কুষ্টিয়া সদর উপজেলার দুর্বাচারা গ্রামে বীর শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়েছে সর্বস্তরের মানুষ।
দুর্বাচারা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে অবস্থিত শহীদদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনসহ সর্বস্তরের জনগণ।
১৯৭১ সালে বংশীতলা যুদ্ধে যারা শহীদ হন তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠকে সমাহিত করা হয় দুর্বাচারা স্কুল প্রাঙ্গনে। পরবর্তীতে এখানে সরকারের তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলা হয়েছে স্মৃতি কমপ্লেক্স।
প্রতি বছর দুর্বাচারায় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সরকারীভাবে বিজয় দিবস উদযাপন করা হয়।
সকালে শহীদদের কমপ্লেক্সে শ্রদ্ধা জানান কুষ্টিয়া সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা, উজানগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছানোয়ার হোসেন মোল্লা, উজানগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা সাবু-বিন-ইসলাম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানার অফিসার ইনচার্জ মোস্তাফিজুর রহমান, কুষ্টিয়া সদরের উপজেলা শিক্ষা অফিসার সিরাজুম মনিরা, সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মোশারফ হোসেন।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত অনুষ্ঠানটি সভাপতিত্ব করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার জুবায়ের হোসেন চৌধুরী।
এছাড়া শ্রদ্ধা জানান শহীদ পরিবারের সদস্য ও সাধারণ জনগণ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তৎকালীন বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার রয়েছে গৌরবময় অবদান। মেহেরপুরের আম্রকাননে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠন এর উৎকৃষ্ট নিদর্শন। ১৯৭১ সালে কুষ্টিয়ার প্রত্যনত্ম গ্রামাঞ্চলের মানুষও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধে। তেমনি এক জনপদ ঐতিহ্যবাহী দুর্বাচারা। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী এই গ্রামের যুবকরা দেশমাত্রিকার জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে অংশ নেয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কুষ্টিয়ার বংশীতলার যুদ্ধ ছিল অন্যতম। যুদ্ধস্থান হওয়ায় সবসময় বংশীতলা আলোচিত হয়েছে বেশি। কিন্তু এর পেছনে ছিল দুর্বাচারা অঞ্চলের যুবকদের অবিস্মরণীয় কীর্তি। মূলত ওই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ যোদ্ধাদের নিয়েই বংশীতলা যুদ্ধ সংগঠিত হয়। ওই সময় বংশীতলা যুদ্ধের সমসত্ম কর্মকা- পরিচালিত হয়েছে দুর্বাচারা থেকে।
৫ সেপ্টে¤॥^র যুদ্ধের দিন পাক সেনারা বংশীতলা মোড়ে অবস্থান নিলে দুর্বাচারা থেকে পাল্টা আক্রমণে যান মুক্তিসেনারা। ওই যুদ্ধে সামগ্রিকভাবে মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন আবুল কাশেম। তবে ৫ সেপ্টেম্বর সেখানে সামসুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এতে ১১ জন শহীদ হন এবং ২০/২৫ জন আহত হন। নিহতদের পাঁচজনকে দুর্বাচারা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে দাফন করা হয় এবং বাকিদের বিভিন্ন জায়গায় বিৰিপ্তভাবে সমাহিত করা হয়।
এরমধ্যে একজনকে কমলাপুর ফুটবল মাঠের পাশে দাফন করা হয়। ৫ সেপ্টেম্বরের ওই যুদ্ধে ১১ জন শহীদ হলেও দুর্বাচারায় ছয়জনকে পাশাপাশি সমাহিত করা হয়। তাঁরা হলেনÑতাজুল ইসলাম, দিদার আলী (বীর প্রতীক), ইয়াকুব আলী, সাবান আলী, আব্দুল মান্নান ও শহিদুল ইসলাম। বাকিদের বিভিন্ন জায়গায় দাফন করা হয়। আর শহিদুল ইসলাম শহীদ হন ৬ ডিসেম্বর করিমপুরের যুদ্ধে। বংশীতলা যুদ্ধের পর বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে করিমপুরে আরেক যুদ্ধ সংগঠিত হয়। ওই যুদ্ধেও মুক্তিবাহিনী দুর্বাচারা থেকে তাদের মিশন শুরু করে। মুখোমুখি ওই যুদ্ধে শহীদ হন তৎকালীন রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ার্স কলেজের মেধাবী ছাত্র শহীদুল ইসলাম। তাকেও পরে দুর্বাচারা পাঁচ শহীদের পাশে সমাহিত করা হয়।
বংশীতলা যুদ্ধে শহীদ হন দুর্বাচারার কৃতী সন্তান তাজুল ইসলাম। তৎকালীন সময়ে অনার্স পড়ুয়া এ ছাত্র সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর হাতের হলুদ থাকা অবস্থাতেই ভারতে ট্রেনিংয়ে যান। সেখান থেকে এসে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শহীদ তাজুলের বাবা করিম শেখ বলেন, তাজুল ছিল পরোপকারী। অন্যের উপকার করাই যেন ওর নেশা ছিল। দুঃসাহসী তাজু বংশীতলা যুদ্ধে একাই শায়েস্তা করেন এক পাক সেনাকে। ওর শক্তির কাছে হার মেনে শক্রুরা পেছন থেকে গুলি করে কাপুরুষের মতো ওকে হত্যা করে।
করিমপুর যুদ্ধে শহীদ হওয়া শহীদুল ইসলাম ছিলেন অত্র এলাকার সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র। তৎকালীন সময়ে রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ার্স কলেজে ইলেকট্রিক্যাল তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি। বর্তমানে যা রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) নামে পরিচিত। উজানগ্রাম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত ছলিম উদ্দিন বিশ্বাসের ছেলে শহীদুল ছিলেন অতি মেধাবী একজন ছাত্র। ওই সময়ে এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নে পাড়ি জমান রাজশাহী। কিন্তু দেশমাতৃকার প্রয়োজনে কলম ছেড়ে হাতে অস্ত্র তুলে নেন দেশপ্রেমের হাতিয়ার। ৬ ডিসেম্বর অকুতভয় এ বীর পাক হানাদারদের নৃশংসতার শিকার হন।