কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আব্দালপুর গ্রামের শারিনা খাতুন ২৫ অক্টোবর একটি দলিল সম্পাদন করতে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে যান। ৫ লাখ টাকার দলিল করতে তাঁর কাছ থেকে সাড়ে ৪৮ হাজার টাকা নেওয়া হয়। এর মধ্যে সরকারি কোষাগারে জমা পড়েছে ৩৮ হাজার টাকা। বাকি টাকা দলিল লেখক সমিতি নিয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
গত ২৫ ও ২৬ অক্টোবর সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে প্রায় ৫ ঘণ্টা অবস্থান করে শহরের চৌড়হাস এলাকার আলফাজ উদ্দিন, ইউসুফ আলীসহ ১০ জন ক্রেতার সঙ্গে কথা হয়। প্রত্যেককেই দলির সম্পাদন করতে সরকার নির্ধারিত টাকার বাইরে ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা নিবন্ধনহীন সমিতিকে দিতে হয়েছে।
কুষ্টিয়া এনএস রোডে অবস্থিত সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে সদর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ছাড়াও পৌর এলাকার জমি কেনাবেচার দলিল সম্পাদন হয়। অফিসের হিসাব অনুযায়ী সপ্তাহের তিন দিন মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার গড়ে ৩৫০ থেকে ৪০০ দলিল সম্পাদন হয়। প্রতি মাসে সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৩০০ থেকে ৪০০।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট কয়েকজন জানান, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ১ লাখ টাকার দলিল হলে ক্রেতাকে কোষাগারে জমা দিতে হয় শহরের জন্য ১১ হাজার ও ইউনিয়নের জন্য সাড়ে ৭ হাজার টাকা। এ টাকার ব্যাংক রিসিট দেওয়া হয়। এ হিসাবের বাইরে দলিল লেখক সমিতিকে দিতে হয় প্রথম এক লাখের জন্য সাড়ে ৩ হাজার ও পরবর্তী প্রতি লাখে ১ হাজার টাকা। এ ছাড়া সমিতির মাধ্যমে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা দিতে হয়। এই সাড়ে ৩ হাজারের মধ্যে সাব-রেজিস্ট্রার ১ হাজার, জেলা রেজিস্ট্রার ৫০০ ও অফিস সহকারী নেন ৫০০ টাকা। অফিসের অন্য সব স্টাফ মিলে নেন ১ হাজার টাকা ও বাকি ৫০০ টাকা দিতে হয় সমিতিকে।
সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে দলিল সম্পাদন করতে আসা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে সমিতির মাধ্যেম এভাবেই দিনের পর দিন প্রকাশ্যে কোটি কোটি টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন কয়েকজন দলিল লেখক, ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা। বিষয়টি নিয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না। সাধারণ দলিল লেখকদের মধ্যে এ নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও তারা ভয়ে কিছু বলতে পারেন না।
এ বিষয়ে প্রথমে সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের অফিস সহকারী রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি সাড়ে তিন বছর এ অফিসে কাজ করলেও অবৈধ সমিতির নামে চাঁদা আদায়ের বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন। প্রমাণ দিলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে বলেন। পরে সদর সাব-রেজিস্ট্রার কাওসার আলীর সঙ্গে কথা হলে তিনিও চাঁদার ভাগ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তবে কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান এ কর্মকর্তা। একইভাবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জেলা রেজিস্ট্রার সৈয়দা রওশন আরা।
কয়েকজন দলিল লেখক জানান, সদর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে দলিল লেখকদের একটি সমিতি আছে। এর সভাপতি ওয়াহেদুজ্জামান লাইজু, সাধারণ সম্পাদক পৌর কাউন্সিলর সোহেল রানা আশা ও ক্যাশিয়ার আমিরুল ইসলাম। মাত্র তিন সদস্যের নিবন্ধনহীন এ সমিতি তিন-চার বছর ধরে চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। সমিতির বার্ষিক কোনো সভা ও এজিএমও হয় না। সা রাদিন কত দলিল হয় তার হিসাব সন্ধ্যায় করা হয়। সেই হিসাব অনুযায়ী রাতে দলিল লেখকদের কাছ থেকে টাকা বুঝে নেন নেতারা। এভাবে প্রতি মাসে সমিতির নেতাদের পকেটে যাচ্ছে কমপক্ষে কয়েক কোটি টাকা। এ টাকার বড় একটি অংশ পান কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতাসহ কয়েকজন। বাকি টাকা সমিতির তিন নেতা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন। খুব সামান্য পরিমাণ টাকা ১৫০ থেকে ১৭৫ জন যে দলিল লেখক আছেন তাদের দেওয়া হয়।
দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা আশা বলেন, খরচ বাবদ ক্রেতাদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা নেওয়া হয়। সমিতির কার্যক্রমের বিষয়ে তাঁর ভাষ্য, সাধারণ সভা বা নির্বাচন হয় না। সারাদেশে সমিতি এভাবেই চলছে। কেন্দ্রের সঙ্গে সমন্বয় করে তারা কাজ করেন।