তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া সম্প্রদায়ের) এক প্রার্থী আগামী ইউপি নির্বাচনে সম্ভাব্য চেয়ারম্যান পদে ভোট করতে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। তিনি শত শত কর্মী সমর্থক নিয়ে এলাকায় মোটরসাইকেল শোডাউনসহ সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ছয় নম্বর ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের দাদপুর গ্রামের নজরুল ইসলাম রিতু নামে ওই হিজড়া এবার তাদের সম্প্রদায় থেকে বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিতীয়তম প্রার্থী হচ্ছেন।
প্রসঙ্গত, এর আগে গেলো উপজেলা নির্বাচনে পার্শ্ববর্তী উপজেলা কোটচাদপুরের পিংকি খাতুন নামে এক হিজড়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এবং তিনি দেশের মধ্যে তৃতীয় লিঙ্গের প্রথম জনপ্রতিনিধির স্বীকৃতি পায়। এদিকে এখনও ইউপি নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা না হলেও তার আগাম নির্বাচনী মহড়ায় কর্মকাণ্ডে শহর গ্রামাঞ্চলে বেশ আলোচিত হয়ে উঠেছেন।
গেলো তিন দিন আগে নজরুল ইসলাম রিতু তার শত শত কর্মী সমর্থক নিয়ে মাইক্, মোটরসাইকেল, সিএনজি ও নসিমন সহকারে নিজ এলাকা ও শহরে শোডাউন শেষে কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে আসেন। এরপর সেখানে দলীয় নেতাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষে তিনি তার প্রার্থীতা জানাতে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময়ে বসেন।
লাল সবুজ রংয়ের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ লেখা মাফলার পরিহিত রিতু নিজেকে আওয়ামী লীগের একজন সমর্থক দাবি করে বলেন, আগামী ইউপি নির্বাচনে তিনি দলীয় নৌকা প্রতীক পেতে আশাবাদী। এলাকার মানুষ তার পাশে রয়েছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এলাকার উন্নয়নে মাদরাসা, মসজিদ, মন্দির ও রাস্তা নির্মাণে সহযোগিতা ছাড়াও এলাকার দুঃস্থ অসহায় মানুষের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন।
তৃতীয় লিঙ্গের এই প্রার্থী রিতু তার নিজের জীবন বৃত্তান্ত তুলে ধরতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, তার জন্মস্থান কালীগঞ্জ উপজেলার ত্রিলোচনপুর দাদপুর গ্রামে। মৃত আব্দুল কাদেরের সন্তান রিতু ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয়। তারা তিন ভাই ঢাকাতে থাকে ও বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। জন্মের পর তৃতীয় লিঙ্গের সনাক্তের কারণে পাঁচ বছর বয়সে তাকে গ্রাম ছেড়ে ঢাকাতে চলে যেতে হয়।
সামান্য লেখাপড়া করলেও সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতায় প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোনো সম্ভব হয়নি। ছোটবেলা থেকেই ঢাকার ডেমরা থানাতে তার দলের গুরুমার কাছেই বেড়ে উঠেছেন। এখন তার বয়স ৪০ বছর। গুরুমার পরের দ্বায়িত্বটা তিনি পালন করছেন। তার দলে ৭০ জন হিজড়া আছে। বর্তমানে ঢাকাতে থাকলেও প্রতিনিয়ত তিনি তার গ্রামের বাড়ি দাদপুরে আসা-যাওয়া করতেন।
রিতু আরও জানান, ঢাকাতে তিনি তাদের তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়ের দলে থাকলেও পরিবারের টানে প্রায়ই বাড়িতে আসতেন। তার কষ্টার্জিত জমানো অর্থ দিয়ে বিগত প্রায় ১৫ বছর ধরে জন্মস্থান দাদপর গ্রামসহ ইউনিয়নবাসীর উন্নয়নে সহযোগিতা করছেন।
এলাকার মাদরাসা, মসজিদ মন্দিরের উন্নয়নে দান করেছেন অর্থ। এলাকার কেউ অসুস্থ বা কন্যাদায়গ্রস্থ হয়ে তার কাছে গিয়ে কখনো খালি হাতে ফিরতে হয়নি। সাধ্যমতো সহযোগিতা করতেন। কয়েক বছর আগে তার বাবার জমিতেই বানিয়েছেন একটি পাকা বাড়ি।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ও তার নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে বলতে গিয়ে রিতু জানায়, সৃষ্টিকর্তা আমাকে যেভাবে পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখিয়েছেন তাতেই আমি খুশি। এলাকার মানুষ আমাকে ভালবাসে। তাই আমার কষ্টার্জিত অর্থ এলাকার মানুষের জন্য ব্যয় করে আনন্দ পাই। অত্র ইউনিয়নের গ্রামের মানুষের উৎসাহেই তিনি আগামী ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হতে আগ্রহী হয়েছেন।
তিনি জানান, তার পরিবার আওয়ামী মনোভাবাপন্ন পরিবার। এছাড়াও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ এলাকার হাজার হাজার মানুষ তাকে সমর্থন করছেন। তিনি রাজনৈতিকভাবে দলের সক্রিয় কর্মী না হলেও নিজেকে আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ট সমর্থক বলে জানান। দলের নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাদের সম্প্রদায়ের জন্য ভোটাধিকার ও নানান সুযোগ সুবিধা করে দিয়েছেন।
স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের সঙ্গে তার অনেক দিনের পরিচয়। তিনি তাকে ভালবাসেন এবং যোগ্য হিসেবে তাকে দলীয় মনোনয়ন দিবেন বলে আশাবাদী। সর্বশেষ রিতু তার জীবনটা এলাকার মানুষের সেবার জন্য উৎসর্গ করবেন বলে অভিমতও ব্যক্ত করেন।
রিতুর নির্বাচনী শো-ডাউনে আসা ওই ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের শাকিল ও সাগর হোসেন জানান, তৃতীয় লিঙ্গের হিজড়া সম্প্রদায়ের রিতু আমাদের গ্রামেরই সন্তান। তিনি তাদের গ্রামের উন্নয়নে ও অসহায় গ্রামবাসীদের সহযোগিতা করে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তার সামর্থ্য অনুয়ায়ী গ্রামের রাস্তা মসজিদ মন্দিরসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজে অর্থ দান করেছেন।
এছাড়াও প্রতিনিয়িত গ্রামের অভাবী, অসহায় কন্যাদ্বায়গ্রস্থ ও দরিদ্র অসুস্থ মানুষের জন্য তার সহযোগিতা চলমান আছে। শো-ডাউনে আসা বিভিন্ন গ্রামবাসীদের ভাষ্য মতে তার মতো একজন মানুষ জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হলে এলাকার উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে।