দেশের সবগুলো চিনিকল যখন লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে গভীর জলে হাবুডুবু খাচ্ছে, তখনো সরকারকে প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব দিয়েও মুনাফা অর্জন করেছে কেরুজ কমপ্লেক্স। কেরুজ কমপ্লেক্স বরাবরের মতো গত অর্থ বছরেও মুনাফা অর্জন হয়েছে ১শ সাড়ে ৪ কোটি টাকা।
সরকারের রাজস্ব খাতায় ৭৩ কোটি জমা দিয়েও মিলের ৩টি বিভাগের ৭৬ কোটি টাকা লোকসান পুষিয়ে মূল মুনাফার খাতায় জমা হয়েছে প্রায় সাড়ে ২৮ কোটি টাকা। কেরুজ কমপ্লেক্স আরও লাভজনক করতে গ্রহণ করা হয়েছে নানামুখি পদক্ষেপ। তবে আগামি আখ মাড়াই মরসুম হুমকির মুখে পড়েছে। কেরুজ কমপ্লেক্সের বয়স পেরিয়েছে ৮৩ বছর। জোড়াতালি দিয়েই বারবার আখ মাড়াই মরসুমের কার্যক্রম চালু করা হয়ে থাকে। খানেকটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে কোনোভাবে শেষ করা হয়ে থাকে আখ মাড়াই কার্যক্রম। লাগাতার যান্ত্রিক ত্রুটির কবলে পড়ে নাজেহালে পড়তে হয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। চিনি কারখানার দশা যা হোক না কেন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন থেকে প্রতি বছরের আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদনের লক্ষমাত্র বেধে দিতে কমতি করেন না কর্তাবাবুরা।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হোক বা না হোক বোঝা চাপিয়ে দিতে মোটেও ভুল হয় না করপোরেশনের। গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর কেরুজ চিনিকলের ২০২০-২১ আখ মাড়াই মরসুমের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিলো। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন কর্তৃক বেধে দেয়া লক্ষমাত্রা অনুযায়ি ওই মরসুমে ১ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিকটন আখ মাড়াই করে চিনি উৎপদন করতে হতো ৯ হাজার ৬২৫ মেট্রিকটন। চিনিকলের নিজস্ব ১ হাজার ৫৫০ একর জমিতে ২৪ হাজার মেট্রিকটন আখ, কৃষকের জমিতে ৬ হাজার ৯৮২ একর জমিতে ৯৪ হাজার মেট্রিকটন আখ রোপন করা হয়েছিলো।
এ ছাড়া বন্ধ হওয়া কুষ্টিয়া জগতি চিনিকলের আওতাধীন কৃষকদের ৩৬ হাজার মেট্রিকটন আখ কেরুজ চিনিকলে মাড়াই হওয়ার কথা থাকলেও শেষ অবধি তা কমে ১৪ হাজার মেট্রিকটন মাড়াই করা হয়। যে কারণে কেরুজ চিনিকলে ওই মরসুমে সর্বমোট আখ মাড়াই হওয়ার কথা ছিলো ১ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিকটন। ২৮ ফেব্রুয়ারি মাড়াই মরসুমের ৯৪ দিবস ছিলো।
ওই দিবসেই আনুষ্ঠানিকভাবে মিলের আখ মাড়াই মরসুমের সমাপনি ঘোষনা করা হয়। ওই মরসুমে ১ লাখ ১১ হাজার ৮৬২ মেট্রিকটন আখ মাড়াই করে চিনি উৎপাদন করা হয় ৫ হাজার মেট্রিকটন। তবে ওই মরসুমে চমকপ্রদ ঘটনা ছিলো ৯৪ দিন কোন প্রকার যান্ত্রিক ত্রুটি ছাড়াই বয়সের ভারে বুড়ো মিলটি আখ মাড়াই কার্যক্রম ছিলো অবিরাম। যে কারণে বাহ বাহ পেয়েছিলেন মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আবু সাঈদ। তার যথাযত কর্ম কৌশল দুরদর্শিতা, দক্ষ নির্দেশনা, আন্তরিক মনভাব, শ্রমিক-কর্মচারীদের কর্মদ্দোম করে তোলা, সততা ও নিষ্টার প্রতিফলন বলেই মনে শ্রমিক-কর্মচারীরা।
২০২০-২১ অর্থ বছরে কেরুজ চিনি কারখানায় লোকসান গুনতে হয়েছে ৭২ কোটি টাকা। চিনিকলের ৯টি খামার। খামারগুলো অব্যবস্থানা ও দুর্নীতির আখড়াতে পরিণত হওয়ায় ফি বছরেই লোকসান গুনতে হয়। বরাবরের তুলনায় ব্যত্বয় ঘটেনি গত অর্থ বছরেও। অর্থাৎ এ অর্থ বছরে ৯টি খামারে লোকসান গুনতে হয়েছে ৩ কোটি ৮৫ লাখ ও পরিক্ষামুলক খামারে লোকসান হয়েছে ২০ লাখ টাকা। এছাড়া আকন্দবাড়িয়া জৈব সার কারখানা লাভের আশায় পথ চললেও দিনদিন অবশ্য লোকসানের অংকটা কমছে। ফলে বরাবর লোকসান গুনলেও এ বছরে তা লাভে পরিণত হয়েছে। এবার ২৫ লাখ টাকা মুনাফা অর্জন হয়েছে আকন্দবাড়িয়া জৈব সার করখানা থেকে। সব মিলিয়ে ২০২০-২১ অর্থ বছরে কেরুজ কমপ্লেক্স ৫টি বিভাগের মধ্যে চিনি, ৯ টি খামার ও পরিক্ষামুলক খামারে লোকসান গুনেছে ৭৬ কোটি ৫ লাখ টাকা।
এ দিকে মুনাফা অর্জন হয়েছে ডিস্টিলারী, হ্যান্ড সেনিটাইজার ও বায়োফার্টিলাইজার বিভাগ থেকে। ৫২ লাখ ৪৭ হাজার ৪৭৩ প্রুপলিটার দেশি ও বিদেশী মদ উৎপাদন করে বাজারজাত করা হয়েছে ৪৬ লাখ ৯৬ হাজার প্রুপলিটার। এবার ১ লাখ ১৬১ হাজার কেস বিদেশী মদ বিক্রি করে সর্বকালের রেকর্ড ভেঙ্গেছে কেরুজ ডিস্টিলারী বিভাগ। ডিস্টিলারী বিভাগ থেকে সরকারকে ৭৩ কোটি ২০ লাখ টাকা রাজস্ব দিয়েও মুনাফা অর্জন হয়েছে ১শ ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বায়োফার্টিলাইজারে ভিনেগার উৎপাদনে মুনাফা অর্জিত হয়েছে ৩২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার উৎপাদনে ৫৫ লাখ টাকা মুনাফা অর্জন হয়েছে।
সর্বমোট মুনাফা অর্জন থেকে ওই অর্থ বছরে সরকারের রাজস্ব খাতায় ভ্যাট ও শুল্ক খাতে জমা দিতে হয়েছে ৭৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। অর্জিত মুনাফার ১শ ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকার মধ্যে ৭২ চিনি কারখানা, ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ৯ টি খামার ও পরিক্ষামূলক খামারের ২০ লাখ টাকা লোকসান পুষিয়ে ২৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা লাভের মুখ দেখেছে। সরকার ২৫ কোটি টাকা মুনাফা অর্জনের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করে দিলেও তা টপকে এবার ২৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকায় পৌছেছে কেরুজ কমপ্লেক্স। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে কেরুজজ কমপ্লেক্স মুনাফা অর্জন করেছে ১৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা।
২০১৮-১৯ অর্থ বছরে মুনাফা অর্জন হয় ১৫৮ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের রাজস্ব খাতায় জমা দেয়া হয় ৭৩ কোটি ৯২ লাখ টাকা। রাজস্ব দিয়েও ডিস্টিলারী কারখানা লাভ হয়েছিলো ৮৪ কোটি ৩৪ লাখ ২২ হাজার টাকা। চিনি কারখানায় লোকসান গুনেছে ৬৮ কোটি ৫৭ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। ৫০ লাখ ৬১ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে বায়োফাটিলাইজারে। বাণিজ্যিক খামারগুলোতে লোকসান গুনেছে ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। ২০ লাখ ৫৭ হাজার টাকা লোকসান গুনেছে আকন্দবাড়িয়া পরীক্ষামূলক খামারে। ফলে চিনিকলের ডিস্টিলারী কারখানা বাদে অন্যান্য ৪টি বিভাগে লোকসান গুনতে হয়েছে ৭৩ কোটি ২৪ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। সরকারের রাজস্ব ও ৪টি বিভাগের লোকসান গুনার পরও কেরুজ কমপ্লেক্স ওই অর্থ বছরে লাভ হয়েছিলো ১১ কোটি ৯ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। সে হিসেব মতে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের তুলনা ২০১৯-২০ অর্থ বছরের লাভের অংকটা বেশ মোটা থাকলে তা টপকালো ২০২০-২১ অর্থ বছরের লাভের অংক।
কেরুজ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আবু সাঈদ বলেন, এ অঞ্চলের অন্যতম অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি কেরুজ কমপ্লেক্স। সর্বক্ষেত্রে কেরুজ চিনিকলের অবদান রয়েছে । সরকারের এ মূল্যবান সম্পদ।