। সাদামনের মানুষ সুভাষ মল্লিক কিন্তু পরিচ্ছন্নতাকর্মী নন শুধুমাত্র ভালোবাসা ও ভালোলাগার কারণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পর থেকেই তিনি নিয়মিত এটিকে পরিষ্কার রাখেন।
তিনি মুজিবনগরে আগত পর্যটকদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও স্মৃতিসৌধের সমস্ত স্থাপনা সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করেন। যা পর্যটকরা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার তীর্থভূমি মুজিবনগর সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা নিতে পারেন। ভিনদেশী পর্যটকদেরও তিনি ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে ইতিহাস বুঝাতে চেষ্টা করেন।
সুভাষ মল্লিক এধরনের একটি মহতী কাজ করছেন বছরে পর বছর। এই কাজটি যেন নেশায় পরিণত হয়েছে তার। অবশেষে দীর্ঘ ২৪ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের অধীনে তার কাজের স্বীকৃতি ও পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা হয়েছে। যেটি মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক ডঃ মনসুর আলম খান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
কে এই সুভাষ মল্লিক?
মুজিবনগর ভবরপাড়া এলাকার মৃত অনিল মল্লিকের ছেলে তিনি। বয়স ৭৬ বছর। ছোট থেকে ভবরপাড়াতেই তার বেড়ে ওঠা। দাদা মুসলিম হলেও বাবার সূত্র ধরে খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী তিনি। কৈশর কটেছে ভবরপাড়াতেই। যৌবনে তিনি দীর্ঘদিন এলাকার মিশনে কাজ করতেন। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি স্মৃতিসৌধের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেন। দীর্ঘ ২৪টি বছর এই কাজটি করে চলেছেন তিনি।
পরিবারে স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ে, নাতি আর স্ত্রী আন্না মল্লিককে নিয়ে তাঁর সংসার। স্মৃতিসৌধের পাশেই ভবেরপাড়া গ্রামে বসবাস করেন।
সামান্য একটু জায়গায় পরিবার নিয়ে তার বসবাস। এই জায়গাটির কারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে অবহেলা ও নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন তিনিসহ পরিবারের সদস্যদের। জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে এসে হাসি ফুটেছে তার মুখে।
অবশেষে দীর্ঘ ২৪ বছর পর আলোর মুখ দেখেছেন তিনি। স্মৃতিসৌধের রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেউ তাঁকে স্মৃতিসৌধ পরিষ্কার করার জন্য বলেননি, নিয়োগও দেননি। নিজের তাগিদেই প্রতিদিন স্মৃতিসৌধ পরিষ্কার করেন। তবে গণপূর্ত বিভাগের তরফ থেকে তাকে ৫০০ টাকা সম্মানী দেওয়া হত। যা দিনে দিনে বেড়ে হয় ২০০০ টাকা তবে এটা নিয়মিত নয়।
সংসার চলার জন্য পর্যাপ্ত বা যথেষ্ট ছিল না। তবু এ নিয়ে তাঁর কোন আক্ষেপ নেই। স্মৃতিসৌধ প্রতিদিন পরিচ্ছন্ন ও রক্ষাণাবেক্ষণ করতে পারাটাই যেন তাঁর তুষ্টি। স্বাধীনতার এই তীর্থভূমিকে আগলিয়ে রাখতে সেচ্ছায় নিয়েছেন এই গুরুদায়িত্ব। সুভাষ মল্লিকের সাথে কথা হলে
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন অবস্থা, মুজিবনগরে শপথ গ্রহণের স্মৃতি, স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও স্মৃতি কমপ্লেক্সের কথা। তারপর বলেন, এই যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, সেই যুদ্ধে অগণিত শহীদদের অবদান ও আত্মত্যাগ।
আমি তো যুদ্ধের সময় কিছুই করতে পারি নাই তবে তাদের স্মৃতিঘেরা এই জায়গাটুকু পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করি এই ঐতিহাসিক জায়গাটি সম্পর্কে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত আসা মানুষগুলোকে জানানোর চেষ্টা করি। একটু ময়লা দেখলে আমার কলিজায় লাগে। লোকমুখে জায়গাটির নাম বৈদ্যনাথতলা হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্মরণীয় স্থান মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ তথা মুজিবনগর। স্থানীয় কেউ এলাকার নাম বৈদ্যনাথতলা বা আম্রকানন বললে তিনি তা মানতে নারাজ, তার এক কথা, এ হলো মুজিবনগর যার মানেই হলো স্বাধীনতার তীর্থভূমি মানে একটি বাংলাদেশ। কোন কিছুর বিনিময়ে নয় আমৃত্যু আমি আমার এই কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে চায়। দীর্ঘ ২৪ বছর পর কাজের স্বীকৃতি পাওয়ায় তিনি আনন্দিত।
তিনি বলেন, আজকের এই স্বীকৃতির সবটুকুই অবদান জেলার গণমাধ্যমকর্মীদের উপরে বর্তাবে। যারা বিভিন্ন সময়ে আমাকে নিয়ে লিখেছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানেন মুজিবনগরে একজন সুভাষ মল্লিক আছে এটাই আমার কাছে বড় পাওয়া। তাছাড়া বিগতদিনে এই জেলায় দায়িত্ব নিয়ে আসা জেলা প্রশাসক ও নির্বাহী অফিসারদের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ।